চলিতেছে সার্কাস…
হাসান উজ জামান
৩০ মে ২০২১
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবারের সিরিজ জয়ের মধ্যেও কাঁটা হয়ে আছে কিছু প্রশ্ন। বিসিবির কর্মকাণ্ড ও নির্বাচকদের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র আপত্তির কথা জানিয়ে এক পাঠকের এই লেখা।
প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কাকে ওয়ানডে সিরিজে হারানোর স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারপরও সমর্থকদের মধ্যে যেন সেই আনন্দটা দেখা যাচ্ছে না। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচক কমিটি ও টিম ম্যানেজমেন্টের মুন্ডুপাত চলছে সমান তালে। আজ হোক কাল হোক, সমর্থকদের এমন প্রতিক্রিয়া যে ভবিতব্যই ছিল, তা বোধ করি অনেকেই অনুমান করেছিলেন।
সমর্থকদের সব সময় সিরিয়াসলি নেয়া চলে না, এটি আমিও মানি। মাঝে মাঝে তারা এমন সব ‘অযৌক্তিক’ কথা বলেন, তাতে তাদের মাথায় `মস্তিষ্ক' নামক বস্তুটি আছে কিনা সে সন্দেহও জাগতে পারে। এখন তো আবার এক শ্রেণীর উগ্র সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। যারা কিনা অন্যের ব্যর্থতা উদযাপন করে বিকৃত আনন্দ লাভ করে। লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের আশায় তারা মনে-প্রাণে লিটন-সৌম্য-মিঠুন-শান্তর ব্যর্থতা কামনা করে। এদের কেউ ব্যর্থ হওয়া মাত্রই ফেসবুক নিম্ন রুচির মিমসের জোয়ারে ভেসে যায়!
সমস্যা কি শুধু সমর্থকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ? ক্রিকেটার, নির্বাচক, বিসিবি--সবার মধ্যেই ছন্নছাড়া একটি ভাব কি চলে আসেনি? আমাদের নির্বাচক কমিটি বহুদিন ধরেই যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের অদ্ভুত সব কর্মকান্ড নিয়ে বলার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। জবাবদিহিতা তো নেই-ই। প্রিয় উৎপল শুভ্রের কাছে পাঠকদের দাবি ছিল, উনি যেন নির্বাচকদের নিয়ে কিছু লিখেন। অবশেষে ‘নাঈমকে না খেলালে অন্যায় হবে, খেলালেও!’ শিরোনামে উৎপল শুভ্র নির্বাচকদের নিয়ে লিখেছেন। এই লেখার জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন অনুসারী হিসেবে আমি আরও দুই-একটি কথা যোগ করার তাগিদ অনুভব করছি।
বাংলাদেশের আর আট-দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো বিসিবিও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। বিসিবি বস নাজমুল হাসান পাপনকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বিসিবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার সফলতা কি? উনি এক নিঃশ্বাসে ২০১৫ বিশ্বকাপ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, ঘরের মাটিতে পাকিস্তান-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা বধের গল্প শুনিয়ে যাবেন। তাই নয় কি? কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সফলতার ক্রেডিট নিতে উনি যতটা আগ্রহী, ব্যর্থতার দায়ভার নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়।
ক্রিকেট দল সফল হলে, বিসিবি বস মিডিয়ার সামনে এসে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। কিন্তু যেই না ক্রিকেট দল ব্যর্থ হয়, তখন নিজের পিঠ বাঁচিয়ে মিডিয়ার সামনে উনি এক-একজন প্লেয়ার ধরে ধরে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। চলতি সিরিজের প্রথম ম্যাচের মাঝপথে উনি যেভাবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সমালোচনা করেছেন, তা এক ইতিহাসই বটে!
নাজমুল হাসান সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেন, তিনি খেলোয়াড়বান্ধব প্রেসিডেন্ট। প্রায় সব ক্রিকেটারের সাথে ওনার নিয়মিত যোগাযোগ। তাঁদের ভালো-মন্দ দেখার ‘মহৎ’ কাজটি উনি নিজ থেকেই করে থাকেন। বেরসিক কেউ যদি এখন প্রশ্ন করে বসেন, ‘প্লেয়ারদের সাথে আপনার এত ভালো যোগাযোগ, তাদের জন্য এত কিছু করেন, তবে তাঁদের ভুল গোপনে ধরিয়ে না দিয়ে, মিডিয়ার সামনে এসে কেন বলেন? পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিজের পক্ষে আনার জন্য? মিডিয়ার সামনে আপনার এমন বক্তব্য ক্রিকেটারদের যে আরও প্রেসারে ফেলে দেয় সেটা কি আপনি বোঝেন না?’ বিসিবি বস উত্তরে কী বলবেন, তা আমার জানা নাই।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বেঁচে আছে বয়সভিত্তিক দলগুলোর কারণে। আঞ্চলিক ক্রিকেট, ঘরোয়া ক্রিকেটের কী অবস্থা, সেই খবর কি বিসিবি বস রাখেন? টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ২০ বছর পরেও টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন ময়দানে আমরা এখনো কেন হাঁটতে শিখলাম না? এই প্রশ্নের উত্তর কি বিসিবি বসের জানা আছে? গুটি কয়েক ওয়ানডে ম্যাচের সফলতা নিয়েই এত নাচানাচি!
এখন আসি আকরাম খান প্রসঙ্গে। আকরাম প্লেয়ার হিসেবে কেমন ছিলেন, সেটি আমার আলোচ্য বিষয় না। কিন্তু সাকিবের আইপিএল খেলা ইস্যুতে উনি যে অন্যায়টা করেছেন, সে অন্যায়ের জন্য উনি কি ক্ষমা চেয়েছেন? টেস্ট খেলা বাদ দিয়ে সাকিবের আইপিএল খেলতে যাওয়া ব্যক্তিগতভাবে আমিও পছন্দ করিনি। টি-২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কারণে আইপিএল খেলতে হবে- সাকিবের এমন যুক্তিও আমার কাছে বালখিল্য মনে হয়েছে। আকরামেরও তেমনটা মনে হতে পারে। সাকিবের ওপর রাগ কিংবা বিরক্তিও আসতে পারে। তাই বলে টি-২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কথা সাকিব যে বিসিবিকে পাঠানো তার চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, সেটি আকরাম মিডিয়ার সামনে বলবেন না? এক আকরামের কারণে সাকিব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত গালিগালাজ খেয়েছেন, সে দায় কার?
আকরাম চিঠি পড়েননি বলে সাকিব যে দাবি করেছিলেন, সেটি তো সাকিবের অন্যায় কোন দাবি ছিল না। আকরাম যদি আসলেই চিঠিটি পড়ে থাকেন, তাহলে তিনি সাকিবের টি-২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কথা মিডিয়ার সামনে কেন বলেন নাই?
কোন যুক্তির ধার না ধেরে, সাকিব ‘বেয়াদব’, ‘সাকিব কীভাবে এক্স-প্লেয়ারদের নিয়ে কথা বলে’-এই সব গদ্গদ আবেগের কথা দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার কালচার আমাদের দেশে শেষ হবে কবে? সাকিবকে যুক্তি দিয়ে কাউন্টার দেয়ার সাহস তো কেউই দেখাতে পারেননি।
নির্বাচক কমিটির নয়-ছয় নিয়ে উৎপল শুভ্র যথেষ্ট সুন্দর করে লিখেছেন। আমি শুধু নির্বাচকদের নিয়ে দুটি কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
১.
ইমরুল কায়েসকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য ২৫ জনের প্রাথমিক দলে রাখা হয়েছিল। পরে তাঁকে প্রাথমিক দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। ইমরুল কায়েস গত দুই বছরে এমন কোন হাতি-ঘোড়া মারার কাজ করেননি। আমার প্রশ্নটি অন্য জায়গায়। নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু মিডিয়ার সামনে বলেছেন, ইমরুল মিডল অর্ডারের জন্য কখনোই তাদের বিবেচনায় ছিলেন না। ঠিক, না থাকাটাই স্বাভাবিক। ১ নম্বরে তামিম, ২ নম্বরে লিটন/ সৌম্য, ৩ নম্বরে সাকিব, ৪ নম্বরে মুশফিক… এই তো ছিল তাঁদের পরিকল্পনা? তাহলে কোন বিবেচনায় কোন পজিশনের জন্য ইমরুলকে দলে ডাকা হয়েছিল? টপ অর্ডার বলতে আমরা এই তো বুঝি।
যদি লিটন/ সৌম্যের জায়গায় তৃতীয় বিকল্প হিসেবে ইমরুলকে ভাবা হয়, তাহলে আবার নাঈম শেখকে হঠাৎ দলে যুক্ত করা হলো কেন?
নির্বাচকদের এমন কর্মকান্ড দেখে আমি যদি দাবি করি, যেকোনো ভাবে ২৫ জনের নাম দিতে হবে, এ জন্যই দায়সারা ভাবে ইমরুলের নামটি যুক্ত করা হয়েছিল। তাহলে আমাকে কি কেউ দোষ দেবেন?
২.
মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পালা বদলের নায়কের বিদায় যে এমন বাজেভাবে হলো, এর দায় নান্নু-বাশারকে সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। এ নিয়ে বিস্তারিত এখানে লিখতে চাইছি না। কিন্তু মাশরাফি একাধিক সাক্ষাৎকারে নান্নু-বাশারকে স্পষ্ট ভাষায় ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন। প্রিয় পাঠক, ভুল পড়েননি। মাশরাফির মতো বিচক্ষণ, বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একদম ঠাণ্ডা মাথায় নান্নু-বাশারকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। নান্নু বা বাশারের কাছ থেকে আমরা এর কোনো প্রতিবাদের কথা শুনিনি। এ থেকে তাহলে আমরা কী বুঝে নেব?