উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
টোকিওর চিঠি: অলিম্পিক দেখা কিংবা না-দেখার অনুভূতি
জয়দীপ চৌধুরী
১০ আগস্ট ২০২১
লেখক ২০১৮তে গিয়েছিলেন টোকিওতে, কথা ছিল পরের বছরই ফেরত আসবেন। মানেটা হচ্ছে, ২০২০ টোকিও অলিম্পিক দেখা হবে না তাঁর। সেই তিনি ২০২১ সালেও টোকিওতেই আছেন, তবে অলিম্পিক আর দেখা হলো না। অলিম্পিক-নগরীতে থেকেও অলিম্পিকের আঁচ গায়ে না লাগার অদ্ভুত সেই অভিজ্ঞতার গল্প।
পাঠকদের আগেই বলে রাখছি যে, আমার এই লেখায় অলিম্পিকে কে কয়টা রেকর্ড গড়ল বা কোন দেশ কয়টা স্বর্ণ পেল, সেটা জানার আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসলে আপনার হতাশ হওয়াটা শতভাগ নিশ্চিত। অলিম্পিকের জয়-পরাজয় কিংবা ঘটন-অঘটনের ব্যাপারে জানানোর দায়িত্বটা রেখে দিলাম বরেণ্য ক্রীড়াবিদ বা ক্রীড়া লেখকদের ওপর। একজন অতি সাধারণ ক্রীড়ামোদী ও বেশ কয়েক বছর ধরে টোকিওতে থাকার সুবাদে অলিম্পিকের খেলার বাইরের খেলা আর অলিম্পিকের শহরে থেকে খেলার এই মহাযজ্ঞ নিয়ে সময় ও প্রেক্ষাপটের মহানাটকীয় পরিবর্তনগুলোর সাক্ষী হিসেবে কোনো রাখঢাক না রেখে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য।
টোকিও শহরে কর্মসূত্রে আমার আসা ২০১৮ সালের শুরুর দিকে। প্রাথমিকভাবে টোকিও আমার জন্য এক বছরের অস্থায়ী ঠিকানা হবার কথা ছিল। তখন মনে মনে একটা বিশাল আফসোস ছিল যে, কয়েক মাসের জন্য অলিম্পিকের মতো মর্ত্যলোকে সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর নিজ চোখে দেখা বা কাছে থেকে এই উৎসবের অংশ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। সময়ের পরিক্রমায় কিছুটা চেষ্টা আর সৌভাগ্যের মিশেলে আরও বেশ কিছুদিন টোকিওতে থাকার সুযোগ হয়। অন্য আর দশটা বৈষয়িক বিষয়ের পাশাপাশি অলিম্পিকের প্রত্যক্ষ স্বাদ পাওয়ার হাতছানিটাও টোকিওতে থেকে যাওয়ার পেছনে একটা প্রভাবক ছিল।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। ২০১৮ সালে টোকিওতে পা রাখার পর থেকেই এটা বোঝার বাকি ছিল না, অলিম্পিক নিয়ে জাপানিদের প্রস্তুতির ব্যাপকতা। টোকিও শহরে যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন হলো মেট্রোরেল। দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত মেট্রোরেল ব্যবস্থার মালিক হিসেবে টোকিওবাসীর গর্বের শেষ নেই। কিন্তু যে কোনো বিদেশির জন্য এই টোকিও শহরের মেট্রোরেল ব্যবস্থা ব্যবহার করা ছিল বিশাল ঝক্কিও, কেননা দিক-নির্দেশনার প্রায় সবই জাপানি ভাষায় লেখা। এমনকি গুগল ম্যাপেও অধিকাংশ জায়গা আর স্টেশনের নাম দেখা যেত জাপানি ভাষায়। চোখের সামনে দেখলাম কত গোছানোভাবে অলিম্পিকের নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগে রাস্তাঘাট-স্টেশন সবকিছুতে জাপানি ভাষার পাশে স্থান করে নিল ইংরেজি। আর এর পাশাপাশি চলল সকল মূল স্টেশন আর বিভিন্ন স্থাপনা সংস্কারের কাজ। সাধারণ বাংলাদেশির চোখে ওই সংস্কার আরও সুন্দর করে সব কিছুকে উপস্থাপনের চেষ্টাকে একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও দেখলাম, আমার জাপানি সহকর্মীরা এতে খুবই খুশি আর মেরামতের সময়কার কিছু কষ্ট নিয়ে তারা একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন। এর থেকে তাদের বেশি চিন্তা, টোকিও এ যাবৎকালের সেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বা সেরা গেমস আয়োজন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে।
পরিবর্তনের সবচেয়ে মজার গল্পটা সম্ভবত টোকিও শহরের ট্যাক্সির চেহারার আমূল বদলের ঘটনাটা। যখন আমি টোকিওতে এলাম, তখন থেকেই টোকিও শহরের ট্যাক্সিগুলো আমাকে খুব করে ভাবাত যে, এমন এক আধুনিক শহরে লক্কড়-ঝক্কড় না হলেও এমন প্রাচীনকালের মডেলের ট্যাক্সি কেমন যেন বেমানান। বছর না ঘুরতেই দেখা গেল নব্বইয়ের দশকের মডেলের বদলে টোকিও শহরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁ-চকচকে নতুন মডেলের ট্যাক্সি। এই ট্যাক্সির গায়ে আবার টোকিও অলিম্পিক ২০২০-এর অফিশিয়াল লোগো। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেল, এই পরিবর্তন নাকি অলিম্পিককে মাথায় রেখেই এবং টয়োটা কোম্পানি নতুন করে সব দিক মাথায় রেখে এই ট্যাক্সির মডেল ডিজাইন করেছে। এই যাদের প্রস্তুতির মাত্রা, তখন এটা আর বিশেষভাবে বলার দরকার নেই অলিম্পিকের ভেন্যু, অলিম্পিক ভিলেজের কাজ কত দিন আগে শেষ হয়েছে। এটাও সহজে অনুমেয়, এই অলিম্পিকে ভালো করবার জন্য জাপানি খেলোয়াড়দের প্রস্তুতির পেছনে কতটা পরিকল্পনা আর শ্রম গেছে। প্রমাণটাও সকলের সামনে, কারণ এই অলিম্পিকে জাপানের ২৭টি স্বর্ণ আর মোট ৫৮টি পদক দুটিই অলিম্পিকে জাপানের সেরা সাফল্য।
যাই হোক আবার ফেরা যাক, খেলার বাইরের খেলা প্রসঙ্গে। সকল প্রস্তুতির শেষে যখন সব কিছু তৈরি, টোকিওবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আনুষ্ঠানিকভাবে অলিম্পিকের পর্দা ওঠার, তখনই দুনিয়াজুড়ে করোনার প্রকোপ শুরু হলো। এখানে দুটি কথা আগেই বলে রাখা ভালো। প্রথমত, জাপানের অর্থনৈতিক মন্দা মোটামুটিভাবে চিরস্থায়ী। নব্বইয়ের দশক থেকে জাপানের অর্থনীতিতে যে মন্দার শুরু, তার রেশ রয়ে গেছে এখনও। জাপানি ভাষায় এই সময়কে বলা হয় 'উশিনাওরেতা জুনেন', যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'হারিয়ে যাওয়ার দশক'। জাপানিদের তাই অলিম্পিক নিয়ে একটা অর্থনৈতিক প্রত্যাশার জায়গা ছিল। গেমসের সময় অনেক খেলোয়াড় কর্মকর্তার পাশাপাশি প্রচুর দর্শকের আগমন পর্যটন বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট খাতে প্রচুর আয়ের বা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এবং এটা জাপানিদের চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সহায়তা করবে, সে ব্যাপারে সাধারণ জনগণ বেশ আশাবাদী ছিল। দ্বিতীয়ত, গেমস চলাকালীন সময়ে স্থানীয় আর বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের অংশগ্রহণে সামগ্রিকভাবে একটা উৎসবের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে নতুন করে টোকিও আর জাপানকে চেনানোর আশাও সাধারণ জাপানিদের মধ্যে প্রবলভাবে অনুভব করা যাচ্ছিল।
করোনার ধাক্কায় সামগ্রিকভাবে খরচ কয়েক বিলিয়ন ডলার বেড়ে গেলেও সাধারণ জাপানিরা তাই এক বছরের জন্য অলিম্পিককে পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। এই মেনে নেয়ার পেছনে একটা বিশ্বাস ছিল যে, এক বছরের মধ্যে করোনার প্রকোপ কমতে বাধ্য আর সেটা হলে জাপানিরা যে দুটি কারণে অলিম্পিক আয়োজনকে নিজেদের লাভের জায়গা থেকে দেখছিল, সেখানেও কিছুটা প্রাপ্তিযোগ হবে।
কিন্তু এবারের অলিম্পিক যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল জাপানের সকল পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফেলার। ২০২০ সালের গ্রীষ্মের পর বছর ঘুরে এলো ২০২১ সালের গ্রীষ্ম। বিশ্ববাসীকে নাকাল করা করোনা তার রূপ পরিবর্তন করে তখনও সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যদিও জাপানে কখনোই করোনার প্রকোপ ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতন মারাত্মক আকার ধারণ করেনি, কিন্তু টোকিওবাসী এই এক বছরের মাঝে তিনবার ইমার্জেন্সির মধ্যে দিয়ে গেছে, যার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতের জায়গাটা মনে হয় ঘটেছিল সাধারণ মানুষের মনে, যার একটা প্রকাশ হলো সামষ্টিক ধৈর্য্যচ্যুতি। যে অলিম্পিকের জন্য এত প্রস্তুতি, এত আয়োজন, সেই গেমসের সময় যতটা কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, ততই জাপানিরা খেলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। গেমস শুরুর কিছুদিন আগের এক জরিপে দেখা গেল, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাপানি অলিম্পিক পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে, একটা বিশাল অংশ তো পুরোপরি বাতিলের পক্ষে। এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল দর্শকবিহীনভাবে খেলা আয়োজন আর টোকিওতে চতুর্থ ইমার্জেন্সির ঘোষণা।
অলিম্পিক শুরুর পর পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। আমার বাসা থেকে অলিম্পিক ভিলেজের দূরত্ব তিন কিলোমিটার আর অলিম্পিক স্টেডিয়ামের দূরত্ব বারো কিলোমিটার। টোকিও শহরের আয়তনের তুলনায় এই দূরত্ব কিছুই নয়, কিন্তু সেই আমিও খেলাধুলার সবচেয়ে বড় আসর বাড়ির পাশে না ভিন্ন কোনো দেশে তাই ভেবে গত দুই সপ্তাহ কাটালাম। পুরো টোকিও শহর ঘুরে বোঝার কোনো জো নেই, এই শহরেই চলছে অলিম্পিক আর দুনিয়ার তাবৎ সেরা ক্রীড়া মহাতারকারা রয়েছে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। পুরো শহরে অলিম্পিক নিয়ে কোনো বিলবোর্ড নেই। অলিম্পিকের যা ব্র্যান্ডিং চোখে পড়ছিল, তা ছিল আগের। অযত্নে সেগুলোকে রীতিমতো মলিন লাগছিল। বিদেশ থেকে আসা খেলোয়াড়, কর্মকর্তা আর সাংবাদিকদের জন্য ছিল চলাচলের নিষেধাজ্ঞা। গেমস ভিলেজ আর খেলার ভেন্যু বাদে তাদের বাইরে কোথাও যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
সব মিলিয়ে টোকিও শহর গেমস চলাকালীন সময়ে ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশে সাধারণ টোকিওবাসী নিজেদের মতন করে আর দশটা দিনের মতন নিয়মিত জীবন কাটাচ্ছে, আরেক অংশ যেন ছিল নিষিদ্ধ এলাকা, যেখানে যাওয়া সাধারণের বারণ। অলিম্পিক নিয়ে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতাটা এবার বলি। একদিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশে থাকা আমার এক সহকর্মী অনলাইন মিটিংয়ে বলে বসল, গতকাল থেকে অ্যাথলেটিকস শুরু হওয়ার কারণে সে ঠিকমতো কাজ বা বিশ্রাম কোনোটাই করতে পারছে না। কারণ হিসেবে জানা গেল, অনেক রাত পর্যন্ত স্টেডিয়াম থেকে আসা বিভিন্ন ঘোষণা আর জাতীয় সংগীতের আওয়াজ তার স্বাভাবিক জীবনে ভীষণভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
অলিম্পিকের গল্প বলছি, খেলোয়াড়দের কথা একদম বলব না, সেটা কি ঠিক? অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় আবেদন, সকল দেশ আর দুনিয়ার অধিকাংশ খেলার অন্তর্ভুক্তি। এর মধ্যে কিছু খেলা বাদে অধিকাংশ খেলাই দর্শকপ্রিয়তা বা হাল আমলের টিআরপিতে অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু অলিম্পিকের জন্য সেই খেলাগুলোর বিশ্বসেরারাও সুযোগ পান হাজার হাজার দর্শকের সামনে নিজেদের সেরাটা উপস্থাপনের, নিজের সাথে দর্শকদের সংযোগ স্থাপনের। এবারের অলিম্পিক গেমসের এমন জনবিচ্ছিন্ন আয়োজন কি সেই সকল ক্রীড়াবিদদেরও কিছুটা বঞ্চিত করল না?