ফুটবল `কামিং হোম`, নাকি `গোয়িং রোম`?
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
মেহেদী হাসান মারুফ
১১ জুলাই ২০২১
সব রোমাঞ্চের অবসান ঘটিয়ে ইউরো ২০২০-এর পর্দা নামছে আজ। ওয়েম্বলির ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ইতালি-ইংল্যান্ড। ফাইনালের আগে দুই দলের শক্তি, দুর্বলতা, সাম্প্রতিক ফর্ম, ডাগআউটের দ্বৈরথ আর ইতিহাস-- সব কিছুই থাকল এই লেখায়।
ফুটবল কি নিজ হোমে ফিরবে, নাকি রোমে যাবে? কথাটা শুনতে কিংবা বলতেও খুব ছন্দময় লাগে। একদিকে ইংল্যান্ডের সামনে সুযোগ ৫৫ বছরের শিরোপা-খরা কাটানোর, অন্য দিকে ইতালির সামনে এসেছে ২০১৮ বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব উতড়াতে না পারার ব্যর্থতা মোচনের সুযোগ। কে জিতবে? এই জল্পনা-কল্পনাতেই তো বুঁদ হয়ে আছে পুরো ফুটবল দুনিয়া ।
বাজির দরটা অবশ্য ইংল্যান্ডের দিকেই ভারি। খেলা যে ইংল্যান্ডের ফুটবল তীর্থ ওয়েম্বলিতে। ফাইনালে ষাট হাজার সমর্থকের সিংহভাগই গলা ফাটাবে ইংরেজদের হয়ে। ফাইনালের আগে ইতালিয়ান কোচ মানচিনিও সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন এই ইঙ্গিত। জানিয়েছেন, ওয়েম্বলিতে 'আনফেয়ার ক্রাউড' ভোগাতে পারে ইতালিকে। ইতিহাসটাও ইংলিশদের জন্য কাজ করছে অনুপ্রেরণা হয়ে। এই মাঠেই ৫৫ বছর আগে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিল ববি মুর, ববি চার্লটনের 'দ্যা মাইটি ইংল্যান্ড'।
রবার্তো মানচিনিরও অচেনা নয় এই ওয়েম্বলি, তবে 'দ্যা রেনেসাঁ ম্যান' মানচিনির স্মৃতিটা ইংলিশদের মতো রোমাঞ্চকর নয়। ১৯৯২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে (বর্তমান উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) এই মাঠেই বার্সেলোনার কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল মানচিনির তখনকার ক্লাব সাম্পদোরিয়া। ৩০ বছর বাদে সেদিনের দুঃখ ঘোচানোর হাতছানি কোচ মানচিনির সামনে। ইতিহাস আশাবাদী না করলেও সাম্প্রতিক ফর্মটা যোগাচ্ছে বিশ্বাস, এই মাস্টার ট্যাকটিশিয়ানের সময়ে তো রীতিমতো অজেয় হয়ে উঠেছে আজ্জুরিরা। সর্বশেষ ৩২ ম্যাচের একটিতেও প্রতিপক্ষের কাছে হার মানেনি চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
খেলোয়াড়ি-জীবনে ওয়েম্বলিতে দুঃসহ অভিজ্ঞতা আছে ইংলিশ কোচ গ্যারেথ সাউদগেটেরও। '৯৬ ইউরোতে তাঁর পেনাল্টি মিসেই তো জার্মান যান্ত্রিক ফুটবলের কাছে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ইংলিশদের।
কোচ হিসেবে ফিরে ইংল্যান্ডকে আবার দেখাচ্ছেন নতুন স্বপ্ন। ২০১৮ বিশ্বকাপেও নিয়ে গিয়েছিলেন শেষ চারে, তবে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে হাতছাড়া হয়েছিল সেবার। এবার নিশ্চয়ই আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাইবেন না এই ইংলিশম্যান।
তবে কাজটা যে মোটেই সহজ হবে না, তিনি নিজেও জানেন। ডাগআউটে দুই কোচের কৌশলের লড়াই থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা, ম্যাচের গতিপথ বদলে যেতে পারে এক মুহূর্তেই। প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে রেফারি কিংবা ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্সের কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্তও। ফাইনালে দুই ম্যানেজারই যে তাই আঁটঘাঁট বেঁধে রণকৌশল সাজাচ্ছেন, তা বলাই বাহুল্য।
তা কেমন কৌশলে খেলতে পারে দু'দল?
এখন পর্যন্ত চিরাচরিত ইতালিয়ান রক্ষণাত্মক ফুটবল থেকে বেরিয়ে এসে সফলতার সাথে আধুনিক টোটাল ফুটবলের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে রবার্তো মানচিনির ইতালি। কোচ মানচিনি ফুটবলের গতানুগতিক ৪-৩-৩ ফরমেশন দিয়েই প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙেছেন, আবার প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে দাঁড় করিয়েছেন রক্ষণ-প্রাচীর।
ম্যাচে ইতালিয়ান ডিফেন্ডারদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে ইংলিশ আক্রমণের মুখে দ্রুত বল কেড়ে নেওয়া। যে কাজটা করতে স্পেনের সাথে প্রায় ব্যর্থই হয়েছিলেন ইতালিয়ান খেলোয়াড়েরা। যদিও সেই ম্যাচে স্প্যানিশ ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় সে যাত্রায় বেঁচে গেছে ইতালি, তবে ইংলিশ ফুটবলাররা নিশ্চয়ই সে রকম কোনো করুণা দেখাবেন না। ইংল্যান্ডের আক্রমণাত্মক আর সৃজনশীল মিডফিল্ডারদের সাথে দ্রুতগতির উইঙ্গার এবং সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হ্যারি কেনের সামনে একই ভুল করলে চড়া মাশুলই গুনতে হবে ইতালিয়ানদের। দুই সেন্টারব্যাক বোনুচ্চি-কিয়েলিনির সঙ্গে মিডফিল্ডার জর্জিনিও-ভেরাত্তিকেও তাই ম্যাচে জড়াতে হবে নিবিড়ভাবে। পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই দারুণ দক্ষতায় গোলবার সামলানো জিয়ানলুইজি ডোনোরুমাকেও কাটাতে হবে আরেকটা ভালো ম্যাচ।
তবে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গিয়ে ইতালিয়ান লেফটব্যাক লিওনার্দো স্পিনোজ্জোলা বেশ ভালোরকম পীড়া দিচ্ছেন মানচিনিকে। স্পিনাজ্জোলা না থাকার ক্ষতিটা স্পষ্ট টের পাওয়া গেছে স্পেনের সাথে সেমিফাইনাল ম্যাচেই। রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি বাম প্রান্ত ধরে ওপরে উঠে আক্রমণে আলাদা একটা চাপ তৈরি করার ভূমিকা ছিল স্পিনাজ্জোলার। তাঁর জায়গায় খেলে গত ম্যাচে অনভিজ্ঞ এমারসন তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেননি সে ক্ষেত্রে। কাজেই ফাইনালে দ্রুতগতির কাইল ওয়াকারের চোখে ধুলো দিয়ে ওভারল্যাপ করার কাজটা কাকে দিয়ে করাবেন, কীভাবে করাবেন--মানচিনিকে এর ছক কষতে লম্বা সময়ই ব্যয় করতে হবে।
দুশ্চিন্তা আছে মূল স্ট্রাইকার চিরো ইমমোবিলের পারফরম্যান্স নিয়েও। যদিও দুই উইঙ্গার কিয়েসা আর ইনসিনিয়ের গতিকে কাজে লাগিয়ে কাউন্টার অ্যাটাক হতে পারে ইংলিশ রক্ষণ-দুর্গ ভাঙতে আজ্জুরিদের ট্রাম্প কার্ড।
ইংলিশ দুর্গ? বাড়িয়ে বললাম কি? না, একদমই না। এই ইউরোতে খেলা ৬ ম্যাচে মাত্র ১ গোল হজম করেছে ম্যাগুয়ের-স্টোনসকে মাঝে রেখে গড়া ইংল্যান্ড রক্ষণভাগ। ওই গোলেও তাঁদের ভুল ধরার সাধ্য কই? গোলটা তো এসেছে ফ্রি-কিক থেকে!
স্পিনাজ্জোলার অনুপস্থিতিতে ইংলিশ রাইটব্যাক ওয়াকারকে প্রতিপক্ষের অর্ধে ঘোরাঘুরি করতে দেখার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর ফুলব্যাক লুক শ ও কাইল ওয়াকার আক্রমণভাগে ওভারল্যাপ করলেও দ্রুতগতির কারণে খুব সহজেই নিজেদের জায়গায় নেমে প্রতিপক্ষের উইঙ্গারকে রুখে দিতে সক্ষম।
কাগজে কলমে ৪-৩-৩ হলেও সাউদগেট দলকে সাধারণত গতানুগতিক ইংলিশ ফুটবল ফরমেশন ৪-২-৩-১ ছকেই দলকে খেলিয়ে থাকেন। যেখানে ফিলিপস-রাইস পিভট রোল প্লে করে রক্ষণে বাড়তি নমনীয়তা দেন থ্রি লায়নদের। আরেক মিডফিল্ডার ম্যাসন মাউন্টের কাজ প্রতিপক্ষের ফাঁক-ফোকর কাজ লাগানো।
আগের দুই ম্যাচে সাকা থাকলেও ফাইনালে ইংলিশদের দুই উইংয়ে ফোডেন-স্টার্লিং থাকার সম্ভাবনাই প্রবল। আর সাউদগেটের হাতে অপশন হিসেবে সাকার সঙ্গে সানচো তো থাকছেনই, যাঁরা খুব সহজেই গতি দিয়ে ইতালির রক্ষণভাগের হেস্তনেস্ত করে ফেলতে পারেন।
এখন পর্যন্ত দুই দলই অপরাজিত। এই অপরাজিত-যাত্রা কোন দল ধরে রাখবে টুর্নামেন্ট শেষেও, সেটা দেখার অপেক্ষাতেই এখন পুরো ফুটবল দুনিয়া।