উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
আবার প্রমাণ করুন, সুপারম্যান...
লাবিব হাসান
১৬ অক্টোবর ২০২১
সাকিব পারফর্ম করছেন। কিন্তু ঠিক যেন সাকিবসুলভ নয়। এতদিনে সাকিব নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই তুলনায় এখন তিনি বেশ ব্যাকফুটে। ব্যাটে-বলে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুড়ে ফেলা সাকিব কিছুটা ম্লান হয়ে গেছেন। এমনটাই মনে করছেন লাবিব হাসান নামের এই পাঠক। কিন্তু সাকিবের সামর্থ্যটা জানা আছে বলেই এখনো সাকিবের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছেন না তিনি।
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসার পর সাকিব আল হাসান শিরোনাম হয়েছেন অনেকবারই। স্টাম্পে লাথি মেরে বিতর্কিত হয়েছেন। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া বা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ-সেরা হয়ে প্রশংসা-বন্যায় ভেসেছেন। সাকিবের পুরো ক্যারিয়ারটাই অবশ্য এমন, কখনো ক্রিকেটীয়, আবার কখনো অক্রিকেটীয় কারণে তিনি আলোচনায় ছিলেনই। কিন্তু কেবল মাঠের পারফরম্যান্সটাই যদি বিবেচ্য হয় তো, নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব এবং পরের সাকিব কি একই রকম। ব্যাট হাতে স্বপ্নের মতো একটি বছর কাটানোর পর নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন সাকিব। ফিরে আসার পর সেটি কি ধরে রাখতে পেরেছেন?
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসার পর সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তিনি খেলেছেন ৪৮ টি ম্যাচ। ৪৫ ইনিংসে ব্যাট করে ১৯.৫৫ গড়ে সাকুল্যে করতে পেরেছেন ৮২১ রান। হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ৩ বার,নেই কোনো সেঞ্চুরি। পরিসংখ্যান বলে, ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটের গড়টা কিছুটা ভদ্রস্থ (৩৮)। কিন্তু সেখানে আছে অংকের ঘাপলা।জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংসটি বাদ দলে এখানে তাঁর ব্যাটিং গড় দাঁড়াচ্ছে ২৮! মূল দুশ্চিন্তার জায়গাটা টি-২০ ব্যাটিং নিয়ে। এই ফরম্যাটটা যেন একটু বেশিই নেতিবাচক বার্তা ছড়াচ্ছে! ৩৭ ম্যাচে ৩৬ ইনিংস ব্যাট করে গড় সেখানে ১৩.৫; স্ট্রাইক রেটটাও বিবর্ণ– ১০৮!
সাকিবের ব্যাটিং নিয়ে এতদিন কারোরই মাথাব্যথা ছিলো না। সবাই ধরেই নিয়েছিল ,সাকিব খুব শীঘ্রই রানে ফিরবেন। কিন্তু সাকিব কি সেটা পেরেছেন? ৪৮ টি ম্যাচ অবশ্যই সংখ্যায় বেশ বড়। অথচ এখনো সাকিব ধারাবাহিকভাবে রানের দেখা পাননি। মাত্র ৩টি পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংস বারবার চিন্তা বাড়িয়েই দিচ্ছে।
সাকিবের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে ধারাবাহিকতা। এই তো সেদিনও ক্রিকইনফোর এক গবেষণায় বেরিয়ে এলো, ধারাবাহিকতার বিবেচনায় সাকিবই অলরাউন্ডারদের মধ্যে সর্বকালের সেরা। সব ফরম্যাটেই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে সাকিব বেশ এগিয়ে।
আন্তর্জাতিক টি-২০তে প্রথম ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার পর দুটি ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার মধ্যে সাকিবের সর্বোচ্চ অপেক্ষা ছিল ৮ ম্যাচের। সেই সাকিব এই সময়টিতে ১২ টি-টোয়েন্টি খেলে মাত্র একবার ৩০ ছুঁতে পেরেছেন। যে সাকিব এর আগে আইপিএলে মাত্র একবার শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন, সেই সাকিব টানা দুই ম্যাচে কোনো রান না করেই আউট হলেন এবার। ডিপিএল এবং বঙ্গবন্ধু টি-২০ টুর্নামেন্টের মতো ঘরোয়া সিরিজেও সাকিব তাঁর ব্যাটিং গড়কে ১৫-র ওপরে নিতে পারেননি। সবমিলিয়ে সাকিবের ব্যাটিং ফর্ম যেন এক ঘোর অমানিশায়।
বোলিংয়ের ক্ষেত্রে সাকিবের আমলনামা এই সময়ে বেশ দারুণ, অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে। সব মিলিয়ে ৪৮ ম্যাচে ২৩.৫৬ গড়ে নিয়েছেন ৫৫ উইকেট। তার মধ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইকোনোমিটা ৬.৪৮। খোলা চোখে বেশ ইমপ্যাক্টফুল মনে হচ্ছে। তবে ছোট্ট কিছু চিন্তার ছাপ এখানেও বিদ্যমান।
সাকিব প্রায়শই তাঁর বোলিংয়ে ছন্দ হারাচ্ছেন। সাকিব ফ্লাইটের ওপর নির্ভর করা বোলার। ব্যাটসম্যান তেড়ে আসতে দেখলে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন বলটা, এমনই আমরা দেখে এসেছি। 'আগের বলে সাকিবকে ছক্কা মারলে পরের বলে তোমাকে আউট হতে হবে’-- এমন কথা দর্শকমহলে বেশ প্রচলিত ছিল। এখানে ‘ছিল' বললাম, কারণ এখন সেরকম ঘটনা বেশি একটা দেখা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাটসম্যানরা কেন জানি বিগ হিট করার সময় সাকিবের ফ্লাইটে গোলমাল বাঁধাচ্ছেন না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সাকিব প্রচুর ছক্কা হজম করছেন। সেই প্রবল প্রতাপে যেন কিছুটা মরচে ধরেছে!
সাকিব স্মার্ট ক্রিকেটার। তিনি নিজেও নিশ্চয়ই এসব ব্যাপার নিয়ে ভেবেছেন। চিন্তা করেছেন কিভাবে মডার্ন ডে ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নেয়া যায়। সেজন্যই বাড়াতে চেষ্টা করছেন বোলিং বৈচিত্র্য। বল ছোড়ার গড় গতি বাড়িয়েছেন। আগে কুইকার বল না করলেও এখন প্রায় ১০০ কি.মি/ঘণ্টা বেগে বল করছেন। এজন্য অবশ্য বদলাতে হয়েছে বোলিং অ্যাকশন। বোলিং রান-আপ বেশ খানিকটা কমিয়ে এনেছেন। সেটিও আবার করেছেন খুব নিয়ন্ত্রিত উপায়ে,ধীরে ধীরে। কিন্তু এতসব কিছু করতে গিয়ে বোলিং লেংথে হঠাৎ হঠাৎ গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। দুয়েকটা বল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেই দুর্বলতাটা অবশ্যই কাটাতে হবে। কারণ বাংলাদেশের বোলিং শক্তির অনেকটাই সাকিবের উপর নির্ভরশীল।
সাকিব পারফর্ম করছেন। কিন্তু ঠিক যেন সাকিবসুলভ নয়। এতদিনে সাকিব নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই তুলনায় এখন তিনি বেশ ব্যাকফুটে। ব্যাটে-বলে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুড়ে ফেলা সাকিব কিছুটা ম্লান হয়ে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন, ’সাকিব তাঁর সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন'। কিন্তু, এখনও সাকিবের প্রতি বিশ্বাসটা রাখতে ইচ্ছে হয়।
প্রিয় সাকিব, আপনি আবার 'সাকিব' হয়ে উঠুন প্লিজ। এখনো যে বাংলাদেশিদের বিশ্বজয়ের উল্লাস করা বাকি। আর সেই স্বপ্নের মহানায়ক হিসেবে আপনার ছবিই যে মনে মনে এঁকে রেখেছি আমরা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ব্যাট ও বল হাতে আরেকবার হুংকার দিয়ে জানিয়ে দিন, 'আমি এখনও সুপার সাকিব!'