বিদায় রিও স্বাগত টোকিও

চলে যাওয়া মানে যেমন প্রস্থান নয়, সমাপনী মানেই তো বিষাদ নয়। যে কারণে রিও অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে উদযাপনই হলো। সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানে নিজেদের গর্ব করার মতো সব কিছুই বিশ্বকে দেখাল রিও।

মারাকানার শব্দকল্লোলে

৭-১ গোলের পরাজয়ের পর ব্রাজিলিয়ান সমাজে এটা অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমই হয়ে গেছে। কারও একটু মুখ গোমড়া দেখলেই নাকি বলা হয়, 'কী রে, মুখটা অমন ৭-১ এর মতো করে রেখেছিস কেন?' ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ফুটবলের ফাইনালে মারাকানার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে শুনতে উৎপল শুভ্র পেয়েছেন একটা নতুন উপমা, 'এ তো দেখছি ২০ আগস্টের মারাকানা।'

কান্নার ব্রাজিল

শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতেই পারেন বোল্ট

বোল্ট অলিম্পিকে নামবেন, দর্শকদের সঙ্গে খুনসুটি করবেন, স্বর্ণ জিতবেন--এটাই তো নিয়ম হয়ে ছিল রিও অলিম্পিক পর্যন্ত। ১০০ মিটারের পর অলিম্পিকে ২০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণও টানা তৃতীয়বারের মতো জিতে বোল্ট তাই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, 'গ্রেটেস্ট হতে হলে আমাকে আর কী করতে হবে?'

‘আমার আর কিছু প্রমাণ করার নেই’

ফ্লো-জোর পর প্রথম ‘স্প্রিন্ট ডাবল’

এলেইন থম্পসন অলিম্পিকে এসেছিলেন মসৃণভাবে দৌড় শেষ করতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছিলই, অলিম্পিক ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের পর কোনো মেয়ের প্রথম স্প্রিন্ট ডাবল-ও দেখেছিল থম্পসনের পায়ে।

স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি নেইমাররা

দীর্ঘ একটা সময় দুর্বোধ্য এক ধাঁধা হয়ে ছিল এই তথ্যটা যে, অলিম্পিক ফুটবলে কখনো সোনা জেতেনি ব্রাজিল। ঘরের মাঠের অলিম্পিকে সেই আক্ষেপ ঘোচাতেই আঁটঘাঁট বেঁধে নেমেছিল ব্রাজিল। প্রথম দুই ম্যাচে কোনো গোল পায়নি, তারাই এরপর থেকে যেন ইচ্ছামতো গোল করছে। ডেনমার্ককে ৪-০ গোলে হারিয়ে শুরু, এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২-০। আর সেমিফাইনালে ওই দুই ম্যাচের সমান ৬ গোল করে পৌঁছে গিয়েছিল স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি।

‘মেসি’ হয়েই থাকলেন মার্তা

একটা জায়গায় মেসির চেয়েও এগিয়ে তিনি। মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি ফিফা ব্যালন ডি'অর জিতেছেন টানা চারবার। মার্তা টানা পাঁচবারের বিশ্বসেরা। অথচ সেই মার্তার দেশের হয়ে কিছুই জেতা হয়নি। 'স্কার্ট পরা পেলে' এখানেই 'মেসি' হয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে পরিপূর্ণ, কিন্তু দেশের জার্সি গায়ে শুধুই শূন্যতা; এই কোপা আমেরিকার আগে তো লিওনেল মেসিই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে ছিলেন।

নতুন নায়ক পেয়ে গেছে ব্রাজিল

অলিম্পিক যদি হয় স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মঞ্চ, তবে থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণই হবেন। রিও অলিম্পিকের আগের বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছিলেন ১৯তম, অলিম্পিক শুরুর পাঁচ মাস আগের বিশ্ব ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে ১২তম। সেই তিনিই রিওতে অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে জিতেছিলেন সোনা, ছাড়িয়েছিলেন ৬ মিটারের ব্যারিয়ার।

বয়সকে জয় করা তাঁরা দুজন

উসাইন বোল্ট দৌড় ছেড়েছেন বয়স ৩০ পেরোতে না পেরোতেই। অ্যাথলেটিকসের দুনিয়ায় এটাই অবশ্য অবসর নেওয়ার স্বাভাবিক বয়স। `ব্যতিক্রম` হতে চাওয়া অ্যাথলেটদের জন্য তাই বোল্ট উদাহরণ হতে পারবেন না, সে জন্যে তাকাতে হবে কিম কলিন্স আর ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউনের দিকে। রিও অলিম্পিকে দুজন অংশগ্রহণ করেছিলেন ৪০ আর ৩৪ বছর বয়সে!

দ্রুততম মানবের হ্যাটট্রিকের সেই রাত

চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে টানা দ্বিতীয়বার `ট্রিপল` জিতেই সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের স্বীকৃতি পাওয়া হয়ে গিয়েছিল বোল্টের। তারপরও কারও মনে ক্ষীণতম সংশয় থেকে থাকলে সেটিও মুছে দিয়েছেন রিওতে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই অলিম্পিকে তিনটি ১০০ মিটার জেতেননি আর কেউ। তবে বোল্টকে কে যেন বলেছেন, অমরত্ব পেতে তিনটি অলিম্পিকে ট্রিপল জিততে হবে। বোল্ট রিওতে এসেছিলেন সেই অমরত্বকে ধাওয়া করতেই।

হ্যাটট্রিক হচ্ছে বোল্টের?

১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪×১০০ মিটার রিলের স্বর্ণ জিতেছিলেন বেইজিং আর লন্ডনে। উসাইন বোল্ট তাই রিওতে এসেছিলেন `ট্রিপল ট্রিপল` জয়ের লক্ষ্য নিয়ে। অর্জনের বিশালত্ব বোঝাতে একটি তথ্যই যথেষ্ট, অলিম্পিকে `ডাবল ট্রিপল`-এর রেকর্ডও কারও ছিল না বোল্টের আগে।

আপন ঠিকানায় বিচ ভলিবল

যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম হলে কী হবে, কোপাকাবানা হলো বিচ ভলিবলের সবচেয়ে বিখ্যাত লালনভূমি। সৈকতে অসংখ্য খুঁটি বসানো আছে। একটা নেট টানিয়ে খেলা শুরু করে দিলেই হয়! রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কোপাকাবানায় রীতিমতো বিচ ভলিবলের উৎসব শুরু হয়ে যায়। সেই কোপাকাবানাতেই বানানো অস্থায়ী স্টেডিয়ামেই বসেছিল রিও অলিম্পিকের বিচ ভলিবল।

নতুন ইতিহাস গড়ার পর ফেলপস

মাইকেল ফেলপসের কাছে অলিম্পিক মানেই পদক, যার বেশির ভাগের রংই সোনালি। তারপরও রিওতে ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলের সোনাটা একটু অন্যরকমই ছিল। সাঁতারে এক ইভেন্টে চারটি অলিম্পিকে সোনা জয়ের কীর্তি এই প্রথম। সব খেলা মিলিয়েও ফেলপসের পাশে আর মাত্র দুজন। সেই ইতিহাস গড়ার পর ফেলপস যা বলেছিলেন।

শুধু সোনাই জেতেননি ম্যানুয়েল

ইভেন্টটা হওয়ার কথা ছিল কেট নয়তো ব্রন্টি ক্যাম্পবেলের। সেই কেট ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার শেষ করলেন ষষ্ঠ হয়ে, ব্রন্টি ৪ নম্বরে থেকে। স্বর্ণ জিতেছিলেন সিমোন ম্যানুয়েল, অলিম্পিক দূরে থাক, আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতাতেই যাঁর এর আগে কখনো সোনা জেতা হয়নি।

কোথায় থামবেন ফেলপস!

২০০৮ অলিম্পিকের মাস চারেক পর বাজারে এসেছিল তাঁর আত্মজীবনী। যেটির নাম নো লিমিটস। নিচে ছোট করে লেখা ছিল আরও চারটি শব্দ-দ্য উইল টু সাকসেস। সাফল্য পাওয়ার জন্য তীব্র ইচ্ছাশক্তি সব চ্যাম্পিয়নেরই থাকে। সেটাই তাঁদের চ্যাম্পিয়ন বানায়। সেটি তাই চলছে না। মাইকেল ফেলপসকে বোঝাতে বইয়ের মূল নামটাই বোধ হয় বেশি উপযুক্ত—নো লিমিটস!

‘প্রতিবেশী’ যখন কোপাকাবানা

রিও অলিম্পিক কাভার করতে গিয়ে উৎপল শুভ্র প্রথমে উঠেছিলেন এক হোটেলে। তবে হোটেল ভাড়ার উচ্চমূল্যের কারণেই হোক বা একঘেয়েমির কারণে, পরে উঠেছিলেন এক অ্যাপার্টমেন্টে। কোপাকাবানার ঠিক ওপরে দাঁড়ানো ওই অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর একঘেয়েমিতে ভোগার কোনো কারণ ছিল না। সাগর তো কখনো একঘেয়ে হয় না!

রাফায়েলা ও তাঁরা দুজন

রিওর সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এক এলাকায় জন্ম রাফায়েলার। যেখানে চুরিচামারি, খুনখারাবি ছিল প্রতিদিনের রুটিন ব্যাপার। একসময় পুলিশও যেখানে যেতে ভয় পেত। সেই নরক থেকে উঠে এসে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন-রাফায়েলা সিলভাকে কী করতে হয়েছে, তা তিনি নিজে জানেন আর জানেন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর।

নিজের সেরাটাও হলো না বাকির

অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখা তো বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের জন্য দূর অস্তই, লক্ষ্যটা তাই থাকে নিজের সেরা স্কোর করার। রিও অলিম্পিকে গিয়ে বাকিরও একই লক্ষ্য ছিল। তবে বাকি ছুঁতে পারেননি সেটাও। সান্ত্বনা হয়ে ছিল একটা তথ্যই, আরও অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া শুটাররাও শেষ করেছিলেন বাকির পেছনে থেকে।

হাঁটতে হাঁটতে গলদঘর্ম!

বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটে যেমন এক শহর থেকে আরেক শহরে চক্করের ওপর থাকতে হয়, অলিম্পিকে সেই সমস্যা নেই। এক শহরেই সব। একবার নেমে পড়লে ফেরার আগে আর এয়ারপোর্টমুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটাকে যদি শান্তি বলেন, চরম অশান্তি হয়ে বিদ্যমান এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুর দূরত্ব। আর সেই অলিম্পিক যদি ব্রাজিলে হয়, তাহলে সমস্যাটা আরও গুরুতর রূপ ধারণ করে।

ফেলপস-লোকটির উত্তরাধিকার হাগিনো-চেজ-সেতো

৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলেতে এক সময় সেরা ৭টি টাইমিংয়ের ৬টিই ছিল ফেলপস কিংবা লোকটির দখলে। রিও অলিম্পিকে তাঁদের দুজনের একজনও ছিলেন না পুলে, মঞ্চটা তাই হয়ে গিয়েছিল নতুনদের। হাগিনো-চেজ-সেতো ওই সুযোগটাই লুফে নিলেন দু`হাত ভরে৷ লুফে নিলেন হাঙ্গেরির কাতিনকা হসুও। এর আগ পর্যন্ত অলিম্পিক যাঁর কাছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধাই হয়ে ছিল।

এত দূরে এসেও টেলিভিশনে!

হোটেলে যখন চেক ইন করছি, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনো ঘণ্টা আড়াই বাকি। বিমানযাত্রার ধকলকে পাত্তা না দিয়ে মারাকানায় যাওয়ার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু শরীর আপত্তি জানাল। সঙ্গে মনও। অলিম্পিক মাত্র শুরু হচ্ছে। আগামী ১৬ দিন বিস্তর খাটাখাটনির ব্যাপার আছে। শেষ পর্যন্ত তাই টেলিভিশনেই রিও অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।