`বাঘের বাচ্চা গুলকি মার্তিনেজ, একবারে কাঁকড়া`
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ
৮ জুলাই ২০২১
এই দৃশ্যটা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলায় নিয়মিত। দোকানগুলো হয়ে উঠছে মিনি স্টেডিয়াম, চলছে নানা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। তেমনই একটি দোকানে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করলেন লেখক।
ভোর ৬টা বেজে ৪০ মিনিট। বাজারে দোকানদাররা 'বিসমিল্লাহ' বলে দোকানের ঝাপ তুলছে। ঝাড়ু দিচ্ছে। একে একে বিভিন্ন বয়সের খদ্দের জমছে। কেউ আসছেন চোখ ঘষতে ঘষতে, কেউ বা আবার ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে। নিয়ত একটাই, চা খেয়ে টিভির সামনে বসবেন। আর্জেন্টিনার খেলা শুরু হলো বলে।
প্রিয় দল আর্জেন্টিনার বিপক্ষ দলের নামও জানে না, এমন মানুষও আছে তাদের ভিড়ে। কারও কাছে হয়তো শুনেছেন, আজ আর্জেন্টিনার খেলা আছে, এতটুকুই যথেষ্ট। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছেম। বাড়িতে যে টিভি নাই, তা না। টিভি আছে। কিন্তু একা একা সাউন্ড কমিয়ে খেলা দেখলে কি আর জমে! গোল হলে চিৎকার জুড়ে দিয়ে বুকে চাপড়াতে হবে না! সে জন্যই একখানে জামায়াত হওয়া।
তবে একটা দুসংবাদ। লোকজন এসেই শুনেছেন, ডিশ এন্টেনা নাই। শুনে মেজাজ হারিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, 'অয় (ডিস অপারেটর) ব্রাজিলের সাপোর্টার। হের লাইগা (সে জন্য) ডিস দেয় নাই।'
ডিশ নাই তো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শহরে ওয়াইফাই ব্যবহার করে মোবাইল ফোনেই খেলা দেখা যায়। কিন্তু ওই অজপাড়াগাঁয়ে কী করে ওয়াইফাই আসবে! তাহলে কি খেলা দেখা হবে না? নিশ্চয়ই হবে। কারন ডিশ থাকুক বা না থাকুক, আর্জেন্টিনার খেলা, খেলা তো দেখতেই হবে।
ওয়াজেদ (২০) নামে একটা ছেলে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোবাইলে খেলা চালু করে একটা বেঞ্চিতে রাখল। বেঞ্চিটাকে ঘিরে দশ-পনেরোজনের জটলা। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত শুরু হয়েছে। একজন পাশ থেকে বলল ওয়াজেদের মোবাইলের ডাটা শেষ হলে সে তার ফোনের ডাটা ব্যবহার করে খেলা দেখাবে। বেশ আমেজের ব্যাপার।
এমন সময় যে দোকানে খেলা দেখা হয়, সেই দোকানদার ডাক দেয়, 'ডিশ আসছে, ডিশ আসছে।' মোবাইল ঘিরে যে জটলাটা ছিল, তা মুহূর্তে ভেঙে সবাই সেই দোকানের দিকে ছুট। কেউ দোকানের ভেতরে মেজেতে বসল, কেউ দোকানের সামনে বেঞ্চিতে। যাদের জায়গা হলো না, তারা দাঁড়িয়ে পড়ল যুতমত জায়গা করে। যদিও লকডাউন এত মানুষ একসঙ্গে জমা হওয়া ঠিক না। পুলিশ এসে ঠ্যাং খোঁড়া করে দিতে পারে। কিন্তু এটা প্রত্যন্ত এলাকা (নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নয়া বাজার)। পুলিশ এলেও ১০টার আগে আসবে না। খেলাটা নিশ্চিন্তে শেষ হবে।
তবুও তো ভয় থাকেই। হ্যাঁ, আরও একটা ভয় আছে। আর্জেন্টিনা হারলে ব্রাজিলের সমর্থকদের সামনে দাঁড়ানোর মত মুখ থাকবে না।
খেলা শুরু হয়ে গেল। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এখানকার বেশির ভাগ মানুষকেই কখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সময় টিভির সামনে বসতে দেখি নাই। নিজের দেশ হারল নাকি জিতল, সে সমন্ধে কখনো খোঁজ নিয়েছে বলে জানা নাই। অথচ ফুটবলে এত টান! এরা ক্রিকেটের নিয়ম কানুন জানে তো?
মেসির পায়ে বল গেলেই একটা উত্তেজনা ভর করে সবার মাঝে। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে যায় সামনে, চোখের মনি যেন স্থির হয়। এই বুঝি গোল হলো। হলোই তো, খেলা শুরুর ৭ মিনিটের মাথায় গোল। এক লাফে সবাই যেন উঠে পড়ল। হাত পায়ের ছোঁড়াছুড়ি, বুকে বুক মেলানো, বাঁধ ভাঙা চিৎকার…কে পায় আর তাদের?
আচ্ছা গোল কে দিল? মেসির অ্যাসিস্টে লাউতারো মার্তিনেজ। কিন্তু গোলদাতা লাউতারো মার্টিনেজের নাম ক'জন উচ্চরণ করতে পারে সেখানে? ২২ নাম্বার জার্সি গোল করেছে, গোল হয়েছে। ১-০ তে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা, এটাই আসল।
এখন কথা উঠল কলম্বিয়াকে নিয়ে। ওটাও কিন্তু ভালো টিম। গোল শোধ হতে পারে। কিন্তু দুই টিমই আজকে এত ফাউল করে খেলছে কেন? একজন বলল, 'এটা সেমিফাইনাল বুঝলেন বাহে, পয়েন্টের খেলা নোমায় (নয়)। যায় (যে) জিতবে তায় (সেই) ফাইনালে যাবে। আর হারলে বাড়ি। জীবন যাউক জিতির (জিততে) তো লাগবে। এমনি এইটা বোধায় (বোধ হয়) মেসির শেষ খ্যেলা (খেলা)।' অনেকে আবার মন্তব্য করছে, একটা গোলে ভরসা নাই। যখন তখন শোধ হতে পারে। আর একটা গোল দরকার।
এভাবেই ৪ মিনিটের অতিরিক্ত সময় শেষে প্রথমার্ধের সমাপ্তি। এখন রুটি-কেক-চা-পান-সিগারেট খাওয়ার সময়। যাদের পকেটে টাকা নাই, তারা উঠে অন্যত্র চলে গেলেন। একজন খাবে আর একজন দেখবে, দেখতে বাজে দেখায় বলে। কিন্তু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। ফিরে এসে দেখে, অন্য কেউ সেই জায়গায় আরাম করে বসেছে।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু। একসঙ্গে তিনজন খেলোয়াড় পরিবর্তন কলম্বিয়ার। একবারে নতুন করে যেন শুরু করছে তারা। গোল শোধ করে আরও একটা দিতে হবে-- এমনই হাবভাব। দোকানে দর্শকের সংখ্যাও বেড়েছে। আর্জেন্টিনা খুব একটা পাত্তা পাচ্ছে না। তাই দর্শকেরাও একটু ঝিমাচ্ছে। এমন সময় ডি মারিয়াকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামানো হলো।
আবার শুরু হলো নানা জনের নানা কথা। 'এইবার খেলা হবে বুঝলি । মেসিকে বল বানায় দিতে পারতেছে না তাই খেলা হচ্ছে না।' এর মধ্যে একজনের প্রশ্ন, 'আচ্ছা, ডি মারিয়ার সমস্যা কি? পুরো সময় খেলায় না কেন?' উত্তরে পাশ থেকে কেউ একজন বলল, 'আরে ওর দেহা (দেহ) চলে না। শুকান একটা মানুষ এই জন্যে পরে নামায়।' আর একজন বলল, 'ডি মারিয়া যে পজিশনে খেলে, ঐ পজিশনে অনেকগুলা প্লেয়ার। এই জন্যে লেটে নামায়।'
কথা বলতে বলতে গোল শোধ। লুইস দিয়াজের চমৎকার একটা গোল। সব কিছু যেন মুড়িয়ে গেল। অনেকে বলছে খেলাটা এবার জমবে। সত্যিই খেলা জমে গেছে। নতুন উত্তেজনা ভর করেছে। আর্জেন্টিনা ফের উদ্যম নিয়ে খেলছে। আর ফাউলের পর ফাউল চলছে।
দোকানে জমা হয়েছে সব বয়সের মানুষ। বাবা, ছেলে, চাচা, তরুণ, জোয়ান, বৃদ্ধ...সবাই যেন আজ এক ধাঁচের মানুষ। সবাই এক। সবাই খেলাপ্রেমী। যে মানুষটা খেলতে দেখলে বকা দেয়, 'সময়-অসময় নাই, তোগোর (তোদের) শুধু খেলা, খেলা আর খেলা। এই খেলাই তোগোরে (তোদের) নষ্ট করব (করবে)', সেই লোকটা পর্যন্ত পাশে বসে উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছেন আজ। এটাই ফুটবল। ঝগড়া-ঝাঁটি হয়ে কথা বলাবলি বন্ধ মানুষটাকে গোল হলে জড়িয়ে ধরা--এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য।
শেষমেশ তুমুল উত্তেজনাপুর্ণ খেলা গড়াল টাইব্রেকারে। প্রথমে কলম্বিয়ার হয়ে হুয়ান কুয়াদ্রাদো শট নিলেন, আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমি মার্তিনেজ। যে দিকে শট সে দিকেই লাফ দিয়েছিলেন মার্তিনেজ, কিন্তু গোল হয়ে গেল।
এবার আর্জেন্টিনার হয়ে শট নিতে কে আসছেন? এই নিয়ে চলছে চুল ছেড়াছেড়ি। কেউ বলছেন, 'মেসি এলায় (এখন) আসবে না। ২-৩টা শটের পর আসবে।' কেউ বা, 'মেসি পরে আসি কি হবে, আগের গুলান যদি আটকায়।'
কিন্তু জাদুকর মেসিই এলেন প্রথম শট নিতে। কলম্বিয়ার গোলকিপার দাভিদ অসপিনা। একজন বলল, 'হাতের মুষ্টি গুলা সবাই ছাড়ি দে। দে দে দে, বল যেন না আটকে।' হাতের মুঠি ছেড়ে দেওয়ায় যেন গোল কিপারকে ভেলকি লাগিয়ে গোল দিলেন মেসি। ফলাফল, দু'দলেরই প্রথম শট শেষে ১-১।
কলম্বিয়ার পরের শট আর্জেন্টিনার গোলকিপার মার্তিনেজ আটকে দিলেন। আর আর্জেন্টিনার হয়ে শট নিতে আসা ডি পল গোল পোস্টের উপর দিয়ে মারলেন। ১-১ গোলেই সমতা। আবার উৎকণ্ঠা, 'এয় যে চৌখে (চোখে) দেখে না? এরে কায় (কে) মারির দিছে? এত্তটা গোলবার ওয় বাইরোত (বাইরে) সটায় (শট নেয়)।'
কিন্তু কলম্বিয়ার তিন নাম্বার কিকে আর্জেন্টিনার গোলকিপার মার্তিনেজ ঠেকিয়ে দিয়েছেন। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়ের শটে গোল। তিন শট শেষে ২-১-এ আর্জেন্টিনা এগিয়ে। চতুর্থ শট শেষে দাঁড়ালো ২-৩; আর্জেন্টিনা এখনও এগিয়ে। শেষ শটে কলম্বিয়ার যদি গোল হয় আর আর্জেন্টিনা ব্যর্থ হয়, তাহলে খেলা গড়াবে সাডেন ডেথে। এর মধ্যেই কেউ একজন বলে ওঠে, 'আরে, ডি মারিয়া এখন সটায় নাই, ওরটাতেই ম্যাচ জিতবে।'
কিন্তু মার্তিনেজ ৫ নম্বর শটটাও আটকে দিলেন। সেই সাথে লাফিয়ে উঠল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের টঙ দোকানে জমায়েত হওয়া দর্শক। এখন নিশ্চিত, ব্রাজিলের সাথেই হবে ফাইনাল। সেটাই তো চেয়েছিলেন সবাই।
একজন এরই মধ্যে বলল, 'বাঘের বাচ্চা গুলকি (গোলকিপার) মার্টিনেজ। একবারে কাঁকড়া। তিনোডা (তিনটা) শট আটকাইছে।'
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ন'টার কাছাকাছি। দোকানটাও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। খেলা শেষ, এখন কাজে যেতে হবে তো!