খুলনা থেকে সুইডেন জাতীয় ক্রিকেট দলে
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
হুমায়ন কবির জ্যোতি
২ আগস্ট ২০২১
খুলনার দৌলতপুরের তরুণের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলা। জাতীয় দলে খেলার লক্ষ্যটা পূরণ হয়েছে, তবে দলের নামটা বদলে গেছে। জ্যোতি খেলবেন সুইডেন জাতীয় দলের হয়ে। কীভাবে গেলেন সুইডেনে, কীভাবে সুযোগ পেলেন ওই দেশের জাতীয় দলে, সুইডেন জাতীয় দলের বর্তমান কোচ জন্টি রোডসের কাছ থেকে কী কী শিখতে চান...এসব লিখে পাঠিয়েছেন তিনি নিজেই।
আমি হুমায়ূন কবির জ্যোতি। আর সব বাংলাদেশি ছেলের মতো আমিও ছোট থেকেই ক্রিকেটের পোকা ছিলাম, উইকেট কিপিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিং করতাম। বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১২, অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলেছি। একবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও দল পেয়েছিলাম। অবাক হতে পারেন, আমার জীবন বৃত্তান্ত জেনে আপনার লাভ কী! এসব বলছি, কারণ কিছুদিন আগে আমি সুইডেন জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি। কীভাবে সেখানে পৌঁছালাম, সেই যাত্রাটা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব বলেই লিখতে বসেছি।
বাংলাদেশে আমার বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে। খুলনায় থাকতে ক্রিকেট খেলেছি প্রচুর, তবে খুলনার প্রথম বিভাগ আর প্রিমিয়ার ডিভিশনে পাঁচ বছর খেলতে খেলতেই পেরিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। আর আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে তখন তো সব ছেলের ঘাড়েই কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য চলে আসে। আমাকেও সেই দায়িত্ব পালনের জন্যেই বাংলাদেশ ছাড়তে হয়। তাছাড়া ক্রিকেট খেলাটা এমনিতেও অনেক অনিশ্চয়তার খেলা। আর বাংলাদেশের মতো দেশে ক্রিকেট খেলে ওপরে উঠতে গেলে শুধু ভালো খেললেই চলে না, ভাগ্যেরও সহায়তা লাগে, সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়। কিন্তু আমার তো সেই সময় ছিল না। আমি তাই ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই সুইডেনে। লক্ষ্য ছিল, এমবিএ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
সুইডেনে আমি থাকছি গ্যাভলে। এখানকারই গ্যাভল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছি। সত্যি বলতে, সুইডেনেও যে ক্রিকেট খেলা হয়, এটাই আমি জানতাম না। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আমার দুলাভাই থাকেন, তিনি আমার ক্রিকেট-প্রতিভার কথা জানতেন। তাঁর বন্ধু কাজী তুষারের সুইডিশ নাগরিকত্ব আছে। তুষার ভাইকেই দুলাভাই বলেছিলেন, আমাকে কোথাও খেলার সুযোগ করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তুহিন ভাই আমাকে স্টকহোম টাইগার্স ক্লাবের খোঁজ এনে দেন। দলটা সুইডেনের ঘরোয়া লিগে খেলে। সেখানে গিয়ে ক্লাবের অধিনায়ক রাজীব ভাই, সহ-অধিনায়ক, পরিচালকের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা আমাকে প্র্যাকটিসে যেতে বলেন। প্র্যাকটিসে আমাকে দেখে নিশ্চয়ই তাঁদের পছন্দ হয়েছিল। নইলে মূল দলে সুযোগ পেলাম কেন? সেটা ২০১৭ সাল। এবং এখন পর্যন্ত এই দলেই খেলছি আমি। আর সেখানে খেলেই সুযোগ পেলাম জাতীয় দলে।
সুইডেনে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার রাস্তাটা অবশ্য মসৃণ ছিল না। এখানে বছরের পাঁচ/ছয় মাস সব কিছু বরফে ঢাকা থাকে, তুষারপাত ঘটে বলে খাপ খাইয়ে নেওয়াই তো কঠিন আমাদের মতো বাংলাদেশিদের জন্য। ফিটনেস ধরে রাখাও তাই কঠিন। আর সুইডেনে এখন আমি 'ওয়ার্ক পারমিট'-ও পেয়েছি, ম্যাকডোনাল্ডসে শিফট লিডার হিসেবে কাজ করছি। তো কাজের মধ্যে খেলার জন্য সময় বের করাও সহজ না। এমন অনেক দিনই হয়েছে, আমি শুক্রবার রাত আটটা থেকে পরদিন ভোর ছ'টা পর্যন্ত চাকরি সামলে সোজা খেলার মাঠে গিয়েছি, সেখানে পুরো দিন ম্যাচ খেলে আবার কাজে ঢুকেছি, আবার সারা রাত কাজ করে দুই দিন পর ঘুমিয়েছি। রোজার সময়েও একই রুটিন। রোজা রেখে, কাজ করেও খেলা চালিয়ে গিয়েছি। এত কষ্ট করেছি বলেই আল্লাহ হয়তো এখন প্রতিদান দিলেন।
জন্টি রোডস যখন সুইডেনের কোচ হয়ে এলো, তারপর থেকে আরও অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাঁর মতো এত বড় মাপের ক্রিকেটারের সান্নিধ্যে যাওয়ার স্বপ্ন তো সব ক্রিকেটারই দেখে। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই সুযোগ আমি পেয়েছি। সুইডেনের নির্বাচকেরা কিছুদিন আগে সুইডেন জাতীয় দলের জন্য যে ১৪ জনের নাম ঘোষণা করেছে, আমি তাঁদের মধ্যে একজন।
ডাক পাওয়ার পর যে কেমন লাগছিল, তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আরিফ ভাইয়ের (আমার সতীর্থ) কাছ থেকে যখন খবরটা শুনলাম, আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
ধন্যবাদ দিতে চাই বাংলাদেশ জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক কাজী নুরুল হাসান সোহান ভাইকেও। ছোটবেলা থেকেই কিপিংয়ে আমি আদর্শ মেনেছি কুমার সাঙ্গাকারা, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মার্ক বাউচারদের। বুঝতেই পারছেন, কিপিংটাই আমার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিল। এই মুহূর্তে আমি কিপার হিসেবে আদর্শ মানি সোহান ভাইকে। আর আমার জন্য তো তিনি বড় ভাইয়ের ভূমিকাই পালন করেছেন। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, কীভাবে সামনের দিকে আগানো যায়...তা নিয়ে নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছেন, প্যাড-গ্লাভস থেকে শুরু করে ক্রিকেটের অনেক সরঞ্জামও তিনি আমাকে প্রায়ই উপহার দেন। আমি সুইডেন দলে ডাক পাওয়াতে তিনিও অনেক খুশি হয়েছেন। শুভকামনাও জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে আমার কোচ জুয়েল স্যারের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আমার এই পর্যন্ত আসার পেছনে তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। আসলে আমি আমার সব কোচকেই কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। যেমন কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, আমার বাবা-মা, বোন-দুলাভাইকে। আমার সুইডেন জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পেছনে তাঁদের অবদানও তো কম নয়।
জন্টি রোডসের কাছ থেকে কিছু শেখার সুযোগ পাওয়ার স্বপ্নটাও পূরণ হতে যাচ্ছে আমার। তাঁর সঙ্গে ইতোমধ্যেই কয়েকদিন কাজ করেছি, অনেক ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে। অনেক কিছুই শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর ফিটনেস এখনো চমকে দেওয়ার মতো। আর আমার ব্যাটিং-উইকেট কিপিং দেখেও তিনি মুগ্ধ। দল ঘোষণার পর নিজে থেকেই আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছেন, 'তোমার সাথে কাজ করতে মুখিয়ে আছি।' ক্রিকেট খেলাটার একজন লেজেন্ড এ ধরনের কথা বলছেন, এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
আর সব বাংলাদেশির মতো আমারও স্বপ্ন ছিল, জাতীয় দলের হয়ে খেলব। সেই চাওয়াটা পূরণ হচ্ছে সুইডেনকে দিয়ে, তাদের হয়েই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব। দেশটা তো আমার দ্বিতীয় বাড়িই এখন।
বাংলাদেশ আর সুইডেনের মানুষের কাছে আমার একটাও চাওয়া, আমার জন্য দোয়া করবেন। যে ভরসা নিয়ে আমাকে সুইডেন দলে ডাকা হয়েছে, সেটার প্রতিদান যেন দিতে পারি।