`তুই আর্জেন্টিনা? তাহলে আমি ব্রাজিল!`
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
পার্থ প্রতিম
৮ জুলাই ২০২১
বাড়ি থেকে স্কুলে হেঁটে যেতে হতো লেখককে। একদিন দেখতে পান, কিছু বাড়ির ছাদে কাপড়জাতীয় কী যেন একটা উড়ছে। সেখান থেকেই কৌতূহলের শুরু। পরে জানলেন, সেগুলোকে পতাকা বলে আর প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতেই পতাকা টাঙানো। পতাকার সংখ্যাধিক্য দেখে লেখকের বন্ধু সমর্থন করতে শুরু করলেন আর্জেন্টিনা। আর লেখক গেলেন উল্টো প্রান্তে, সবুজ-হলুদ পতাকার দলে।
২০০২ বিশ্বকাপ দিয়ে আমার ফুটবল দেখার শুরু। তখন আমি পড়ি ক্লাস থ্রি-তে। ফুটবল নিয়ে এর আগে কখনোই কোন আগ্রহ ছিল না।
যাই হোক, আমি আর আমার বন্ধু চন্দন আমাদের গ্রাম থেকে বাজারের মধ্যে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাই। একদিন লক্ষ্য করলাম, বাজারের বেশ কিছু বাড়ির ছাদে পতপত করে এক টুকরো কাপড় উড়ছে। আমার কোনো ধারণাই ছিল না ওগুলো কি।
চন্দন আমার থেকে দুই ক্লাস ওপরে পড়ে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, 'ওগুলো মনে হয় পতাকা। দেখিস, ডিকশনারির প্রথমদিকে আছে এ রকম।'
আমার পাল্টা প্রশ্ন, 'কেন টাঙিয়েছে?' কারণ সে-ও জানে না।
তখনো বিশ্বকাপ শুরু হয়নি। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার কিংবা ফেরার পথে দেখি, পতাকার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কাল ক'টা ছিল, আজ ক'টা পতাকা হলো, কোন রংয়ের কয়টা পতাকা, কোনটা বেশি, কোনটা কম...এসব হিসাব রাখা আমাদের দুজনের প্রিয় কাজে পরিণত হলো।
আমরা খেয়াল করলাম, পতাকায় দুটো ধরন প্রাধান্য পাচ্ছে। একটা নীল আর সাদা। আরেকটা সবুজ, মাঝে চারকোণা একটা হলুদ অংশ, যার মধ্যে আবার একটা টেনিস বল। তবে সব থেকে বেশি সাদা-নীল পতাকা। এছাড়া আরও কয়েকটা আছে, কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় অনেক কম।
এক দিন খুব ভালো করে সব ক'টা পতাকা খেয়াল করে এসে ডিকশনারি বের করলাম। দেখলাম, সাদা-নীল হলো আর্জেন্টিনা আর সবুজ-হলুদটা ব্রাজিল। ততদিনে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। কাকুর ঘরে প্রতিদিন অনেক লোক আসে, এসে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখে। একদিন কাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'প্রতিদিন ফুটবল খেলা হয় কেন?' কাকু বললেন, 'ফুটবলের বিশ্বকাপ চলছে। অনেকগুলো দেশ খেলছে, এজন্য প্রতিদিন খেলা হয়।'
আমার তখন পতাকার কথা মনে পড়ল। জানতে চাইলাম, 'বাজারে দেখলাম অনেক পতাকা টাঙিয়েছে, এ জন্যই?' তিনি বললেন, 'হুম, যে যে-ই দলকে সমর্থন করে, সে সেই দলের পতাকা টাঙায়।'
পরদিন আমি চন্দনকে বললাম, 'বিশ্বকাপ হচ্ছে তাই সাপোর্টাররা নিজ নিজ দলের পতাকা টাঙিয়েছে। সাদা-নীল র্আর্জেন্টিনা আর হলুদটা ব্রাজিল।'
ও বলল, 'তাই! আর্জেন্টিনার পতাকা সবচেয়ে বেশি। তাহলে আমি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার!'
আমি বললাম, 'তুই যদি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হস, আমি তবে ব্রাজিল!'
আমরা কেউ-ই খেলা কেউ দেখি না। মানুষজন যা আলোচনা করে, তাই শুনে এসে একজন আরেকজনকে শোনাই, কার দল জিতবে। ততদিনে স্কুলও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় দুই ভাগ হয়ে গেছে। প্রতিদিন আমাদের মাঝে দারুণ আলোচনা-সমালোচনা চলে। বড়রা ফুটবল ম্যাচও খেলতে ক্লাস বাদ দিয়ে, আমরা দুই দলের সমর্থক খুব চিল্লাচিল্লি-ঝগড়া করি।
ওই বিশ্বকাপে আমি খেলা দেখেছি কেবল সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। আগে থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, 'ইশ, ব্রাজিল যদি জিতে যেত! সবাইকে কথা শোনাতে পারতাম তাহলে।' কাকু চিনিয়ে দিলেন, ন্যাড়া মাথার মাঝে চুলওয়ালা প্লেয়ারটা রোনালদো!' এমন করেই দু-একজন খেলোয়াড়কে চিনতে চিনতে ব্রাজিল জিতে গেল বিশ্বকাপ!
আমাকে আর পায় কে! সেদিন থেকে আমি ব্রাজিলের একনিষ্ঠ ভক্ত।