শান্তির দেশে লিটনের অশান্তি, বাংলাদেশেরও কি নয়!
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
রিফাত বিন জামাল
৪ এপ্রিল ২০২১
নিউজিল্যান্ড সফর হয়ে গেছে লিটনের জন্য যন্ত্রণার আরেক নাম। ২০১৯ সালের সফরে করেছিলেন ৭ ইনিংসে ৬৭, এবার ৬ ম্যাচে করলেন ৫০ রান। দুই বছরে লিটনের পারফরম্যান্সের কোনো রকমফের তো টের পাওয়া যাচ্ছে না।
'বিশ্ব শান্তি সূচক ২০২০' বলছে, এক আইসল্যান্ডই তাদের চাইতে খানিক এগিয়ে, নইলে বিশ্বের আরও ১৭১টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শান্তি মিলবে নিউজিল্যান্ডেই। তা নিউজিল্যান্ড যে শান্তির দেশ, কোনো ক্রিকেট দর্শকের কাছে সে কথা প্রমাণের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজিরের প্রয়োজন পড়বে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাদের ক্রিকেটাররাই তো প্রশান্তির প্রতীক হয়ে প্রতীয়মান হন মাঠে। মাঠে কিউইদের দেখলেই তো নিউজিল্যান্ডের শান্তির বারতা টের পাওয়া যায়! একটু শান্তির পরশ পেতে কে না যেতে চাইবেন ওশেনিয়া মহাদেশের ওই দেশে! কিন্তু, লিটন দাস কি চাইবেন?
তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা বাবর আজমের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০১৬ সালে ৩ ম্যাচের তিনটিতেই সেঞ্চুরি করে তুলেছিলেন ৩৬০ রান, ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে কুইন্টন ডি ককের করা ৩৪২ রানের রেকর্ড। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ৩১২ রান করা তামিম ইকবালও আছেন সর্বোচ্চ পাঁচ রানসংগ্রাহকের সে তালিকায়। কিন্তু তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সর্বনিম্ন রানের রেকর্ডটা কার? এমন রেকর্ড কি রেকর্ডবুকে লিপিবদ্ধ করা হয়! তিন ম্যাচের তিনটিতেই যিনি শূন্য মারতে পেরেছেন, রেকর্ডের মালিক অবধারিতভাবে তিনিই হবেন।
২০১৯ নিউজিল্যান্ড সফরে সর্বনিম্ন রান ছিল যার, তিনি কোনো বোলার নন। বরং বাংলাদেশের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করেছেন তিন ওয়ানডের তিনটিতেই এবং প্রতি ম্যাচেই ফিরেছিলেন ১ রানে। লিটন দাস নামটিকে নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলে দিতে হবে না পাঠকদের।
সেবারের সিরিজে তার সমান ৩ রান করেছিলেন আরও একজন, কিন্তু রুবেল হোসেন তা করেছিলেন এক ম্যাচ খেলেই।
নিউজিল্যান্ড সফর থেকে বাংলাদেশের সাফল্যখাতায় দাগ তো পড়ে না কোনোবারেই, ব্যতিক্রম হয়নি সেবারও। দুটি টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারার আগে তিনটি ওয়ানডের দুটিতে ৮ উইকেটে ও একটিতে ৮৮ রানের বিশাল হার। লিটনের পারফরম্যান্স সেখানে আরও বিভীষিকাময়। ওয়ানডেতে তো তাঁর চেয়ে বেশি রান ছিল মাশরাফি-মুস্তাফিজেরও! ৩ ম্যাচে লিটনের রান- ১, ১, ১। এরপর টেস্টে ৪ ইনিংসে করেছিলেন ৬৪, ৭ ইনিংসে সর্বমোট সংগ্রহটা তাই দাঁড়িয়েছিল ৬৭ রানে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ওই ক্রাইস্টচার্চ-বিভীষিকা। লিটন দাস তার প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও সতীর্থদের মুখোমুখি হওয়া বীভৎসতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাঁর ওপর পড়েছিল নিশ্চিত করেই। নিউজিল্যান্ডে লিটনের সেবারের সফর তাই কোনোক্রমেই শান্তির হতে পারে না।
এবারের সফরে যাবার আগে লিটন নিশ্চয়ই গতবারের দুঃস্বপ্নকে চাপা দেবার স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু বদলায়নি কিছুই, এবারের সফরটিও চলল গত সফরের ধারা মেনেই। প্রথম আর শেষ ওয়ানডেতে করেছেন ১৯ আর ২১ রান, মাঝে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে পেয়েছেন দ্বীপদেশটিতে প্রথম শূন্যের দেখা। সফরের শেষটাও হয়েছে শুন্য দিয়েই, অধিনায়কত্বের অভিষেকে প্রথম বলেই শূন্য রানে বোল্ড হওয়া একমাত্র ক্রিকেটারও হয়ে গিয়েছেন যার কল্যাণে। অধিনায়ক লিটনের সূচনা ম্যাচটা বাংলাদেশও শেষ করেছে বীভৎসভাবে। বৃষ্টির জন্য টি-২০ ম্যাচ দশ ওভারে নেমে এলেও অলআউট হয়েছে টাইগাররা, শুরুতে বেধড়ক মারের পরে জ্বালাময়ী বোলিংয়ে ‘পিঁপড়া’ আকৃতির ম্যাচে কিউইরা জিতেছে হাতির মতো বিশালাকার ব্যবধানে।
এভাবেই শেষ হয়েছে লিটনের জ্বালা-যন্ত্রণার কারণ হয়ে যাওয়া নিউজিল্যান্ড সফর। এই সফরটাও তাই লিটনের জন্য শান্তির হতে পারল না। আসলে অশান্তিতে তো পোড়ার কথা পুরো টাইগার বাহিনীরই। প্রথম ও শেষ ওয়ানডেতে ৮ উইকেট ও ১৬৪ রানে হারের মাঝখানে ওই 'ক্যাচ ফেলে ম্যাচ ফেলে দেয়ার' ওয়ানডেতে জুটেছিল ৫ উইকেট হার। প্রথম ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে ৬৬ ও ৬৫ রানে হারের মাঝখানে ২৮ রানের হার। মাঝের ম্যাচগুলোই যা একটু রেহাই দিয়েছে লজ্জার পরাজয় থেকে! খেলায় হার-জিত অবধারিত বলে হার লজ্জাজনক হতে পারে না ঠিকই, কিন্তু হারের ব্যবধান এমন হলে তা আপনার দেশের ক্রিকেটের করুণ অবস্থা দেখিয়ে দিয়েও লজ্জায় ফেলতে পারে। টাইগারদের শান্তি বিনষ্ট শুধুই এমন হারেও তো নয়! সাথে আছে সুযোগ হাতছাড়া করে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের বিপক্ষে অজেয় কিউইদের বিপক্ষে প্রথম জয়ের সুযোগ ফেলে দেয়ার যন্ত্রণাও!
এমন জঘন্য এক সফর শেষে কেউ কি শান্তিতে থাকতে পারে? চ্যাম্পিয়নরা তো পারে না বলেই জানি। লিটন দাস কি চ্যাম্পিয়ন? তা এই অশান্তি তো তাঁর দুঃস্বপ্ন ভুলে স্বমহিমায় প্রকটিত হবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই দুঃস্বপ্ন ভুলেই নতুন সোনালী স্বপ্নের নেশায় বুঁদ হওয়াটাই শ্রেয়। আবার সে দুঃস্বপ্ন ভুলে গিয়ে স্বরূপে ফেরার নেশায় বুঁদ না হয়ে গেলেও তো সমস্যা! তাই সে দুঃস্বপ্নও আসুক সামনে, তবে সেটা কুপ্রভাবক রুপে নয়। সেটার প্রভাবে ইতিবাচক লিটনকেই দেখার প্রত্যাশা। যে লিটনকে দেখতে চায় সবাই। যে লিটনকে দেখতে হসপিটালিটি বক্সের টিকেট কিনতেও আপত্তি থাকার কথা নয় কারও।
তা লিটন দাসেরই কি শুধু পরিবর্তন হবে? বাংলাদেশের হবে না? এই সফরটা কি আমাদের পরিবর্তনেরই বার্তাই দিয়ে গেল না?