ক্রীড়া সাংবাদিকতা: প্রচলিত ধারণা বনাম বাস্তবতা
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
উদয় সিনা
৩ জুলাই ২০২১
বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস আজ। করোনা মহামারীর মধ্যে নানা আয়োজনে উদযাপনের তো সুযোগ নেই, এ কারণেই হয়তো এক পাঠক লেখার মাধ্যমেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে চাইলেন তাবৎ দুনিয়ার ক্রীড়া সাংবাদিকদের প্রতি। বললেন, বাইরে থেকে যতই চাকচিক্যময় মনে হোক, এই পেশাটায় কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নেই।
আরও চার-পাঁচটা পেশার মতো সাংবাদিকতাও একটি মহান পেশা। দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে ব্রতী হয়েই সবাই এই পেশায় যোগ দেন বলে আমার বিশ্বাস। কায়িক ও মানসিক শ্রম দিয়ে এগিয়ে চলেন প্রতিটি সাংবাদিক। তাঁদের এই চলার পথে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা। যুগ যুগ ধরে এসব প্রতিবন্ধকতা গ্রাস করে যাচ্ছে এই পেশায় নিযুক্ত একেকজনকে। তা সত্ত্বেও পেশাদারত্বের স্বার্থে নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে বিন্ধুমাত্র পিছপা হন না তাঁরা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকরা একটু বেশিই প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। এদেশের বিভিন্ন শাখায় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের দ্বারা বিভিন্ন সাংবাদিকের লাঞ্ছিত হবার ঘটনাও কম নয়। এদিক দিয়ে বাদ যান না ক্রীড়া সাংবাদিকরাও।
আমাদের দেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা নিয়ে একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে৷ অনেকের মতে, এটা একটা মজার পেশা, যেখানে খাটুনি কম, কিন্তু মজা বেশি। যেমন, এ পেশায় নিযুক্ত থাকলে বছর জুড়ে খেলা কাভার করার উছিলায় বিভিন্ন দেশে ঘুরাঘুরি করা যায়, খেলোয়াড়দের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়, তাঁদের সাথে ছবি-টবিও তোলা যায় ইত্যাদি। অনেকে তো আবার তাঁদের ধারণাকে জোরালো করতে বলেই ফেলেন, 'আমরা টাকার বিনিময়ে খেলা দেখি, আর ওঁরা খেলা দেখার বিনিময়ে টাকা পায়।'
এখন কথা হলো, উপভোগ করতে পারলে যেকোনো পেশাই মজার পেশা। আদতে বাইরে থেকে যতটা সহজ করে এ পেশাটাকে দেখা হচ্ছে, ততটা সহজ কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতা নয়। এ পেশাটাকে যদি নিছক পেশা হিসেবে না দেখে আপনি প্যাশন বা লাইফস্টাইল হিসেবে দেখেন, তবে আসলেই মজা আস্বাদন করার অনেক রসদ খুঁজে পাবেন। কিন্তু এখানে খাটুনি যে নেই, সেটা সম্পূর্ণ ভুল একটা ধারণা। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে ছোটাছুটি করা, টানা আট ঘণ্টা খেলা দেখে মাত্র ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে একাধিক প্রতিবেদন তৈরি করে সময়মতো অফিসে পাঠানোর যে চাপ, সেটা কেবল এ কাজে নিয়োজিতরাই ভালো বলতে পারবেন।
আর বিদেশে তাঁরা কিন্তু ঘোরার উদ্দেশ্যে যান না, নিজেদের কাজটাই করতে যান। দেশে খেলা কাভার করার চেয়ে বরং বিদেশে খেলা কাভার করা আরও বেশি কঠিন। কেননা দেশে একাধিক সহকর্মী থাকায় কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বিদেশে একা হাতেই সব সারতে হয়। মোদ্দা কথা, অন্যান্য পেশার মতোই ক্রীড়া সাংবাদিকতায়ও পরিশ্রমের বিকল্প কিছু নেই৷ তবে ব্যতিক্রম হলো এখানে বাড়তি একটা চ্যালেঞ্জ থাকে, যা বেশির ভাগ পেশায়ই অনুপস্থিত।
আগেই বলেছি, আমাদের দেশে সাংবাদিকরা একটু বেশিই প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, যার ব্যতিক্রম নন ক্রীড়া সাংবাদিকরাও। এদিক থেকে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, যাঁরা অপরাধ বিষয়ক ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন, কেবল তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা প্রযোজ্য। ক্রীড়া সাংবাদিকরা তো নির্ঝঞ্ঝাট। তাঁরা কেবল খেলা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাঁদের আবার প্রতিবন্ধকতা কীসের?
অনেকের কাছে শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও লাঞ্ছিত হওয়ার বেশ কয়েকটা ঘটনা রয়েছে। এই যেমন, ২০১৬-র অক্টোবরে শেষ হওয়া বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। সেদিন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের দেয়াল টপকে বিপুল সংখ্যক মানুষ স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েন। সেই সাথে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় টিকেট ছাড়াই টাকার বিনিময়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন অসংখ্য দর্শক। এসব অনিয়ম নিয়ে পুলিশের সাথে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজন ক্রীড়া সাংবাদিক সেদিন বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তারপর তিনি ভিডিও ফুটেজ ধারণ করতে গেলে লাঞ্ছনার শিকার হন পুলিশের।
এরও কয়েকদিন পিছিয়ে গিয়ে ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ ওয়ানডেতে নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে মেহেদী নামের একজনের মাঠে ঢুকে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে জড়িয়ে ধরার ঘটনাটি নিশ্চয়ই ভুলে যাবার কথা নয়। নিরাপত্তাব্যবস্থার গাফিলতির কারণেই মূলত তা সম্ভব হয়। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাব্যবস্থার অপর্যাপ্ততার বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে ক্রীড়া সাংবাদিক আতিফ আজমের তৈরি করা একটি প্রতিবেদন 'নিউ এজ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সে সময়। সেই রেশ ধরে ঘটনার তিন দিন পর ফতুল্লায় বিসিবি একাদশ বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচ কাভার করতে গেলে বিসিবির এক কর্মচারী নাজেহাল করেন আতিফ আজমকে। আর তিনি হলেন বিসিবির তখনকার নিরাপত্তা সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী। আতিফ আজমের প্রতি তাঁর ক্ষোভ ছিল, তিনি কেন তাঁদের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন প্রতিবেদনে!
ক্রীড়া সাংবাদিকদের ওপর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের এরূপ আচরণ বেশ আগে থেকেই হয়ে আসছে। এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারও মনে পড়ে যায় ২০০৬ সালের কথা, যেবার দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই সিরিজে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন স্টেডিয়ামের প্রবেশপথে ঘটেছিল এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
সেদিন খেলা শুরুর আগে প্রথম আলো পত্রিকার আলোকচিত্রী সাংবাদিক শামসুল হক টেংকুকে লাঠিপেটা করে পুলিশ। যতদূর মনে পড়ে, গাড়ি পার্কিং নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। শামসুল হককে বহন করা স্টেডিয়ামের পার্কিং এরিয়ায় তাঁকে নামিয়ে দিতে গেলে বাধা দেয় পুলিশ। শামসুল হকের কাছে গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় প্রবেশ করার বৈধ ছাড়পত্র থাকলেও পুলিশ তা না মেনে এক সময় তাঁকে বেআইনিভাবে আঘাত করে। পরে স্টেডিয়ামে অবস্থান করা বাংলাদেশি সাংবাদিকরা মাঠে গোল হয়ে বসে এর প্রতিবাদ জানান। লাঞ্চের সময় দায়ী পুলিশ সদস্যদের ক্ষমা চাইবার দাবিতে সাংবাদিকেরা প্রেসবক্স থেকে নেমে মাঠের পাশে নেমে যান। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে পুলিশ সাংবাদিকদের নির্বিচারে মারধোর শুরু করে। এমনকি ৬৫ বছর বয়সী আলোকচিত্রী সাংবাদিক আলহাজ্ব মোহাম্মদ জহিরুল হকও এ থেকে রক্ষা পাননি। সাংবাদিকেরা আত্মরক্ষা করতে দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা এই দৃশ্য দেখে রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। পরে এই ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ওই চট্টগ্রাম টেস্ট আর কাভার করেননি।
এভাবেই বছরের পর বছর লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আসছেন বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকরা। কিন্তু তাঁদের বিপক্ষে এই অবিচারের বিচার মেলে না বললেই চলে। তবুও সকল প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে করেই সম্মুখে পা বাড়ান তাঁরা। এই এগিয়ে যাওয়া কেবল পেটের দায়ে নয়। এই এগিয়ে যাওয়া দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি নিজেদের কর্তব্যবোধ থেকেও।
আজ বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। আজকের এই দিনে একজন ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই আমার দেশের সকল ক্রীড়া সাংবাদিকের প্রতি যাঁদেরকে কোনো বাধাই তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে টলাতে পারে না। মাঠের সীমানার বাইরে থেকেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁদের যে অনেক অবদান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সামনে হয়তো পূর্বের ন্যায় আরও বাধা-বিপত্তি আসবে। কিন্তু বরাবরের মতো তাঁরা ঠিকই সেগুলোকে পেছনে ঠেলে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন বলে বিশ্বাস আমার।
সেই সাথে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বিদেশি ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও। ব্যাট হাতে, বল হাতে ও পায়ে মাঠে খেলোয়াড়রা খেলেন বলে এবং কলম ও বুম হাতে আপনারা প্রতিবেদন তৈরি করেন বলেই ক্রীড়াজগৎ এতটা সুন্দর।