মেসির ফাইনাল-দুঃখ
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
১০ জুলাই ২০২১
পাঁচটা কোপা, চারটা বিশ্বকাপ খেলে একবারও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি মেসির। চারবার ফাইনালে উঠেও তো থাকতে হয়েছে পরাজিত দলেই। কোপা আমেরিকা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে আরও একবার ফাইনালে উঠেছে মেসির আর্জেন্টিনা। এবারই কি অধরা শিরোপার দেখা পাবেন মেসি, আগের চারটি ফাইনালই যেখানে হয়ে আছে কেবলই আক্ষেপের নাম।
এবারই তাহলে, মেসি?
অর্জনের ভাঁড়ার ঘরজুড়ে তাঁর পনের আনাই পূর্ণতা। 'কী আছে' প্রশ্নের চেয়ে যেখানে 'কী নেই' জিজ্ঞাসাতেই উত্তর মিলবে সহজে। ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটা ভর্তি ৬ ব্যালন ডি'অর, ২১টা সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারে। দলগত অর্জনের খাতাতেও ৩৪ শিরোপা, যার ২৪টা আবার ফাইনাল জিতে। ফাইনালের মঞ্চে নিজেও ছিলেন আপন আলোয় ভাস্বর। করেছেন ৩১ গোল, সঙ্গে গোলে সহায়তাও করেছেন ১৩টি।
কিন্তু এই সবই তো ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে, জাতীয় দলের হয়ে তো বারবারই ফিরতে হয়েছে পরাজিত সৈনিকের বেশে। আর্জেন্টিনার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছেন, জিতেছেন অলিম্পিক স্বর্ণও--কিন্তু বয়সভিত্তিক দলের হয়ে পাওয়া সাফল্যে কি আর 'জিতেছি' বলা চলে! ক্যারিয়ারে তাই ওই এক আনা ফাঁক রয়েই গেছে।
আরও একবার জাতীয় দলের হয়ে 'কিছু একটা জেতা'র একদম দুয়ারে দাঁড়িয়ে মেসি। ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জয়ের স্বাদ দিতে রোববার ভোরে ব্রাজিলের বিপক্ষে নামছেন ফাইনালে। মেসি কি পারবেন, ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচাতে? এর আগে চারটা ফাইনাল খেলেও যা ঘোচেনি!
মেসির দুঃখগাথা হয়ে থাকা ওই চারটি ফাইনাল একটু ফিরে দেখা যাক।
২০০৭ কোপা আমেরিকা
ফাইনাল-হতাশায় মেসির অভিষেক আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে। এর আগের বছরই বেঞ্চে বসে দেখেছেন বিশ্বকাপ থেকে শেষ আটেই আর্জেন্টিনাকে ছিটকে যেতে। বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের প্রথম সুযোগ তাই ২০০৭ কোপা আমেরিকাতেই পেয়েছিলেন। সেবার আর্জেন্টিনা খেলেছিলও দুর্দান্ত, ফাইনালে ওঠার পথে প্রতিপক্ষকে দিয়েছিল ১৬ গোল। মেসিও গোল পেয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে।
অথচ ফাইনালে এই দলটাই ব্রাজিলের কাছে উড়ে গিয়েছিল ৩-০ ব্যবধানে! ওই ব্রাজিল, যে দলটা সেবারের কোপা-অভিযান শুরু করেছিল মেক্সিকোর কাছে ২-০ গোলে হেরে।
মেসির তখন মাত্র ২০। 'সামনে এমন কত-শত সুযোগ আসবে' বলেই ভেবেছিলেন হয়তো। কে জানত, ১৪ বছর বাদেও মেসিকে একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকতে হবে!
২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবল
আক্ষেপের গল্পের পরের অধ্যায়টা সাত বছর বাদে। 'যতটা ক্লাবের, ততটা আর্জেন্টিনার নন' বদনাম জুড়েছিল মাঝে। ওই বিশ্বকাপে যেন নেমেছিলেন সেই কলঙ্ক ঘোচানোর মিশনে। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই করেছিলেন চার গোল, অ্যাসিস্ট-প্রি অ্যাসিস্টে পার করেছিলেন শেষ ষোল-শেষ আটের বাধা, সার্জিও রোমেরো বীরত্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফাইনালেও। ব্যস, ওই পর্যন্তই তো!
গঞ্জালো হিগুয়েইন ম্যানুয়েল নয়্যারকে একা পেয়েও বল রাখতে পারেননি পোস্টে, একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন রদ্রিগো প্যালাসিও-ও। মেসির নিজের শটও তো 'একটুর জন্য' আফসোস জাগিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল পোস্ট ঘেঁষে। অতঃপর ১১৩ মিনিটে মারিও গোটজের গোলে মেসির স্বপ্নভঙ্গ। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন মেসি, কিন্তু তা কি আর বিশ্বজয়ের সুযোগ হারানোর সান্ত্বনা হতে পারে!
২০১৫ কোপা আমেরিকা
স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয়েছে পরের দু'বছরেও, দুবারই হন্তারকের ভূমিকায় চিলি। ২০১৫ সালের টুর্নামেন্টে চিলির মাটিতে পঞ্চমবারের মতো ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা, সেমিফাইনালে প্যারাগুয়েকে হারিয়েছিল ৬-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে। অথচ ফাইনালে এই দলটাই গোল করতে পারল না একবারও। আরও একবার হিগুয়েইন মেসিকে আক্ষেপে পোড়ালেন ক্ষমার অযোগ্য এক মিসে।
টাইব্রেকারেও শট রাখতে পারেননি পোস্টে। মেসি তাই পেনাল্টি শ্যুটআউটে গোল করলেও শিরোপা-উৎসব হয়েছিল চিলিতেই।
মেসি শূন্য হাতে ফিরলেন, তৃতীয়বারের মতো।
২০১৬ কোপা আমেরিকা
সম্ভবত মেসির জীবনের সবচেয়ে হতাশায় মোড়ানো মুহূর্ত রচিত হয়েছিল ২৭ জুনের ওই রাতেই। শতবর্ষীয় কোপার বিশেষ আসর বসেছিল যুক্তরাষ্ট্রে, আর টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনাকে পাওয়া গিয়েছিল রুদ্রমূর্তিতে। ফাইনালের আগে ৫ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে গোল দিয়েছিল ১৮টি। মেসির নামের পাশেও ছিল ৫ গোল আর ৪ অ্যাসিস্ট।
এবং, আরও একবার ফাইনালে গিয়েই খেই হারিয়েছিলেন তিনি, সঙ্গে জালের ঠিকানা ভুলেছিল তাঁর দলও। চিলির সঙ্গে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ম্যাচ গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। সেখানেই মেসির ওই 'বিখ্যাত' মিস, ৪-২ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে শিরোপাটা গেল চিলির ঘরেই-- সব তো এই সেদিনের স্মৃতিই মনে হয়।
ম্যাচ শেষ হলেও ওই ম্যাচের রেশ রয়ে গিয়েছিল আরও বেশ কিছুদিন। 'দশ বছরে সমস্তটা বিলিয়েও কিছু পাইনি, আর পাওয়ার চেষ্টাও করতে চাই না'-- এই কথা বলেই মেসি ফাইনাল শেষে জানিয়েছিলেন তাঁর অবসরের ঘোষণা।
কষ্ট চেপে মেসি অবশ্য জাতীয় দলে ফেরত এসেছেন ঠিকই। খেলেছেন ২০১৮ বিশ্বকাপ, সঙ্গে ২০১৯ কোপাও। পারেননি দুটোর একটিতেও। গত কোপাতে তো লাল কার্ড দেখে বহিষ্কৃতও হয়েছেন, শাস্তির মুখে পড়েছিলেন 'ব্রাজিলকে জেতাতে সব যোগাড়যন্ত্রই কনমেবল করেছে'--জাতীয় মন্তব্য করেও।
এবারের কোপা-অভিযান এখন পর্যন্ত অবশ্য ভালোই চলছে। ৪ গোল আর ৫ অ্যাসিস্টে আর্জেন্টিনাকে তুলেছেন ফাইনালে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, ২০০৭ সালে যাদের কাছে হেরেই শুরু হয়েছিল সব আক্ষেপের সূচনা। গত আসরেও যাদের কাছে ২-০ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল সেমিফাইনাল থেকেই। ফাইনালের ভেন্যুটাও সেই মারাকানা, ২০১৪-তে যেখানে দর্শক হয়ে দেখেছিলেন জার্মান-উৎসব।
পাঁচটা কোপা, চারটা বিশ্বকাপ, চারটা ফাইনাল…১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মেসির জাবেদাখাতায় না মেলা অনেক হিসাবই জমা হয়েছে। এবারই কি মেসির সব হিসাব মিলবে? কে জানে, বিধাতা বোধ হয় ওই প্রবাদটা দিয়েই মিলিয়ে দিতে চাইছেন মেসির বকেয়া সব হিসাবকে!
দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে।