ব্রাজিলের সমর্থক, কিন্তু মেসিকেও তো ভালোবাসি
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
আজহারুল ইসলাম
১৩ জুলাই ২০২১
আর্জেন্টিনার শিরোপা-খরা ঘুচিয়ে পর্দা নেমেছে কোপা আমেরিকার। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মোটেই স্বপ্নের ফাইনাল উপহার দিতে পারেনি। লাতিন ফুটবলের চিরায়ত সৌন্দর্য অনুপস্থিত ছিল দু`দলের খেলাতেই। কোপার আয়োজন নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সঙ্গেও যা মিলে যায়। মেসি-ভক্ত এক ব্রাজিল সমর্থকের চোখে এবারের কোপার বিশ্লেষণ।
তাহলে অভিনন্দন জানিয়েই শুরু করা যাক। তিন দশকের বেশি ব্রাজিল সমর্থন করছেন, ব্রাজিলের প্রতিটি ম্যাচের আগে জাতীয় সংগীত পর্বের শুরুতেই আস্তে করে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে হলেও দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান, এমন একজন ব্রাজিল ফ্যান হিসেবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ইতিহাস সৃষ্টি করা বিজয়ে কিছুটা শুকনো হলেও ভনিতা নয়, বরং মন থেকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
ব্রাজিলের মতোই আমি বার্সেলোনার একনিষ্ঠ ভক্ত। আমার এই বার্সেলোনা-প্রীতি গত শতকের নয়ের দশকের শেষ থেকে, যখন বার্সায় রিভালদো, ক্লাইভার্ট, কোকুরা খেলতেন। রিভালদোর কারণেই আমার বার্সাকে অনুসরণ করা শুরু। বার্সাকে অনুসরণ করেই মেসিকে চেনা, এবং বর্তমানে খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে মেসিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। ব্রাজিলকে সমর্থন শুরু করেছিলাম মাত্র আট বছর বয়সে, যে বয়সে বিশ্বকাপ বা কোপা বা অন্য কিছুই একটা বাচ্চার বোঝার কথা নয়। আমিও এগুলোর কিছুই জানতাম না, স্রেফ ব্রাজিলের একটা ম্যাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল ভক্ত বনে গিয়েছিলাম। ঠিক তেমনি মেসিকেও পছন্দ করি স্রেফ মাঠে তাঁর মুভমেন্ট, পায়ের কাজ আর অবিশ্বাস্য সব কাণ্ডকারখানার জন্য। মেসির কয়টা গোল, কয়টা অ্যাসিস্ট, কয়টা হ্যাটট্রিক, কয়টা ব্যালন ডি’অর, কয়টা চ্যাম্পিয়নস লিগ, জাতীয় দলের হয়ে কয়টা শিরোপা…এগুলো কখনোই আমার মেসি-ভক্তির অনুসর্গ ছিল না। তাই আমার ব্রাজিল আর মেসি-প্রেম একই সূত্রে গাঁথা। ভালো লাগে তাই সমর্থন করি, কোনো শর্তের বালাই নেই। এখানে একটা জিনিস কাকতালীয়, আমি যে ম্যাচটা দেখে ব্রাজিলের ভক্ত হয়েছিলাম, সেই ম্যাচটি হয়েছিল ২৪ জুন, যা আবার লিওনেল মেসির জন্মদিনও (সাল দুটি যে আলাদা, তা কি বলার দরকার আছে?)।
তাহলে এবারর কোপা আমেরিকা ফাইনালে আমি কাকে সমর্থন করেছিলাম? অবশ্যই ব্রাজিলকে। ব্রাজিল হারায় মন খারাপ? অবশ্যই মন কিছুটা খারাপ। কিন্তু সান্ত্বনা পাচ্ছি মেসিই শিরোপাটা পেয়েছেন বলে। মেসির ভক্ত হিসেবে রোনালদোর ভক্তদের সাথে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে এই একটা জায়গাতেই মুখটা ভোঁতা হয়ে যেত, জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা। সেই অপেক্ষা এবার ফুরোলো।
২.
অনেক তো হলো আত্মকথন, এবার ম্যাচের কথায় আসি। রোববার সকালের ফাইনালটা দেখতে দেখতে আমার বারবার ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিল বনাম ইতালি ম্যাচটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কারণ, এই কোপা ফাইনালের মতো সেই ম্যাচটাও ছিল অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। প্রবল উত্তেজনা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে ম্যাচের জন্য অপেক্ষা, শেষ পর্যন্ত সেটি বোরিং। গোল খাওয়া যাবে না, এই অতি-সাবধানতায় দুই দলই নেতিবাচক ও রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলেছিল। তারকায় ঠাসা দুই দলের ম্যাচে পরিস্কার গোলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল হাতে গোনো কয়েকটা। ফলে ১২০ মিনিটের খেলা গোলশুন্য এবং পেনাল্টি শ্যুট আউটে ব্রাজিলের জয়।
আমি মোটামুটি বাজি ধরে বলতে পারি, গতকাল রেনান লোদি সেই হাস্যকর ভুলটা না করলে এই ম্যাচেও ১২০ মিনিটে কোনো গোল হতো না। হলুদ কার্ড ৯টার বদলে হতো ১২/১৩ টা, সঙ্গে ২টা লাল কার্ডও দেখা যেত নিশ্চিত। ৯০ মিনিটের খেলায় দুই দল মিলে ফাউল করেছে ৪১টি, মানে গড়ে প্রতি ২ মিনিটে ১টি করে ফাউল। এমন কোয়ালিটি-সম্পন্ন দুই দলের মোকাবিলায় কোথায় ক্লাইম্যাক্সের পর ক্লাইম্যাক্স দেখব, না, দেখলাম পুরোটাই অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। পুরো ম্যাচে টানা ৫-৬টা টানা পাস নেই, সংঘবদ্ধ আক্রমণ নেই, ডিফেন্স চেরা পাস নেই, নাটমেগ নেই, পায়ের কাজে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো নেই, ৪১টা ফাউল অথচ মনে রাখার মতো কোনো ফ্রি-কিকও নেই। তার বদলে থাকল শুধু শক্তির প্রয়োগ, রক্ষণে সর্বদা চার-পাঁচজনের দেয়াল তুলে রাখা, যেভাবেই হোক প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করা, সুযোগ বুঝে সময় নষ্ট করা ইত্যাদি।
এগুলো কিন্তু খেলারই অংশ। এগুলোর কোনোটাই খেলার নিয়মের বাইরে না, এগুলো করার জন্য কাউকে অপরাধীও করা যাবে না। কিন্তু এতেই সৌন্দর্য হারিয়েছে খেলাটা। গালভরা নাম ‘সুপার ক্লাসিকো’ হয়ে গিয়েছে স্যুডো (pseudo) ক্লাসিক। হ্যাঁ, গোল একটা হয়েছে। লোদির ভুলে পাওয়া গোলটা আসলেই হয়ে গিয়েছে কো-ইন্সিডেন্স, ডি পলের একেবারে নিরীহ সেই পাসটা লোদি আটকে দিতে পারলে সেটা আরেকটা নিষ্ফল প্রচেষ্টাই হতো। এর বাইরে আর যে কয়েকটা সুযোগ গোলকিপাররা নষ্ট করে দিতে পেরেছেন, সেগুলো এই পর্যায়ে স্বাভাবিক সেভ। এমন কোনো অন টার্গেট শট নিতে পারেননি দুই দলের খেলোয়াড়রা, যেটা সামাল দিতে গোলকিপারদের বেগ পেতে হয়েছে।
দেখুন, আমি কিন্তু কোনোভাবেই বিজয়ী দলের কৃতিত্বকে খাটো করার প্রয়াস খুঁজছি না। ফুটবল গোলের খেলা আর এখানে গোলটাই শেষ কথা। অন্য সব কিছু--পাসিং, ড্রিবলিং, ফ্রি-কিক, কাউন্টার অ্যাটক, তাল, ছন্দ--এগুলো সবই অলংকার মাত্র। এই কোপা ফাইনাল ছিল অলংকারবিহীন এক ম্যাচ, যেটা একজন বিজয়ী খুঁজে নিয়েছে। এতে অবশ্য শিরোপাজয়ী সমর্থকগোষ্ঠীর কিছু যায়-আসে না; কিন্তু ছন্দময় ফুটবলের সৌন্দর্যপিপাসু দর্শক মাত্রই হতাশ হয়েছেন।
৩.
রেফারিং নিয়ে বিতর্কটা অহেতুক। ডি মারিয়ার গোল এবং রিচার্লিসনের বাতিল হওয়া গোলের দুটি সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। অফসাইড নিয়মটা না জেনে হাস্যকর সব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তবে রেফারিং নিয়ে ছোটখাটো বিতর্ক হতেই পারে। বেশ কয়েকটা ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি বা ট্যাকলিং হয়েছে যেগুলোকে ফাউল ধরা যেমন যায়, তেমনি খেলার অংশ বলে সেটা এড়িয়েও যাওয়া যায়। দীর্ঘ দিন ধরে খেলা দেখার অভিজ্ঞতায় আমি যেটা বুঝি যে, প্রায় একই রকম সংঘর্ষে কোনো রেফারি ফাউল ধরেন, আবার কোনো রেফারি এড়িয়ে যান। প্রায় একইভাবে হাতে লেগেছে এমন ঘটনায় কোনো রেফারি ফ্রি-কিক দেন, কোনো রেফারি 'প্লে- অন' বলে সিগন্যাল দেন। প্রায় একই ঘটনা একজনের কাছে অফেন্স মনে হয়, আরেকজনের কাছে হয় না। এটা আসলে রেফারি-ভেদে আলাদা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা ক্রিকেটের আম্পায়ারস্ কলের মতো।
তবে অতীতের চেয়ে আমি বর্তমান রেফারিদের ওপর বেশি আস্থাশীল। কারণ আগে একজন রেফারি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতেন, এখন একাধিক রেফারি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখে, বিচার করে তুলনামূলক সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অনেক সময় একটা ফাউল টিভিতে ক্যামেরার এক অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে যে রকম মনে হয়, অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে সে রকম মনে হয় না। সেক্ষেত্রে একাধিক ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল থেকে দেখে, একটু সময় নিয়ে হলেও ত্রুটিহীন সিদ্ধান্ত পাওয়া যাচ্ছে। ভিএআর এখনো বিতর্কমুক্ত নয়। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, ভিএআর-পূর্ব যুগের চেয়ে এখন মাঠে ভুল সিদ্ধান্ত কম হচ্ছে। কোপার ফাইনালের রেফারিংকে আমি অন্তত ৮৫% নম্বর দেব।
৪.
মেসি কেমন খেললেন? গত তিন-চার বছর ধরে মেসিকে নিয়ে আমার একটাই আক্ষেপ, তুলনামূলক হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে মেসিকে স্বরূপে দেখা যাচ্ছে না। এটা স্বাভাবিক যে, মেসির মতো একজনকে বড় ম্যাচে সেরা ডিফেন্ডাররা কড়া মার্কিং-এ রাখবেন, বারবার ফাউল করে তাঁর স্বাভাবিক খেলা নষ্ট করে দেবেন। পেলে, ম্যারাদোনা থেকে শুরু করে হালের নেইমার--সবার জন্যই এটা বাস্তব। স্টার হওয়ার এটাই ঝামেলা। তারপরও বড় ম্যাচে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন বলেই তাঁরা সেরা। কিন্তু গত তিন-চার বছর মেসিকে বড় ম্যাচে হতাশাজনক পারফর্ম করতে দেখেছি। এই ফাইনালও তাতে আরেকটা সংযোজন। বরং শেষ মুহুর্ত এডারসনকে একেবারে ফাঁকা পেয়েও যেভাবে তিনি সুযোগটা মিস করলেন, সেটা অবিশ্বাস্য ছিল।
ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ডি মারিয়া। শুধু গোলটার জন্য নয়, যখনই ডি মারিয়া বল পেয়েছেন, মনে হয়েছে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ব্রাজিল ডিফেন্সে বেশ কয়েকবার আতঙ্ক ছড়িয়েছেন তিনি। আমার তো ধারণা, লোদির মিস করা বলটায় ডি মারিয়া বাদে আর কেউ থাকলে এরকম ক্লিনিক্যাল ফিনিশিং আমরা দেখতে পেতাম না।
৫.
এবার আসি কোপার আয়োজন নিয়ে আলোচনায়। একই সাথে কোপা আর ইউরো হয়েছে বলে অনেকেই তুলনা করে অনেক কিছু বলেছেন। আমার কাছে এবারের ইউরো হলো ক্রিকেটের আইপিএল, আর কোপা বিপিএল। আমি সব আসরের জন্য বলছি না, শুধু এবারেরটার কথা বলছি। পিঠাপিঠি আয়োজিত হওয়ায় এবারের কোপা ফাইনাল বাদে আসলেই ইউরোর কাছে একেবারে মার খেয়ে গিয়েছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। একটা টুর্নামেন্টের প্রাণ হলো দর্শক। ২০২০-এর চ্যাম্পিয়নস লিগের দর্শকবিহীন ফাইনালের কথা মনে আছে? এমন একটা পানসে ইউসিএল ফাইনাল কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কারণ একটাই, শূন্য গ্যালারি। ইউরো কোপাকে মূলত কিস্তিমাত করেছে এই দর্শক উপস্থিতি দিয়েই। আমি নিজেই বেশ কিছু ইউরোর ম্যাচ টিভির সাউন্ড মিউট করে দেখেছি, উত্তেজনা ৮০ শতাংশই গায়েব।
এরপর আসে বাজেটের কথা। কোপার ফাইনালে জেতায় চ্যাম্পিয়ন দল আর্জেন্টিনা প্রাইজমানি পাচ্ছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা, হেরে গিয়ে ব্রাজিল পাচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি। অথচ ইউরোর গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়া উত্তর মেসিডোনিয়া পেয়েছে প্রায় ৯৩ কোটি টাকা। ইউরোর অংশগ্রহণ ফি কোপার চ্যাম্পিয়নের প্রাইজমানির চেয়ে বেশি। ভাবা যায়!
তার ওপর এবারের কোপাটা শুরুর এক মাস আগেও পুরো অনিশ্চিত ছিল। আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়ায় হওয়ার কথা থাকলেও করোনা আর রাজনৈতিক কারণে দুই দেশের নাম কাটা গেল, এরপর শোনা গেল কোপা হবে আমেরিকাতে। আবার শোনা গেল, আমেরিকা আয়োজন করতে রাজি না, এবারের কোপা না-ও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে ব্রাজিল আয়োজন করতে রাজি হলো। অথচ ব্রাজিল করোনায় মৃতের সংখ্যায় বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশের একটি। এমন পরিস্থিতিতে এবারের কোপাটা আয়োজন করাটাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। গ্যালারিতে দর্শক নেই, মাঠ নিম্নমানের, অর্থহীন গ্রুপ পর্ব, কোচ-খেলোয়াড়দের করোনায় আক্রান্ত হওয়া, ল্যাটিনদের দৃষ্টিকটু গা-জোয়ারি ফুটবল--সব কিছু মিলে কোপা ছিল উজ্জ্বল ইউরোর কাছে এক্কেবারে মলিন।
তবে কোপার আয়োজনগুলো এমনই হয়। দেখুন, প্রতি চার বছরে যে আসর বসার কথা, গত ছয় বছরেই তার চারটি আসর দেখে ফেললেন (২০১৫, ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১)। অদ্ভুত না? কোপার ইতিহাসটাও এরকম খামখেয়ালিপনা আর অব্যবস্থাপনায় ভরা। বেশি দূরে না, শুধু গত ছয় বছরের দিকেই তাকান। ২০০৪, ২০০৭ আর ২০১১-র পর ২০১৫-র কোপা হয়ে গেল। এর মধ্যে কনমেবলের খেয়াল হলো, ১৯১৬ সালে শুরু হওয়া কোপা আমেরিকার শতবর্ষ পূর্তি হবে ২০১৬ সালে। তাই শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ২০১৬ সালে আরেকটা কোপা আয়োজন করা যাক। পরপর দুই বছর হলো দুটি কোপা। এরপরের আসরটা আবার ২০১৬ সালে নয়, ২০১৫-র সাথে চার বছর মিলিয়ে করা হলো ২০১৯ সালে।
২০১৭ সালে এসে আয়োজক কনমেবলের খেয়াল হলো, জোড় বছরে ইউরো আর বেজোড় বছরে কোপা আমেরিকা হয় বলে ইউরোপের ক্লাবগুলো কোপার সময় ল্যাটিন খেলোয়ারদের ছাড়তে ধানাইপানাই করে। তাই যে বছর ইউরো চলবে, সে বছরেই ইউরোর সাথে মিলিয়ে কোপা আয়োজন করতে পারলে ভালো হয়। যেহেতু ২০১৬-র পরের ইউরো নির্ধারিত ছিল ২০২০ সালে, সেহেতু ২০২০ সালে আরেকটি কোপা হোক। মানে ২০১৯ সালের কোপা ঠিকই থাকবে, ২০২০ সালে আবার কোপা হবে! অর্থাৎ ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাঁচ বছরে চারটি কোপা! সেই ২০২০ সালের নির্ধারিত কোপা করোনার কারণে ইউরোরে সাথে মিলিয়ে আয়োজিত হলো ২০২১ সালে। অথচ ইউরোপের করোনা পরিস্থিতি আর ল্যাটিন আমেরিকার করোনা পরিস্থিতি পুরো ১৮০ ডিগ্রি ভিন্ন।
পরবর্তী কোপা আয়োজিত হওয়ার কথা ২০২৪ সালে, ইকুয়েডরে। তবে আমি নিশ্চিত, ব্যাপারটা এত ঝামেলাবিহীন হবে না। এবারের কোপা আয়োজনের স্বত্ব নির্ধারিত ছিল আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়ার কাছে। এবার যেহেতু করতে পারল না, সেহেতু ক্ষতিটা পোষানোর জন্য বিকল্প চেষ্টা তারা করবে। তাছাড়া ২০৩০ সালে ফিফা বিশ্বকাপের শতবর্ষ পূর্তি। শোনা যাচ্ছে, ১৯৩০ সালের সাথে মিল রেখে ২০৩০ সালের বিশ্বকাপটাও উরুগুয়ে আয়োজন করতে চায়, যৌথভাবে বিড করবে উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা আর কলম্বিয়া। সেক্ষেত্রে ট্রায়াল হিসেবে এই তিন দেশ আগামী দুইটা কোপার একটা আয়োজন করতে অবশ্যই চাইবে। সুতরাং কোপার পরবর্তী স্বাগতিক নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা থাকছেই। সব মিলিয়ে বলতে হয়, উয়েফার মতো পেশাদারিত্ব কনমেবলের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না।
৬.
শেষ কথা হলো, খেলাটা দিন শেষে শুধুই একটা খেলা। মানুষের জীবনে বিনোদন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষঙ্গ। বিনোদনের জন্য আমরা কেউ গল্পের বই পড়ি, কেউ গান শুনি, কেউ ছবি আঁকি, কেউ বেড়াতে যাই, কেউ আড্ডা দিই, আবার কেউ খেলা দেখি। আমি কোনো দিন শুনিনি, একটা গল্পের বই পড়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়েছে, গান শোনা নিয়ে হাতাহাতি হয়েছে, বা ছবি আঁকা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছে। কেবল খেলা নিয়েই কেন এরকম অসুস্থ সব কাণ্ডকারখানা হয়, সেটা বুঝতে আমাকে বেশ কষ্ট হয়। আপনার প্রিয় দল হেরে গেলে কিন্তু পৃথিবীর কোনো কিছু বদলে যায় না। সবাই যে খেলা দেখে বা খোঁজখবর রাখে, তা-ও তো না। খেলা জিনিসটা কোনো যুদ্ধ বা আধিপত্যের কিছু না যে, হেরে গেলে আপনার জীবনে সেটা মৌলিক পরিবর্তন আনবে। খেলাটাকে স্রেফ একটা খেলা হিসেবেই দেখুন। সাথে অন্যের পছন্দকে সম্মান করুন। আপনি যদি প্রতিপক্ষকে সম্মান না করেন, তাহলে নিশ্চয়ই প্রতিপক্ষ সমর্থকরাও আপনাকে সম্মান করবে, এমন আশা করতে পারেন না।