বিসিবির ঘুম ভাঙবে কবে?
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
সুবাইল বিন আলম
১৫ মে ২০২১
২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ, তারও আগে ওয়ানডে। এই হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের পথ চলাটা কম সময়ের নয়। তারপরও ক্রিকেট মাঠের বাংলাদেশ, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে যেন শিক্ষানবিশ এক দল! কিন্তু কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে বিসিবিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন লেখক।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সব থেকে বড় প্রশ্ন, খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইনের কী হবে? সম্প্রতি মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান এবং সাবেক ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম বুলবুল তুলেছেন এই প্রশ্ন। তবে সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা আরও আগে থেকেই। মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং মুশফিকুর রহিম দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় দলের পঞ্চপান্ডব হয়ে আছেন। কিন্তু তাঁদের পরে কে? মাশরাফির ক্যারিয়ার তো অলিখিতভাবে শেষই হয়ে গেছে বলে তাঁর ক্ষেত্রে 'ছিলেন' লেখাই ভালো।
ফারুক আহমেদদের নির্বাচক প্যানেল যাওয়ার পর এসেছে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুদের নির্বাচক প্যানেল, কিন্তু প্রশ্নটা আরও জোরালো হয়েছে। যে প্রশ্নের সমাধান না খুঁজে বিসিবি সব সময় নিজেদের সাফল্যের বড়াই করে এসেছে, যা তাদের করণীয়টাকে আড়াল করার চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। শোনা যায়, বিসিবি এখন বিশ্বের চতুর্থ ধনী ক্রিকেট বোর্ড, মাঠের খেলায় সাফল্য না থাকলেও আইসিসিতে মোটামুটি একটা দাপট আছে। খেলাটিতে তেমন সাফল্য না থাকার দায়ভার খেলোয়াড়, সমর্থক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে কম-বেশি সবারই। তবে সিংহভাগ দায় অবশ্যই বিসিবিরই।
১৯৯২ সাল থেকে দেশের ক্রিকেট দেখছি। টিভিতে খেলা দেখা, রেডিওতে কমেন্ট্রি শোনা, পরদিন পত্রপত্রিকা পড়া— বাংলাদেশের খেলা খুব কমই মিস করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেশের ক্রিকেটের ধীর অগ্রগতি নিয়ে লিখতে গেলে কয়েক পর্বের ধারাবাহিক হবে। তাই সব কিছু নিয়ে না লিখে শুধু ১৯৯২ থেকে কী কী সুযোগ-সুবিধা বা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ছিল, যা এখনকার বোর্ডের সময় নেই, শুধু সেসব নিয়েই এই প্রতিবেদনে লেখার চেষ্টা করেছি।
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমাদের অনেক সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি ছিল মানসম্পন্ন পিচ আর দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার মানসিকতার অভাব। অদ্ভুত হলেও সত্যি--এখনো সেই সমস্যা রয়ে গেছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা নিজেদের মাঠ। কিন্তু বিসিবি এত দিনেও ভালো মানের পিচ তৈরি করতে পারেনি। আর সে চেষ্টাও নাই। চেষ্টা নাই-ই বলব, কারণ পাশের দেশ ভারত তাদের অনেক স্পিনিং ট্র্যাককে বদলে বাউন্সি পিচের রূপ দিয়েছে। ভারতে এটা সম্ভব হলে আমাদের দেশে হবে না কেন? দেশে পিচ বদলে ভারত এখন পার্থের মাঠেও অস্ট্রেলিয়াকে হারায়, আর আমরা নিউজিল্যান্ডে ২০০ করতেই খাবি খাই। যখন বিসিবির টাকা ছিল না, তখনো ম্যাটিং উইকেটে খেলে কিছুটা চেষ্টা করা হয়েছিল। বিসিবির এখন অনেক টাকা, তবু আমাদের প্রথম শ্রেণির খেলা যেন এখনো পিকনিক লিগ!
যে দেশের ক্রিকেট কাঠামো যত উন্নত, সে দেশের ক্রিকেটাররাও উঠে আসে তত ভালো একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি লিগ এসে গেলেও টেস্ট খেলুড়ে সব দেশেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট সবসময়ই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের এখানে কী সে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? টেস্টের টেম্পারামেন্ট গড়ে ওঠার জন্য খেলোয়াড়দের যখন বেশি বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা দরকার, তখন প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট জাতীয় ক্রিকেট লিগে উল্টো কমে এসেছে ম্যাচের সংখ্যা। একটা সময় লিগে আট দলের ম্যাচ হতো হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। এখন দুই স্তরের লিগে ডাবল লিগ পদ্ধতিতে খেলেও ৬টির বেশি ম্যাচ পায় না কোনো দল।
খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইনে বড় একটা অবদান রাখতে পারত স্কুল ক্রিকেট। অনেক স্কুল খেলছে বলে যা নিয়ে খুব খুশি বিসিবি। কিন্তু এক-দুই ম্যাচের নকআউট টুর্নামেন্ট দিয়ে কি খেলোয়াড় তুলে আনা করা সম্ভব? বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে লঙ্গার ভার্সন লিগ চালু করা অনেক দিনের দাবি, সময়ের আবর্তে সে দাবি হারিয়ে গেছে।
আগে ‘এ’ দলের অনেক ট্যুর হতো। এখন ‘এ’ দল নামে যে কোনো দল আছে, সেটাই মানুষ ভুলে গেছে। আগে আমাদের দেশের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের পিউরা বুস্টা কাপ খেলেছে, খেলেছে পাকিস্তানের উইলস কাপ, ভারতের দুলিপ ট্রফিতে। একবার সম্ভবত খেলেছিল নিউজিল্যান্ডেও। বর্তমানে বিসিবির সঙ্গে যুক্ত আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ সুজনরাই খেলেছেন ওই সব টুর্নামেন্টে। কিন্তু এখন বোর্ডে থেকেও তাঁরা ‘এ’ দলের জন্য বিদেশের সেই সব টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলার ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
আমাদের খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইন অনেকাংশেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান বিসিবির সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সব চাইতে বড় সাফল্য হচ্ছে ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়। কিন্তু যে যুবাদের হাত ধরে এই সাফল্য, দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচের জন্য তাঁরা কতটা প্রস্তুত? দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার সুযোগ তো তাঁদের করে দিতে হবে। একবার ঢাকা লিগের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। তাঁরা অনেক ভালোও করেছিল। এখন কিন্তু সুযোগ থাকলেও বিসিবি কেন যেন তা করতে চায় না!
গ্লোবালাইজেশনের যুগে আমাদের জাতীয় দলের অনেকেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে মাইনর কাউন্টি বা অন্য সব দেশের এই জাতীয় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কেউ নেই। যেখানে জিম্বাবুয়ে বা আফগান প্লেয়াররাও খেলে আসছে। আগে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মতো অনেকে মাইনর কাউন্টিতে খেলতে যেতেন। আশরাফুল ছাড়া এই জেনারেশনের কারও কথা শুনলাম না, যিনি ওরকম লিগে খেলতে গেছেন।
আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বিভিন্ন একাডেমিতে ট্রেনিংয়ে যেতেন। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া, সাউথ আফ্রিকাতে অনেকেই ট্রেনিং করে এসেছেন। এটা এখন একেবারেই বন্ধ। এটা আবার চালু করা খুব জরুরি।
মাঝে ঘরোয়া লিগকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় করে তোলার জন্য বিদেশি দলকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই মনে হয়, এই চেষ্টা হারিয়ে গেছে। তা না হলে পশ্চিম বাংলা কিংবা নেপালের মতো দলকে সুযোগ দিলে তাদের যেমন উপকারও হবে, আমাদের লিগও আরও জমজমাট হয়ে উঠত। লিগের সেই ক্রেজ তো এখন নেই বললেই চলে।
সুজন, নান্নু, বুলবুলরা অবসরের পর প্রথম যে কাজটা করেছিলেন, তা হলো, কোচিংয়ের ওপর ডিগ্রি নেয়া। যে কারণে আমরা লেভেল টু-থ্রি কোর্স করা অনেক কোচ পেয়ে যাই, কিন্তু তাঁদের অনেকেই এখন কোচিং বাদ দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত। আবার লেভেল থ্রি করার পর এত দিনেও একজন লেভেল ফোর করা কোচ আমরা পাইনি। ইংল্যান্ডে না গিয়ে তা করা যায় না বলেই জানি, আর তা ব্যয়বহুলও। বিসিবির উচিত ছিল, নিজ উদ্যোগে লেভেল থ্রি কোর্স করা দেশি কোচদের লেভেল ফোর কোচিং করতে সাহায্য করা। বাংলাদেশ দলের জন্য একজন বাংলাদেশি কোচ নইলে আমরা কীভাবে পাব?
কোচিংয়ের মতো আমাদের আম্পায়রিংয়েও দৈন্যদশা। এত দিনেও আমরা নিজেদের একজন আম্পায়ারকে আইসিসির এলিট প্যানেলের জন্য যোগ্য করে তুলতে পারিনি। সমস্যার শিকড় কোথায়? অনেক গভীরে। ঘরোয়া লিগগুলোতে পাতানো খেলার মচ্ছবের কথা এখন এমনই ওপেন সিক্রেট যে, তা শুনে কেউ আর অবাকও হন না। বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ উঠলেও তেমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ওই সব লিগে কখনো কখনো ম্যাচ পাতানো খেলার ফাঁদে জড়িয়েছেন আম্পায়াররাও। পাতানো খেলা চললে কোনো পাইপলাইনই তৈরি হবে না। খেলোয়াড়ও না, আম্পায়ারও না।
অস্ট্রেলিয়ান কোচ রিচার্ড ম্যাকিন্স যখন হাই পারফরম্যান্স নিয়ে কাজ করেছিলেন, জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইনটা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। কিন্তু তিনি দায়িত্ব ছাড়ার পর সেটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও সেদিকে নজর দেয়নি বিসিবি। আমাদের জাতীয় দলে পঞ্চপান্ডবের শেষের শুরু হয়ে গেছে। এখন উঠে এসে নতুনদেরই হাল ধরার কথা। কিন্তু সেভাবে মেধাবী ক্রিকেটাররা উঠে আসছে কই!
বিসিবির যদি জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, সব কিছুই একজনের (পড়ুন সভাপতি) ওপরেই নির্ভর করে চলে, তাহলে বোর্ডের কাজ গতিশীল হবে কীভাবে? তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর জন্য খরচের একটা ব্যাপার তো আছেই, তবে তার চেয়েও বেশি জরুরি, পরিকল্পনা করা এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। আর সেটা না হলে আমরা যতই কোচ বদলাই, অধিনায়ক পরিবর্তন করি, কিছুতেই কিছু হবে না।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এত বছর পরও বিসিবি বুঝতে পারেনি, কী তাদের মূল কাজ হওয়া উচিত।২০-২৫ জন ক্রিকেটারকে নিয়ে ভেবে শুধু শর্ট টার্ম রেজাল্টই খুঁজে গেছে। এতে ওয়ানডেতে সাময়িক সাফল্য হয়তো পাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা টেকসই একটা পরিশুদ্ধ ক্রিকেট কাঠামো গড়ার বিকল্প হতে পারে না। যেটা হলে সব সংস্করণের ক্রিকেটেই আমরা নতুন নতুন মানসম্পন্ন ক্রিকেটার পাব। তখন দলে এক সাকিব বা মুশফিক না থাকলে আর হাহাকার করতে হবে না। কিন্তু টেকসই পরিশুদ্ধ সেই ক্রিকেট কাঠামো এত দিনেও গড়ে তুলতে পারেনি বিসিবি। সেই চেষ্টাও নাই। এটা কি বোর্ডে থাকা সাবেক ক্রিকেটারদের একটুও কষ্ট দেয় না?