উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
ভালো না বাসলে না বাসুন, অন্তত সম্মানটা তো করুন
শাওন শেখ শুভ
১২ আগস্ট ২০২১
মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে...সাকিব আল হাসান খবরের শিরোনাম সব সময়ই। আলোচনা-সমালোচনায় সাকিবের নামটাই উঠে আসে সবচেয়ে বেশি। এক পাঠক লিখে পাঠালেন, গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই হতে পারে এবং হওয়া উচিত। তবে সেটা তাঁর পারফরম্যান্সকে নিয়ে, ব্যক্তি সাকিবকে নিয়ে নয়।
সাকিব আল হাসান একজন অতিমানব। ক্রিকেট মাঠে যা চান, তা-ই করতে পারেন। কখন তা চাইবেন, সেটিই হলো প্রশ্ন। নাটকীয় নয় হয়তো, মহানাটকীয় শোনাচ্ছে। কিন্তু তাঁর টিমমেটরা এটাই বিশ্বাস করেন। আর এই মতবাদের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা তামিম ইকবাল। (কথাগুলো উৎপল শুভ্রর 'এগারো' বই থেকে তুলে দেওয়া। সাকিবকে নিয়ে লেখার শুরুটা করেছেন তিনি এভাবেই)।
অতিমানব না হলে কি বারবার এমনভাবে ফিরে আসা যায়! অতিমানব না হলে কি ১৫ বছর ধরে এভাবে পারফর্ম করা যায়? পরিসংখ্যানের পাল্লায় একজন সাকিবকে না মাপাই শ্রেয়। সাকিব মানে সাকিবই। যে নামটাই মহাকাব্য, রূপকথা। তারপরও পরিসংখ্যানকে অগ্রাহ্যও করে যায় না। আজ না হয় এই সাকিবনামার ছোট একটা অংশ দিয়েই বিচার করি সাকিব অতিমানব কি না!
শুরু করি আভিজাত্যের টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। শোনা যায় এই ফরম্যাট নাকি তিনি খেলতে চান না! অথচ তাঁর অভিষেকের পর থেকে দলের মোট রানের ১৩.৫৫ শতাংশ এবং মোট উইকেটের ২৭.১৮ শতাংশ তাঁর দখলে। ১০৭ ইনিংসে প্রায় ৪০ গড়ে রান করেছেন ৩৯৩৩, রয়েছে ২৫টি হাফ সেঞ্চুরি ও ৫টি সেঞ্চুরি। যার মাঝে আবাত নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২১৭ রানের ইনিংসও আছে। এছাড়াও দলের টপ স্কোরার হয়েছেন ২১ বার।
বল হাতে টেস্টে উইকেট সংখ্যা ২১৫, পাচঁ উইকেট নিয়েছেন ১৮ বার, দশ উইকেট ২ বার। টেস্টে বোলার সাকিবের গড়, ইকোনোমি দুটোই বিদেশের মাটিতে দেশের চেয়ে ভালো। ৫ উইকেট রয়েছে উইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ফেরা যাক। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০৩ ইনিংসে প্রায় ৩৮ গড়ে ৬৬০০ রান, স্ট্রাইকরেট ৮২, ক্যারিয়ারে ৪৯টি অর্ধশতকের পাশাপাশি রয়েছে ৯ টি শতক যার ৬টিই আবার দেশের বাইরে। দলের টপ স্কোরার হয়েছেন ৩৮ বার। দলের মোট রানের ১৪.৩৯ ভাগ করেছেন একাই।
ওডিয়াইতে বল হাতে ৪.৪৫ ইকনোমিতে উইকেট নিয়েছেন ২৭৭টি। যার মাঝে টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসমানদের সংখ্যা যথাক্রমে ১০২ ও ১২৫। বোঝাই যাচ্ছে, শুরুতে উইকেট এনে দিতে কিংবা ব্রেকথ্রু দিতে...সব ভূমিকাতেই তিনি তুলনাহীন। দলের মোট উইকেটের ১৭.৭১ শতাংশই তাঁর।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ উইকেট দুটিই সাকিবের। পৃথিবীর একমাত্র ক্রিকেটার, যাঁর ঝুলিতে আছে ১৫০০ রান ও ১০০ উইকেটের ডাবল।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দেশের হয়ে ৮৩ ইনিংসে ২৩ গড়ে রান ১৭১৮। স্ট্রাইকরেট ১২২। দলের সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েছেন ১৬ বার, দলের মোট রানের ১৪.৫৮% তাঁর দখলে।
বল হাতে ৬.৮০ ইকনোমিতে উইকেট নিয়েছেন ১০২টি। যার মাঝে শুধুমাত্র টপ অর্ডারের উইকেটই নিয়েছেন ৫০টি। পাওয়ার প্লে, মিডল ওভারের পাশাপাশি ডেথ ওভারেও অধিনায়কের ভরসার জায়গা তিনিই। দলের মোট উইকেটের ১৯.৯৬% উইকেট নিয়েছেন একাই।
বিশ্বমঞ্চে সাকিব আরও বেশি কার্যকর। ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারে ব্যটিং গড় যেখানে ৩৭, সেখানে বিশ্বকাপে ৪৫, পাশাপাশি উইকেট আছে ৩৪টি। ক্রিকেট বিশ্বকাপে সাকিব বল করেছেন ১৪৩৩টি; এর মধ্যে ডট দিয়েছেন ৬৭৯টি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সাকিবের চেয়ে বেশি বল ডট দিয়েছেন মাত্র দুজন।
টি-টোয়েন্টি এর বিশ্বমঞ্চেও সাকিবের ব্যাটিং গড় ও বোলিং গড় দুটোই ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে ভালো। ফলে এটা বলার সুযোগ নেই যে, সাকিব বিগ স্টেজ পারফর্মার নন। বরং বড় মঞ্চ পেলে তিনি আরও বেশি জ্বলে ওঠেন। যার সবচেয়ে বড় প্রমান হয়তো ২০১২ এশিয়া কাপ ও ২০১৯ বিশ্বকাপ।
ম্যাচ-সেরা কিংবা সিরিজ-সেরা, কোথায় নেই সাকিব! সিরিজ-সেরায় ক্যালিসকে ছাড়িয়ে গেছেন, শচীনকে টপকানোও অসম্ভব নয়। লড়াইটা বোধ হয় তাই শুধু বিরাট কোহলির সঙ্গেই হবে। এত এত পারফরম্যান্স, এত এত রেকর্ড...তারপরও আপনি বলবেন না সাকিব অতিমানব! তারপরও প্রশ্ন তুলবেন, সাকিব দেশের জন্য কী করেছে?
তুলনামূলক দুর্বল দলগুলোতে খেলা 'গ্রেট' খেলোয়াড়দের জন্য স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়াটা বরাবরই প্রচণ্ড কঠিন কাজ। কঠিনতম কাজগুলোই তাঁদেরকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিয়ত করতে হয়। যেখানে সাকিব নিজের স্মার্টনেস, আত্মবিশ্বাস এবং স্বীয় প্রচেষ্টাবলে হয়ে উঠেছেন অদ্বিতীয়।
এই অদ্বিতীয় ক্রিকেটারেরও খারাপ সময় আসে, আসবে। তবে সেই মুহূর্তে হয়তো আমাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখা।
গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই হতে পারে এবং হওয়া উচিত। তবে সেটা তাঁর পারফরম্যান্সকে নিয়ে, ব্যক্তি সাকিবকে নিয়ে নয়। সাকিবকে আপনি ভালোবাসবেন কি না, অতিমানব বলবেন কি না, সেটা আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু তাঁর অর্জনকে আপনার সম্মান করতেই হবে।