গল্পটা জিদানের র‍য়্যাল মাদ্রিদের

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

রাইসান কবির

২৭ মে ২০২১

গল্পটা জিদানের র‍য়্যাল মাদ্রিদের

জিনেদিন জিদান ছিলেন বলেই...। `ছিলেন` দুই অর্থেই। ছবি: টুইটার

ভাঙাচোরা একটা দল নিয়েও মৌসুম জুড়ে লড়াই চালিয়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদ। ট্রফিশূন্য মৌসুমেও এক রিয়াল সমর্থক এ থেকেই সান্ত্বনা খুঁজে স্বপ্ন দেখছেন সুন্দর আগামীর।

রাজকীয় আর আভিজাত্য শব্দদ্বয় যেন খুব করে যায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের সাথে। ক্লাবটার ইতিহাসেই যেন মিশে আছে রাজকীয়তা। আভিজাত্যে ভরপুর ক্লাবটার ট্রফি-কেসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কতটা সাফল্যমণ্ডিত তারা। 

এই রিয়াল মাদ্রিদের এবারের মৌসুমটা শেষ হয়েছে ট্রফিশূন্য থেকেই। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ের পর লা লিগা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে একদম শেষ ম্যাচ ডেতে এসে। তবে ট্রফিশূন্য হওয়া সত্ত্বেও এবারের মৌসুমটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেন? চলুন, সেটাই বিশ্লেষণ করা যাক। 

মৌসুমের শুরুতে নতুন কাউকেই সাইন করায়নি রিয়াল। নতুন সংযোজন বলতে কেবল ধারে থাকা ওডেগার্ড আর অদ্রিওজোলা ফিরেছিলেন মাদ্রিদের শিবিরে। মৌসুমের শুরু থেকে পয়েন্ট খোয়ানো রিয়ালকে বেশ ভোগাচ্ছিল ইনজুরি। এডেন হ্যাজার্ডকে এ মৌসুমেও কার্যকরভাবে পায়নি রিয়াল। স্কোয়াডে করোনার হানাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। মৌসুমজুড়ে ৬০+ ইনজুরিতে একেবারে টালমাটাল রিয়াল মাদ্রিদকে কক্ষপথে রাখার মূল কৃতিত্ব অবশ্যই ওস্তাদ জিনেদিন জিদানের। 

মৌসুমের সবচেয়ে নজরকাড়া দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম লুকাস ভাসকেজের প্রপার রাইট ব্যাক বনে যাওয়া। মূলত রাইট উইংয়ে খেলা ভাস্কুকে এর আগে মাঝেমধ্যে রাইট ব্যাকে খেলালেও লম্বা সময় ধরে সেটা দেখা যায়নি কখনোই। তবে এই মৌসুমে কারভাহালের ইনজুরি আর অদ্রিওজোলার অফ ফর্মের কারণে রাইট ব্যাকে টানা সুযোগ পেয়ে গেছেন ভাস্কু। প্রত্যাশার সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে ভাসকেজের পারফরম্যান্স। ২ গোলের সাথে আছে ৭টা অ্যাসিস্ট। প্রথাগত রাইট ব্যাকদের মতোই ডিফেন্স সামলেছেন, সুযোগ বুঝে ওপরে উঠে আক্রমণেও সাহায্য করেছেন। দারুণ সব ক্রস করে ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্সকেও। মোট কথা ভক্তদের হৃদয় জুড়ানো পারফরম্যান্স করে গেছেন, দিনশেষে সিক্ত হয়েছেন ভক্তদের ভালোবাসায়। 

প্রথম পছন্দের ডিফেন্ডারদের সবার ইনজুরিতে অনেকগুলো সুযোগ পান নাচো আর মিলিতাও। সেন্টার ব্যাক হিসেবে এই দুজনের পারফরম্যান্সও চোখে লেগেছে সবারই। বিশেষ করে ইউসিএলের (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) ম্যাচগুলোতে দৃঢ়ভাবে সামলিয়েছেন রক্ষণ; ব্লক, ইন্টারসেপশনস, ট্যাকলিং একদম পারফেক্ট সেন্টার ব্যাক বলতে যেটা বোঝায়, নাচো-মিলিতাও যুগলবন্দীর কাছ থেকে সেটাই পাওয়া গেছে মৌসুমজুড়ে। এল ক্লাসিকো, চ্যাম্পিয়নস লিগের মত বিগ ম্যাচের চাপও সামলেছেন দারুণভাবেই। 

 শুধু হ্যাজার্ডই নন, রিয়াল এবার মৌসুম জুড়েই ইনজুরিতে হারিয়েছে একের পর এক খেলোয়াড়কে। ছবি: টুইটার

গত মৌসুমেই সবার নজরে আসেন মাদ্রিদিজমে টইটম্বুর ফেডেরিকো ভালভার্দে। এই মৌসুমেও বজায় রেখেছেন পারফরম্যান্সের ধারা। ৩ গোলের সাথে আছে ১টা অ্যাসিস্ট। তবে এই পরিসংখ্যান দিয়ে পুরোপুরি যাচাই করা যাবে না ফেডেকে। যখন যেখানে দরকার সেখানেই যেন খেলেছেন তিনি। মাঠের প্রায় সব দিকে ছুটে বেড়ানো ফেডেরিকো ভালভার্দে যেমন পারদর্শী আক্রমণে, তেমনি রক্ষণেও। এল ক্লাসিকোতে স্টার্ট করেছিলেন রাইট ব্যাকে, ইনজুরির কারণে সেই ম্যাচটা ইনজেকশন নিয়েই খেলতে হয়েছিল তাঁকে। এসব কিছু বলেদেয়, রিয়াল মাদ্রিদের প্রতি কতটা ডেডিকেটেড ফেডেরিকো ভালভার্দে, ভক্তদের প্রিয় মুখ হয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। 

যে একটা প্লেয়ার না থাকলেই রিয়াল মাদ্রিদের খেলা সিংহভাগ ওলটপালট হয়ে যায়, সেই মানুষটির নাম কাসেমিরো। তাঁকে নিয়ে আসলে নতুন করে কিছু বলার নেই, প্রতি মৌসুমের প্রত্যেকটা ম্যাচেই যেন নিজেকে উজ্জ্বলতর করে যাচ্ছেন। পুরো মৌসুমে ক্যাসের গোল ৭টা আর অ্যাসিস্ট ৫টা। 

তিন কাঠির নিচে বরাবরই আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাওয়া গোলকিপার থিবো কোর্তোয়া যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন প্রত্যেকটা মুহূর্তে। বিশেষ করে এ মৌসুমের অনেক বিগ ম্যাচে অসাধারণ সব সেভ করে ম্যাচের ফল ঘুরিয়ে দিয়েছেন কোর্তোয়া। অনেকগুলো ‌ওয়ান অন ওয়ান সেভ ছাড়াও দারুণ সব সেভের কারণে মৌসুমজুড়েই প্রশংসা কুড়িয়েছেন ভক্ত-বিশ্লেষক সবার। ক্লিনশিট রেখেছেন ২১ ম্যাচে। তিন কাঠির নিচে এখন নিঃসন্দেহে রিয়ালের বড় আস্থার নাম বেলজিয়ান এই গোলরক্ষক।

এবার আসা যাক ৩৫ বছর বয়সী টগবগে বুড়ো মদরিচের কথায়। ‌‘বয়স স্রেফ একটা সংখ্যা’ প্রবাদটা যেন খুব করে যায় তাঁর সাথে। এই বয়সে এসেও টানা অনেকগুলো ম্যাচ খেলে গেছেন। ৬ গোলের পাশাপাশি আছে ৬টা অ্যাসিস্টও আছে তাঁর। রিয়ালের হয়ে এ মৌসুমে চতুর্থ সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছেন মদরিচ। কী ডিফেন্স, কী অ্যাটাক--সবখানেই যেন মদরিচের সরব উপস্থিতি। বয়স বাড়ছে আর সেই সাথে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাঁর পারফরম্যান্সের ধার। সতীর্থ টনি ক্রুসও কম যান না। ৩ গোল আর ১২ অ্যাসিস্ট করা ক্রুসও নিজেকে মেলে ধরেছেন বরাবরের মতোই। মাঝমাঠে শৈল্পিক ফুটবলের পসরা সাজিয়ে বসা ক্রুস-মদরিচ জুটি ইতোমধ্যে উঠে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। 

এবার আসা যায় মূল নায়ক করিম বেনজেমার কথায়। মৌসুমে ৩০ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট--একদম পারফেক্ট স্কোরার যাকে বলে! রিয়াল মৌসুমজুড়ে খেলে গেছে এই এক স্ট্রাইকারকে নিয়েই। গোলের জন্য ভরসাও এই বেনজেমাই। মাদ্রিদের অনভিজ্ঞ আক্রমণভাগে প্রাণের সঞ্চার করেছেন। একাই লড়ে গেছেন একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। রিয়াল মাদ্রিদের দলে নায়ক বা ‌‘মেইন ম্যান’ বলতে গেলে এই বেনজেমাই আছেন। গত কয়েক মৌসুমের পারফরম্যান্স আরও ধারালো হয়েছে এবারে এসে। এক করিম বেনজেমাই যেন ত্রাণকর্তা রিয়ালের। 

মৌসুমে ৩০ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট করে কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন বেনজেমা। ছবি: টুইটার

এবার আসা যাক পর্দার পেছনের নায়ক জিনেদিন জিদানের কথায়। জিদানের ট্যাকটিকস, স্ট্র‍্যাটেজি বরাবরের মতোই স্পট অন রিয়ালের বেলায়। এবারও ব্যাতিক্রম হয়নি। ৬০+ ইনজুরির কবলে পড়া একদম টালমাটাল এক দলকে ইউসিএলের সেমিতে তুলেছেন, লা লিগায় করেছেন দ্বিতীয়, লিগ টাইটেল নির্ধারিত হয়েছে একদম শেষ মুহূর্তে এসে, যেখানে অ্যাটলেটিকো একসময় ১০ পয়েন্ট সামনেও ছিল। বহু ম্যাচ খেলেছেন স্কোয়াডে চারজন ডিফেন্ডার নিয়ে। ফার্স্ট চয়েজ ডিফেন্ডারদের পাননি পুরো মৌসুমেই, বেঞ্চের ডিফেন্ডারদের অনেককেও পাননি সময়মতো। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, কাস্তিয়া থেকে প্লেয়ার নিয়ে এসে স্কোয়াড বানাতে  হয়েছে। তারপরেও জিতেছেন ২টা এল ক্লাসিকোতেই, হারেননি অ্যাটলেটিকোর বিরুদ্ধেও। মাদ্রিদ ডার্বিতে এক জয়ের সাথে এক ড্র। অনেক বিগ ম্যাচেও রেজাল্ট বের করে এনেছেন ভাঙাচোরা এই দল নিয়েই। বিধ্বস্ত টালমাটাল এই রিয়ালকে এত দূর নিয়ে আসার মূল ক্রেডিট অবশ্যই জিনেদিন জিদানের। 

লক্ষ্যণীয় বিষয় আরও আছে। প্লেয়ারদের ইনজুরিতে সুযোগ পাওয়া কাস্তিয়ার ব্লাঙ্কো, মিগুয়েল, চাস্টরা আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ভালোভাবেই, শুনিয়েছেন নতুন দিনের জয়গান। মিগুয়েল তো অ্যাসিস্টও করেছেন একটা। তবে এই মৌসুমটাই হয়তো শেষ মৌসুম হবে রিয়ালের অনেক প্লেয়ারদের জন্য। গুঞ্জন আছে, মৌসুম শেষে রিয়াল ছাড়বেন রামোস, ভারান, ভাসকেজ, ইসকোসহ আরও অনেকেই। জিদানও তো মনে হয় চলেই যাবেন। 

গেলে তো যাবেনই। তবে সব কিছুর পরও এই ঘটনাবহুল মৌসুম ভক্ত-সমর্থকদের হৃদয়ের গভীরতম স্থানে গেঁথে থাকবে বহুকাল। এমন পাগলাটে মৌসুম আর কে দেখেছে কবে! ট্রফিশূন্য হওয়া সত্ত্বেও এবারের মৌসুম অনেক বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত রিয়ালের জন্য। রিয়াল মাদ্রিদ রয়্যাল মাদ্রিদ হয়েই ফিরবে সামনের দিনগুলোতে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা তো করাই যায়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×