একটা বাঁ পা কিংবা টিভি প্রোমোর প্রেমে পাওয়া সর্বনাশ

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

আবু সুফিয়ান

২৮ জুন ২০২১

একটা বাঁ পা কিংবা টিভি প্রোমোর প্রেমে পাওয়া সর্বনাশ

রাউলের কারণেই রিয়াল-প্রেম। আর ‌‘প্রেম’ সে তো যন্ত্রণারও। রাউলের টানে রিয়াল মাদ্রিদের প্রেমে পড়ে সে যন্ত্রণার কথাই লিখেছেন এই পাঠক। লেখা তো নয়, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া নিটোল গদ্য। পাঠক না বলে তাই লেখকই বলা উচিত।

সন্দেহ নেই, শটটা দারুণ ছিল। ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া এক ভলি গোলা হয়ে ঢুকল পোস্টের দুরূহ কোণ দিয়ে। বের হওয়ার পথ না পেয়ে সেটা ছিড়ে নিতে চাইছে জাল—এমনই এক মুহূর্ত। গোল করেই উদযাপনে ছুটলেন ফুটবলার। স্কুলের ফার্স্ট বেঞ্চের কোণায় বসা ছাত্রের মতো এক মুখ। সে মুখ আড়াল হয়ে গেল একটু পরই। অনামিকায় সেটে থাকা ভালোবাসার চিহ্নে চুম্বন বসাতে বসাতে তিনি ছুটলেন। ঠায় পড়ে রইলাম আমি। 

২০০০ ইউরোর প্রোমোটা বেশ জম্পেশ বানিয়েছিল টেরিস্টোরিয়াল সম্প্রচারের অধিকার পাওয়া চ্যানেলটি। তারই এক ঝলক ছিল ওই মুহূর্ত। গোলার মতো এক ভলি আমাকে এক স্প্যানিয়ার্ডের প্রেমে ফেলল। সে ইউরোয় কিচ্ছু করতে পারেননি, উল্টো দলকে ডুবিয়ে পেনাল্টি মিস করেছেন। তবু রাউল গঞ্জালেস নামটা স্থায়ী হয়ে গেল মনে।

রাউলের চিরচেনা উদযাপন।

এমনই আরেক নাম সার্জিও রামোস। মাঠে নিজের সবটুকু দিয়ে খেলেন, গোলের পর বুনো উল্লাস করেন, হারলে ক্রোধের কথা জানাতেও কখনো ভোলেন না। কিন্তু হার মেনে নিতে দেখা যায়নি কখনো। সে মানুষটিই যখন সবার সামনে চোখ মুছতে লাগলেন, তখন রাগটা রাউলের ওপরই বেশি হলো।

নিজেকে যে মাঝে মাঝে প্রতাপের মতো মনে হয়, এর জন্য দায়ীও তো ওই রাউলই।

এখন তো আবার প্রতাপ কে—সে ব্যাখ্যায় যেতে হয়!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসগুলোর কোনো একক নায়ক নেই। মূল কয়েকটি চরিত্রের ওপর ভর করে উপমহাদেশের ইতিহাসের চুম্বক অংশ বলার সময় নায়কের নাম নেওয়ার সুযোগও থাকে না। প্রতাপ সেসব চরিত্রের মধ্যেও পড়েন না। তবু পূর্ব-পশ্চিম বইয়ের কথা মাথায় এলে কেন যেন ট্রেনের প্রতাপকেই মনে আসে।

বউ-ছেলে নিয়ে বেড়াতে বের হওয়া প্রতাপ ট্রেনে সিট পেয়েও দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড় হয়েও সন্তানদের সে সুখের ছিটেফোঁটা দিতে পারছেন না, চড়তে হচ্ছে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে। জাত্যাভিমানী প্রতাপের খুব লেগেছিল। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অক্ষমতার দায় মেটাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতাপের অভিমানে চোখ বোজার মুহুর্তটা গত কদিনে বারবার ফিরে এসেছে।

সর্বনাশের সূচনাটা রাউলকে দিয়ে। তাঁর টানেই কখনো খেলা না দেখা এক দল রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থক বনে যাওয়া। তারা কার দল, খেলে কেমন, জার্সির রং কী, কিছু জেতে-টেতে নাকি শুধু মনই জেতে—কিচ্ছু না জেনেই ভালোবাসা পেয়ে বসল দলটি। কারণ? ওই যে রাউল খেলেন ওই দলে। যে দলকে তাঁর কারণে "রাউল মাদ্রিদ" ডাকা হয়, সে দল আমারও দল।

ছুটছেন রাউল।

এর মধ্যেই যোগ দিলেন ফিগো, আগ থেকেই ছিলেন ‌‘সন্ত’ ইকার ক্যাসিয়াস, গুতি আর কার্লোস, তাদের ছায়া দেন হিয়েরো। ’৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে হারানোর কারণে আমার নায়ক বনে যাওয়া জিদানও বাদ থাকলেন না। আর এঁদের সবার মধ্যমনি ‌‘এল কাপিতান’ রাউল।

‌‘বখে যাওয়া’র ভয়ে বাসায় ডিশ নেওয়া হয় না। মাদ্রিদের খোঁজ খবর নিতে তাই পত্রিকাই ভরসা। সেখানেই রিয়ালের ম্যাচ স্পষ্ট ধরা দিত চোখে। ফিগোর উইং দিয়ে ছোটা, জিদানের মাঝমাঠ দখল করা, কার্লোসের গোলা আর অবশ্যই রাউলের ফ্লিক—সব জীবন্ত হয়ে উঠত। পরতের পর পরত পড়ে, ভালোবাসা গাঢ় হয় আরও।

রাউলের সেরা সময়টা সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর থিতু হওয়া পর্যন্ত ক্লাবে ছিলেন কিন্তু রোনালদো নাজারিও ক্লাব ছাড়ার আগেই নিজের চূড়া অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে তাঁর ছায়া হয়ে থাকা কিংবা ২৯ পেরোনোর ওই সময়েই জাতীয় দলের অধ্যায় থেমে যাওয়া সেটারই প্রমাণ। রিয়ালের জার্সিতে আমার দেখা রাউল তাই প্রদীপের শেষ আলো। দপ করে নিভে যাওয়ার আগে আরেকবার জানান দিতে ব্যস্ত থাকা। তবু কত ভালোবাসা নিয়েই তাঁর প্রতিটি স্পর্শের স্বাদ নিতাম তারিয়ে তারিয়ে।

ভালোবাসার শুরু রাউলকে দিয়ে, ধাক্কার শুরুটাও। যাঁর কারণে রাউল মাদ্রিদ ডাকা হতো, সেই রাউল একদিন মাদ্রিদ ছেড়ে দিলেন। একসময় দলে রোনালদো, মরিয়েন্তেস, ওয়েনদের ছায়ায় রাখা ‌‘নাম্বার সেভেন’ আচমকা ক্লাবের বোঝা হয়ে উঠলেন। চোটাঘাতে ক্লান্ত রাউলের বিদায়টা তবু মুখে বিস্বাদ এনে দেয়নি। রিয়ালে আজীবন তাঁকে দেখার স্বপ্নটা ভেঙে যাওয়ার দুঃখটাই ছিল বেশি।

সে দুঃখ একেবারে ক্রোধ হয়ে উঠল ‌‘সন্তে’র বেলায়। ভালোবাসা প্রাপ্তির দিক থেকে রাউলের চেয়ে এগিয়েছিলেন অনেকের কাছেই। কিশোর বয়সে রিয়ালকে বইতে বইতে চওড়া হয়ে ওঠা কাঁধটা ক্লাবকে টেনেছে ১৫ বছর। সেই ইকারকেই চোখের জলে ভাসাল ক্লাব। বলা ভালো ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। যার অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দলকে বারবার বাঁচিয়ে দিত, যার সেভ দেখে সেইন্ট নামে ডাকতে হতো, সেই ইকার বহুদিন আগেই হারিয়ে গেছেন, তাঁর দেখা রাউলের বিদায়ের পর খুব কমই পাওয়া গেছে। তবু ক্লাব কিংবদন্তিকে এভাবে দরজা দেখিয়ে দেওয়া, সংবাদ সম্মেলনে ওভাবে ইকারের চোখ মোছা মানতে পারেননি কেউ। ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কের জন্ম দিলেন পেরেজ।

সমর্থকের অক্ষমতার প্রকৃত রূপ সেদিনই টের পাওয়া গিয়েছিল। ইকারের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে প্রতাপের মতোই অভিমান দেখানো হলো, সাদা জার্সির ম্যাচ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টাও চলল। কিন্তু ভালোবাসার শেকড় যে অতি গভীরে পোতা। যে কারণে ওভাবে বিদায় নিয়েও রামোস-ক্রিস্টিয়ানোদের প্রতি ম্যাচে উৎসাহ দেন ক্যাসিয়াস। ফিরতেই হলো, শাস্তিও জুটল।

এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি

ন্যাড়া বেলতলায় কয়বার গিয়েছিল জানা নেই, তবে রিয়াল সমর্থকদের বারবার মাথা ফাটানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। পেরেজের গোয়ার্তুমির সঙ্গে না পেরে চুপচাপ সরে যেতে হলো জিনেদিন জিদানকে। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তির বিদায়ের ধাক্কাটা সামলানোর সুযোগ মিলেনি, তার আগেই বিদায় ক্রিস্টিয়ানোর। ক্লাবের সর্বকালের সেরা গোলদাতার বিদায়ের পেছনেও সেই পেরেজ। আরও একবার রিয়াল সমর্থকেরা নিজের অসহায়ত্ব টের পেলেন। অভিমান ক্রোধে বদলালো, অনেক হুঙ্কার ছোড়া হলো। কিন্তু সবই ফাঁপা, ভ্রুকুটিও করতে হলো না পেরেজকে।

সে গল্পেরই আরেক অধ্যায় পড়তে হলো গত কয়েকদিন। ক্লাব কিংবদন্তিদের হেলায় হারানোর দুঃখটা আবারও পাথর হয়ে বসল বুকে। প্রথমে ওই জিদান বিদায় নিলেন, এবার অতটা চুপিসারে নয়। তাঁর দুঃখ-হতাশা ক্রোধ বাড়াল, সেটা অগ্ন্যুৎপাতে রূপ দিয়ে চোখ মুছলেন রামোস। ১৬ বছরের প্রতিটা মূহূর্ত যে ক্লাবকে দিয়েছেন, যাদের জন্য শেষ বিন্দু দিয়ে লড়েছেন,  ‌‘মেয়াদ চলে যাওয়া’-র অজুহাত শুনিয়ে সে ক্লাবই তাঁকে বিদায় দিয়ে দিল। কত অনায়াসে, অবলীলায়। ৯২.৪৮-এর গল্প লেখা মানুষটা অতীত হয়ে গেলেন!

অভিমানে চোখ বোজা ছাড়া আর কীই-বা করার থাকে আমাদের? রাউল যে আর কোনো পথ খোলা রাখেননি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×