এশিয়া কাপ ফুটবল ও কিছু ভাবনা
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
সুবাইল বিন আলম
২৭ জুন ২০২১
ইউরোর দর্শক আমরা। কোপা আমেরিকারও। টিভিতে খেলা দেখে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা লিওনেল মেসির জন্য গলা ফাটাই আমরা। কিন্তু এশিয়া কাপ ফুটবলে জামাল-মামুনুলদের জন্য চিৎকার করার সুযোগ নেই। এবার এশিয়া কাপের সরাসরি বাছাইয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। যেটিকে সামনে রেখে চূড়ান্ত পর্বেও দলকে দেখার স্বপ্ন দেখছেন লেখক। এটা কী আদৌ সম্ভব? ‘সম্ভব’ বলেই থেমে থাকেননি, কীভাবে সম্ভব--বাফুফে, ক্লাব এবং খেলোয়াড়দের জন্য দিয়েছেন একটা রূপরেখাও।
চারিদিকে ফুটবল। ইউরোপ জুড়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ। দক্ষিণ আমেরিকায় কোপা আমেরিকা। ফুটবলের এই ডামাডোলের মধ্যেই সুখবরও পেয়েছি আমরা—এশিয়া কাপের সরাসরি বাছাইয়ে খেলবে বাংলাদেশ। করোনার কারণে উত্তর কোরিয়া বিশ্বকাপ বাছাই থেকে নাম প্রত্যাহার করাতেই এই ভাগ্য খুলে যাওয়া! এটা অবশ্যই খুশির খবর, কিন্তু চারদিকের ফুটবল দেখে আফসোস—এশিয়া কাপে দেশের জন্য আমরাও যদি গলা ফাটাতে পারতাম!
মাত্র তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড এখন ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি। এবারের ইউরোর চূড়ান্ত পর্বে না খেললেও ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে তারা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গ্রুপপর্বের শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে খেলেছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও। আর ১৮ কোটির দেশ হয়েও আমরা কিছু করতে পারি না! আমাদের র্যাঙ্কিং ২০০-এর আশেপাশে।
দলীয় খেলা ফুটবল। এখানে উন্নতির জন্যও দরকার সমন্বিত চেষ্টা। ফেডারেশন চেষ্টা করলেই একজনকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তৈরি করতে পারবে না। আবার ক্লাব না দেখলেও ‘রোনালদো’ তৈরি হবে না। এখানে ফুটবলারদের সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতাও দরকার। ফেডারেশন আর ক্লাব যার যার জায়গা থেকে নিজেদের কাজটা করলেও কেউ ‘বড়’ খেলোয়াড় হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে ‘বড়’ ফুটবলার হতে চায়। আরাম-আয়েশ ফেলে যতক্ষণ না ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেছে নেয়। রোনালদোর দিকেই তাকিয়ে দেখুন না, কী হাড়ভাঙা পরিশ্রমই না করেন তিনি! তাই উন্নতির জন্য চাই—সব পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা। সমন্বিত সে প্রচেষ্টা না থাকলে এশিয়া কাপের বাছাইয়েই দৌড় শেষ হবে আমাদের। এশিয়ান কাপে জাতীয় দলের জন্য কখনোই আমাদের গলা ফাটানো হবে না!
এশীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলার আকাঙ্খার কোনো কমতি নেই আমাদের। কিন্তু এই আকাঙ্খার চেয়ে বেশি দরকার পরিকল্পনা। শর্ট টার্ম আর লং টার্ম—দুই রকম পরিকল্পনা-ই করা যেতে পারে। এশিয়া কাপের সরাসরি বাছাই পর্বে যেহেতু খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ এবং সে বাছাই পর্ব যেহেতু সামনে, তাই ‘শর্ট টার্ম’ পরিকল্পনা নিয়েই আপাতত আলোচনা করা যেতে পারে।
ফুটবল ফেডারেশনের করণীয়
বাছাই পর্বে দলের যে পারফরম্যান্স তাতে একটা ব্যাপার খুবই স্পষ্ট--আমাদের দেশে কোয়ালিটি খেলোয়াড়ের বড় অভাব। যারা আছে, তাদের বেসিকেই বড় ঘাটতি! জাতীয় দলের সর্বশেষ দুই ম্যাচ দেখে টেরই পাওয়া যায়নি দলে ফরোয়ার্ড বলে কোনো কিছু আছে! ঘরোয়া লিগে আমরা যাদের দুরন্ত গতির খেলোয়াড় মনে করি, আন্তর্জাতিক ম্যাচে তারাই প্রতিপক্ষের সামনে হয়ে পড়ে মাঝারি গতির। শারীরিকভাবেও তারা এত দুর্বল যে, মাঠে কমান্ড নিতে পারে না। হেডে তারা বল পায় না। সব থেকে বড় সমস্যা, আমাদের খেলোয়াড়েরা পর পর তিনটা পাস দিতে পারে না।
এত সব ঘাটতি রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত খেলে আসা এশিয়া কাপ বাছাইয়ে দলের সেরা খেলোয়াড় বলতে জামাল ভুইয়া আর তারিক রাইহান। দুই জনের কেউই বাংলাদেশের ফুটবল সিস্টেম থেকে বের হননি। তাঁরা বেড়ে উঠেছেন ফুটবলে উন্নত দেশে। এলিটাও বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য তেরি। সামনে আরও কয়েকজন আফ্রিকান খেলোয়াড় বাংলাদেশের হয়ে খেলার মতো যোগ্য হবে। বাফুফের উচিত, এখনই তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেওয়া। প্রবাসী আরও যারা লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, স্কাউটিং করে তাদের নিয়ে আসা। আরও ৪/৫ জনকে যদি জাতীয় দলে না ঢোকানো যায়, তাহলে ভালো কিছুর আশা ‘আশা’-ই থেকে যাবে।
কোচ তাঁর চাহিদা জানিয়ে দিয়েছেন। বাফুফে আগের তুলনায় এখন অনেক স্মার্ট। বিদেশি কোচের সহকারী হিসেবে বিদেশিদের নিয়োগ দিয়েছে। এটা ভালো দিক। তবে কোচের কাছেও এখন বাফুফের চাহিদা থাকা উচিত। লিগের খেলা দেখে জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করতে হবে কোচকে। কে কেমন খেলে, সেটা শুনে কিংবা মৌসুমে কার কী পারফরম্যান্স, সেই রেকর্ড দেখে নয়, খেলোয়াড়ের খেলা দেখে তবেই কোচ জাতীয় দলে ডাকবেন তাঁকে। বাফুফেরও উচিত, কোচকে স্বাধীনভাবে খেলোয়াড় বাছাই করতে দেয়া।
জাতীয় দলের ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে’র আর একটা কাজ হওয়া উচিত, লিগের সব দলের কোচের সঙ্গে বসে তাদের কাছে তাঁর চাহিদাটা জানিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে ক্লাবের কোচদেরও কোনো পরামর্শ থাকতে পারে, যা শক্তিশালী জাতীয় দলে গঠনে সহায়ক হতে পারে। কেননা ক্লাবের কোচরাই তো জেমির চেয়ে খেলোয়াড়দের নাড়ি-নক্ষত্র বেশি জানবেন।
বাফুফের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মাঠের যথাযথ পরিচর্যা করা। যে কাজটাকে কোনো সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দেশের মাঠগুলোর কোনোটাই মানসম্মত নয়। বর্ষার সময়ে কর্দমাক্ত, শুকনো মৌসুমে জায়গায় জায়গায় ঘাস ছাড়া! কিন্তু যে সব দেশ ফুটবলের পরাশক্তি, সেখানে এমন মাঠের কথা ভাবাই যায় না। কয়েক দিন আগে বায়ার্নের একটা রিপোর্ট দেখলাম। বছর বছর মাঠের ঘাস কী রকম বদল হচ্ছে, আর তাতে খেলাটার ওপর কী প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে। মাঠ নিয়ে ওরা যখন এত সচেতন, তখন আমাদের তো এটা বোঝা উচিত—দিনের পর দিন একই মাঠে খেলা হলে, সে মাঠটা ভালো থাকে না!
আমাদের জাতীয় দলে যেহেতু স্ট্রাইকার নাই আর ডিফেন্সিভ খেলেই যেতে হবে, তাই কীভাবে সেট পিসে ভালো করা যায়, সেদিকে ফোকাস দেয়া উচিত কোচের। ম্যাচে যে হাতে গোনা সুযোগ আসে, সেগুলোর সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তা নিয়েও কাজ করা উচিত জেমি ডের।
বাফুফের উচিত, সব খেলোয়াড়দের জন্য একটা ডেইলি ফিটনেস রুটিন করা, আর তাদের ফুড চার্ট দিয়ে দেয়া। ক্লাবে কিংবা বাসায়, তারা যখন যেখানেই থাকুক না কেন, বাধ্যতামুলকভাবে সেটা মেনে চলতে হবে। যে সব ক্লাবে জিম করার সুবিধা আছে, প্রয়োজনে সেসবকে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের জন্যও কাজে লাগানো যেতে পারে। যেখানে একজন স্থানীয় ট্রেনার খেলোয়াড়দের দেখাশোনা করবে। একজন মনোবিদকেও এক বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া দরকার। যাতে খেলোয়াড়রা তাঁদের যে কোনো সমস্যায় তাঁর শরণ নিতে পারেন। খেলোয়াড়দের ডায়েট কী হবে সেটা অবশ্যই ঠিক করবেন নিউট্রশনিস্ট। স্কিলের সাথে শারীরিক আর মানসিক দুটোরই সংযোগ দরকার। এসব এখনই যদি শুরু করা যায় ছয় মাস পর ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আশা করা যেতেই পারে।
আমাদের লিগে খেলা অনেক কম। তাই জাতীয় দলের অনুশীলন শুরু হলে খেলোয়াড়দের সবকিছু নতুন করে শুরু করা লাগে। এটা মাথায় রেখে বাফুফের উচিত, সব সময় মাঠে খেলা রাখা। যে সময়ে খেলা থাকবে না, সেই সময় ফুটবলারদের নিয়ে যেন ক্যাম্প করা হয়।
ক্লাবের করণীয়
শর্ট টার্ম পরিকল্পনায় আসলে ক্লাবের করনীয় খুবই কম। তাদের উচিত কোচিং সেট আপ নিশ্চিত করা। সব দলের যেন ট্রেনার, ফিজিও আর গোলকিপার কোচ থাকে। ফিটনেসের সাথে সাথে নিউট্রশনিস্ট দিয়ে ফুড হ্যাবিট, জিম, রেগুলার ট্রেনিং আর মনোবিদ দিয়ে কনফিডেন্স বাড়ানো। জাতীয় দলের কোচের প্ল্যানিং এর মতো খেলোয়াড়দের তাদের পজিশনে খেলানো, আর জাতীয় দলের প্লেয়াররা যেন প্লে টাইম পায়, সেটা নিশ্চিত করা। আর একটা কাজ করতে পারে ক্লাবগুলো-- প্রবাসী খেলোয়াড়দের স্কাউটিং করে যদি পারা যায় খুঁজে নিয়ে আসা।
খেলোয়াড়দের করণীয়
এখনকার এই করোনার সময়ে আসলে খেলোয়াড়দেরই নিজে থেকে অনেক কিছু করতে হবে। রেগুলার ফিটনেস ট্রেনিং, বাসায় থাকলে যতটুকু সম্ভব স্কিল ট্রেনিং, জিম, মনোবিদের সাহায্য নেয়া, রেগুলার নিউট্রশনিস্টের সাহায্য নেয়া--কত কি? ভার্চুয়াল লাইফে অযথা সময় নষ্ট না করে ভিডিও দেখে স্কিল বাড়ানো যায়। বই পড়েও ফুটবল নিয়ে জানার অনেক কিছু আছে। এটা খেলোয়াড়ি পেশাদারিত্বের মধ্যেই পড়ে। মনোযোগের অভাবে জাহিদের মতো প্রতিভাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু পরিশ্রম দিয়েও টিকে আছে অনেকেই। এখানে সাবেক ফুটবলার আমিনুল হককে টেনে আনা যেতে পারে। ইনজুরি থেকে মাঠে ফিরে কী পরিশ্রমটাই না করতেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমের করণীয়
সংবাদমাধ্যমেরও করনীয় আছে শুনে অবাক হচ্ছেন? বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ে সাংবাদিকতা আসলেই অনেক পিছিয়ে আছে। ফুটবল নিয়ে রিপোর্টিং মানে শুধু ম্যাচ রিপোর্ট না। সাপ্তাহিক এনালাইসিস, ম্যাচ ডে এনালাইসিস, অনেক কিছুই আছে। আমরা সেখানে বেশ পিছিয়ে। একটা-দুটো ম্যাচে ১০/১৫ মিনিট ভালো খেললেই একটা হাইপ উঠিয়ে দেয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের ফুটবল অনেক অনেক পিছিয়ে। বাস্তবতার জমিনে পা রেখেই এগোতে হবে আমাদের।
ফুটবলের উন্নতির জন্য, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য খরচের একটা ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু তারও আগে দরকার, ফুটবল ফেডারেশন, ক্লাব বা খেলোয়াড়দের নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে ‘আমরা পারব’, ‘আমরা এশিয়া কাপ খেলব’। ২৪ দেশের মধ্যে ১২টা দেশে আসা কি খুব কঠিন? কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। অন্তত এক বছর ঠিক মতো চেষ্টা করে তো দেখা যেতে পারে। অন্য দেশের খেলা আর বাংলাদেশের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই বলছি, ১৯৯৬ সালেও ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে আমরা ১১০-এ ছিলাম। সেই দলের থেকে বর্তমান দলের খেলোয়াড়রা তো অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। বাফুফে থেকে, ক্লাব থেকেও। তারপরও কেন বার বার হতাশ হতে হবে আমাদের?
বাফুফে, ক্লাব, ফুটবলার—সব পক্ষই এক সঙ্গে একবার চেষ্টা করে দেখুক না, দিন বদলের সূচনা হয় কিনা! সে চেষ্টা হোক আন্তরিক।