একবার নয়, দুইবার দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব শাহ আলম
দুলাল মাহমুদ
১৫ জুলাই ২০২১
স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ সিরিজে ধারাবাহিকভাবে উঠে আসছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেরই ইতিহাস। স্মরণীয় ঘটনা, ঐতিহাসিক ম্যাচ, বিভিন্ন খেলার কিংবদন্তি সব খেলোয়াড়, ক্রীড়াঙ্গনে আলোড়ন তোলা কোনো অতিথি...সব কিছুই আসছে এই `সেরা ৫০`-এর বিবেচনায়। আজ ২৩তম পর্বে থাকছে দুটি সাফ গেমসের দ্রুততম মানব মো. শাহ আলমের কথা।
১৯৮৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ গেমসেই তিনি স্বর্ণপদক জয় করেন। জীবনে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এমন সাফল্য পেলে যে কোনো অ্যাথলেটের খুশি হওয়ার কথা। সঙ্গত কারণে তিনিও খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এই অসন্তুষ্টিই তাঁর জয়ের ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দেয়। এর কারণ হতে পারে, সেবার তিনি এককভাবে পদক জিততে পারেননি। স্বর্ণজয়ী ৪×১০০ মিটার রিলে দৌড়ে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মজিবুর রহমান মল্লিক, আফতাব মোল্লা ও সাইদুর রহমান ডন। এছাড়া সাইদুর রহমান ডন, শহিদ উল্লাহ ও সুবল চন্দ্র সরকারকে নিয়ে ৪×৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক।
তখন থেকেই এককভাবে স্বর্ণপদক জয়ের সংকল্প করেন মো. শাহ আলম। সেই আলোকে কঠোর প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে শান্ত-শিষ্ট মনে হলেও ভিতরে ভিতরে তিনি ছিলেন অসম্ভব জেদি, আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিবিড় অনুশীলন করেছেন। তাঁর শ্রম, নিষ্ঠা ও নিবেদনের ফল পেতে দেরি হয়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরের বছরের সাফ গেমসে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন শাহ আলম। সময় নেন ১০ দশমিক ৮০ সেকেন্ড। পাকিস্তানের মুহাম্মদ শাহের সঙ্গে তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। কয়েক মাইক্রো সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হন। দক্ষিণ এশিয়ার শত কোটি মানুষের মধ্যে দ্রুততম মানব হওয়ার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে গৌরবময়। খর্বকায় বাঙালি যে দুরন্ত গতিতে ছুটতে পারে, সেটা তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন। এই গেমসে দ্বিতীয়বার ৪×১০০ মিটার রিলে দৌড়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন সাইদুর রহমান ডন, শাহ জালাল মোবিন ও আনোয়ার হোসেন। এছাড়া ২০০ মিটার দৌঁড়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। এই সাফল্যে তিনি আত্মতৃপ্ত না হয়ে এটিকে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে নেন।
১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে তিনি দ্বিতীয়বার দ্রততম মানব হন। সময় নেন ১০ দশমিক ৭৯ সেকেন্ড। নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন। পর পর দুইবার দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হওয়াটাই বুঝিয়ে দেয়, শাহ আলম ছিলেন জাত স্প্রিন্টার। নিজের প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব আস্থা ও আত্মবিশ্বাস। কলকাতায় যাওয়ার পর স্থানীয় সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি স্বর্ণপদক পাবেন কি না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জয়ের ব্যাপারে তাঁর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। স্বর্ণপদক জয় করে তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। টানা তিনটি সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের যে এই কৃতিত্ব শাহ আলমের, তা দেশের আর কোনো অ্যাথলেটের নেই। কলকাতায় 'স্প্রিন্ট ডাবল'-ও হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু ২০০ মিটারে অল্পের জন্য স্বর্ণপদক জিততে পারেননি। ভারতের আনন্দ শেঠী ২১ দশমিক ৬৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে জয় করেন স্বর্ণপদক। শাহ আলম সময় নেন ২১ দশমিক ৬৮ সেকেন্ড। সেই গেমসে ৪×১০০ মিটার রিলে দৌড়েও রৌপ্যপদক পেয়েছেন। সঙ্গে ছিলেন মজিবুর রহমান মল্লিক, আনোয়ার হোসেন ও শাহানউদ্দীন চৌধুরী। ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ৪×৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে তিনি ছাড়া ছিলেন মোস্তাক আহমেদ, আবদুল কাদের সরকার ও গিয়াসউদ্দিন।
১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি শাহ আলম। ৪×১০০ মিটার রিলে দৌঁড়ে রৌপ্য এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্রোঞ্জ পদকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে। রিলে দলে তার সঙ্গে ছিলেন শাহ জালাল, শাহানউদ্দিন চৌধুরী ও মেহেদি হাসান। শাহ আলমের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় অ্যাথলেট হিসেবে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় দ্রুততম মানব হন বিমল চন্দ্র তরফদার। এরপর আর কেউ এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। বিমলের আইডল ছিলেন শাহ আলম। এস এ গেমসে অ্যাথলেটিকসে এ পর্যন্ত আটটি স্বর্ণপদক পেয়েছে বাংলাদেশ, তার মধ্যে চারটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাহ আলমের নাম। এমন সাফল্যও বাংলাদেশের আর কোনো অ্যাথলেটের নেই।
সাফ গেমস ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন শাহ আলম। এরমধ্যে ১৯৮৬ সালে ২১তম পাকিস্তান গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী ৪×১০০ মিটার রিলে দৌড় দলের সদস্য, ১৯৮৮ সালে ২২তম পাকিস্তান গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক এবং স্বর্ণপদক জয়ী ৪×১০০ মিটার রিলে দলের সদস্য, ১৯৮৯ সালে কুয়েতে ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড পিস গেমসে রৌপ্যপদক জয়ী ৪×১০০ মিটার রিলে দলের সদস্য ছিলেন।
মেহেরপুরের সন্তান শাহ আলমের জীবন মোটেও সহজ, সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। তবে কোনো কিছুতে তিনি পরাভব মানেননি। দারিদ্র্যের কাছে যেমন হার মানেননি, তেমনিভাবে খেলার মাঠে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সাত ভাই আর তিন বোনের সংসারে খেলাধুলা করাটা ছিল রীতিমতো বিলাসিতা। কিন্তু তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শৈশব থেকেই ঝুঁকে পড়েন খেলাধুলায়। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর নিজের ইচ্ছে পূরণের সুযোগ পেয়ে যান। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আন্তঃ ইউনিট প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন।
তারপর অংশ নেন জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায়। ১৯৮৪ সাল থেকে পেতে থাকেন সাফল্য। সেবার জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার সেনাবাহিনীর হয়ে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। ১৯৮৫ সালে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক, ১৯৮৬ সালে ১০০ মিটারে স্বর্ণ ও ২০০ মিটারে রৌপ্যপদক, ১৯৮৭ সালে ১০০ ও ২০০ মিটারে স্বর্ণপদক, ১৯৮৮ সালে ২০০ মিটারে স্বর্ণপদক, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ গেমসে ১০০ ও ২০০ মিটারে স্বর্ণপদক এবং ১৯৯০ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ২০০ মিটারে স্বর্ণ ও ১০০ মিটারে রৌপ্যপদক জয় করেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর রিলে দৌঁড়ের সদস্য হিসেবে সাফল্য পেয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাঁকে ১৯৮৫ সালে সেরা অ্যাথলেট ও ১৯৮৭ সালে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত করে এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরষ্কার পেয়েছেন। মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৯০ সালের ২৯ মে শাহ আলমের ক্যারিয়ার আচানক থেমে যায়। বেইজিং এশিয়ান গেমসে তাঁর পদক জয়ের স্বপ্ন ছিল। সেই লক্ষ্যে অ্যাথলেটিকস ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার জন্য মোটরসাইকেলে মেহেরপুর থেকে ঢাকায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর প্রাণহানি ঘটে। শেষ হয়ে যায় তাঁর পদক জয়ের স্বপ্ন। বাংলাদেশ হারায় তাঁর সেরা অ্যাথলেটকে। ১৯৯১ সালে তিনি পেয়েছেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, পরবর্তী প্রজন্মের অ্যাথলেটদের কাছে সেটাই হয়ে ওঠে একটা মানদণ্ড। দক্ষিণ এশিয়ায় যদি দ্রুততম মানব হওয়া যায়, তাহলে আরও বড় সাফল্য পাওয়া মোটেও অসম্ভব নয়, এই বিশ্বাস তিনি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।