ঢাকায় সাফ গেমসের প্রথম উৎসব
দুলাল মাহমুদ
৫ জুলাই ২০২১
শুধু তো ক্রীড়াবিদরাই নন, স্মরণীয় সব খেলোয়াড়ি অর্জনও শুধু নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০-এ উঁকি দিয়ে যায় বাংলাদেশে বড় বড় প্রতিযোগিতার আয়োজনও। ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশকে নিয়ে আয়োজত দ্বিতীয় সাফ গেমসই যেমন হয়ে আছে অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতার নাম।
এর আগে ঢাকায় এশীয় যুব ফুটবল, আন্তর্জাতিক রেটিং দাবা, এশীয় সাঁতার, এশীয় কাপ হকির মতো বড় আসর বসলেও তা ছিল নির্দিষ্ট একটি খেলার আয়োজন। কিন্তু সাতটি খেলার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের সঙ্গে তার কোনও তুলনা চলে না। ১৯৮৫ সালের ২০ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয়ান (সাফ) গেমস। এই ভূখণ্ডে এ ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল একদমই নতুন। অবশ্য ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে প্রথম সাফ গেমস আয়োজিত হওয়ার কথা ছিল। যে কারণেই হোক সেবার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। হলে সেটা অন্য রকম একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত। তারপরও শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এই গেমস আয়োজন, পরিসর ও প্রভাবের দিক দিয়ে স্থাপন করে নতুন এক মাইলফলক।
এতগুলো দেশকে নিয়ে বাংলাদেশে এমন বড় মাপের একটি গেমস ইতিপূর্বে কখনও আয়োজিত হয়নি। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে যেন মেলবন্ধন ঘটে দক্ষিণ-এশিয়ার সাতটি বর্ণিল রঙের। স্ব স্ব দেশের খেলাধুলার মান যাচাই, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সামর্থ্য প্রমাণ, সর্বোপরি ক্রীড়া ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাঠমান্ডুর পর ঢাকায় অভিন্ন পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর সদস্য ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। রংধনুর সাত রঙের মতো এই ক্রীড়া উৎসব সত্যিকার অর্থেই একটা উৎসবের আবহ ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা দেশে।
গেমসের ডিসিপ্লনগুলোর মধ্যে ছিল অ্যাথলেটিকস, বক্সিং, ফুটবল, সাঁতার, ভারোত্তোলন, কুস্তি ও কাবাডি। সেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয় কাবাডি। এমন একটি মাল্টি-স্পোর্ট ইভেন্ট আয়োজন করা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই ধরনের একটা আয়োজন সুসম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে অসংখ্য মানুষের মেধা, মনন, কর্মনিষ্ঠা আর পারস্পরিক যোগসূত্র। বাংলাদেশের এ ধরনের গেমস আয়োজনের কোনও রকম অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু ছিল অপরিমেয় ইচ্ছেশক্তি, প্রগাঢ় আন্তরিকতা ও গভীর অনুরক্তি। এ আয়োজনকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। দেশের সম্মানকে তুলে ধরার প্রত্যয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়। নতুন অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি পুরানো ভেন্যুগুলোকে নতুনভাবে সংস্কার করা হয়। নানান রঙে, নানান রূপে, নানান আঙ্গিকে সেজে ওঠে দেশের ক্রীড়াঙ্গন।
ঢাকা স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ও সমাপনী এবং ফুটবল; আউটার স্টেডিয়ামে কুস্তি ও বক্সিং; বনানীর এরশাদ আর্মি স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিকস, ভলিবল স্টেডিয়ামে কাবাডি, জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুইমিং পুলে সাঁতার ও জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের জিমনেসিয়ামে ভারোত্তোলন আয়োজন করা হয়। ঢাকা স্টেডিয়ামের উত্তর গেটের মাথায় নির্মাণ করা হয় সাফ গেমসের কংক্রিটের মশাল স্ট্যান্ড। কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের ডিজাইনে গড়া সেই মশাল স্তম্ভটি দীর্ঘ দিন গেমসের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
ঢাকা স্টেডিয়াম এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজে উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের মহড়া আর বিভিন্ন ভেন্যুতে চলে নিরন্তর প্রশিক্ষণ। তিন মাসেরও কম সময়ে কয়েক হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা মোটেও সহজ ছিল না। উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের মহড়াকে কেন্দ্র করে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। এই দুই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আমিন আহম্মদ চৌধুরী। সবকিছু নিখুঁতভাবে করার জন্য তিনি একটুও ছাড় দেননি। যাঁকে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে, সেখানেই তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে কোমলে-কঠিনে কাজ আদায় করে নিয়েছেন তিনি। তিনি এই কর্মকাণ্ডকে নিয়েছিলেন মিশন ও ভিশন হিসেবে। এই গেমসকে কেন্দ্র করে বীর এই মুক্তিযোদ্ধা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। এমনটা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।
এই গেমস উপলক্ষে চীন থেকে আসে ডিসপ্লে বিশেষজ্ঞ একটি দল। এই দলের তত্ত্বাবধানে বাঙময় হয়ে ওঠে স্টেডিয়ামের গ্যালারি। রিদমিক শারীরিক কসরত, কোরিওগ্রাফ আর গ্যালারি ডিসপ্লের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তাঁর অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ‘ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’। এটিই ছিল গেমসের অন্যতম আকর্ষণ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক কবি ও গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ গেমস উপলক্ষে একাধিক গান রচনা করেন। সংগীত পরিচালনা করেন সুরকার ও সংগীত পরিচালক সমর দাস। ডিসপ্লে বোর্ডসহ আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালন করেন চারু ও কারুকলা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক। তাঁর সহযোগী ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুল বাসেত। সব মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে কল্লোলিত হয়ে ওঠে ঢাকা। চারপাশে যেন ছড়িয়ে পড়ে শচীন দেব বর্মণের গাওয়া গানের আমেজ...
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে
হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
একি তব হরি খেলা
তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন
তুমি যে রসেরও ধারা
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা
করে মোরে দিশাহারা
সাফ গেমসের মাসকট ছিল ‘মিশুক’। এর পরিকল্পনা আর ডিজাইন করেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, আবদুর রাজ্জাক ও মুস্তাফা মনোয়ার। হরিণ শাবকের আদলে এটি তৈরি করা হয়। তার নিস্পাপ চকিত চাহনি জয় করে নেয় সবার হৃদয়। আর গেমসের প্রতীক ‘দুরন্ত দুই’-এর শিল্পী ছিলেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। এই গেমস উপলক্ষে শৈল্পিকভাবে সাজানো হয় ঢাকাকে।
সাফ গেমসে সাত দেশের সাত শতাধিক ক্রীড়াবিদ অংশ নেন। গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান ছিল দেশবাসীর জন্য বড় ধরনের একটি চমক। এমন ঝলমলে আয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একদমই পরিচিত ছিলেন না। জমকালো এই অনুষ্ঠান সবাইকে দারুণভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। নির্দিষ্ট লয়ের তালে তালে শারীরিক কসরত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, গ্যালারি ডিসপ্লে ধাঁধিয়ে দেয় চোখ ও মন। এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। মেয়েদের সংখ্যাই ছিল বেশি। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও দিনের পর দিন পুরো অনুষ্ঠানকে একই সুতোয় গাঁথার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ছিলেন সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। এটিও ছিল এদেশের জন্য নতুন।
পুরো অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দেওয়া হয় বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধকে। তুলে ধরা হয় হাজার বছরের আবহমান বাঙলার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সুরে-সংগীতে, ছন্দে-নৃত্যে, রঙে-দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে এ দেশের চিরায়ত জীবনধারা। গ্যালারি ডিসপ্লের বড় একটা অংশ রাঙিয়ে দেয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সৃষ্টিকর্ম। নানান রঙের ঝলক দেখায় আতশবাজির ফোয়ারা। বর্ণিল হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ। একটি গেমসকে কেন্দ্র করে এ দেশকে যেভাবে মেলে ধরা হয়, তা ছিল অতুলনীয়।
সে সময় এশিয়ান অ্যাথলেটিকসে সাড়া জাগানো নাম ছিলেন পি টি উষা। মাস তিনেক আগে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যক্তিগত চারটিসহ পাঁচটি স্বর্ণ ও একটি ব্রোঞ্জ পদক জয় করে হইচই ফেলে দেন। এ কারণে তাঁকে ঘিরে অন্য রকম এক ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। তাঁরও গেমসে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। এই 'গোল্ডেন গার্ল' এলে গেমসের আকর্ষণ অনেকখানি বেড়ে যেত। তিনি না আসায় গেমসের 'গ্ল্যামার গার্ল' হয়ে ওঠেন তাঁরই স্বদেশি অ্যাথলেট সাইনি আব্রাহাম। তিনিই ছিলেন গেমসের সবচেয়ে বড় তারকা। তাঁর ছিল ছেলেদের মতো বয়কাট চুল। বেশ চটপটে। চেহারায়ও আলাদা একটা শ্রী ছিল। ঢাকায় আসার কিছুদিন আগেই জাকার্তায় এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটার স্প্রিন্ট, ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলে দৌঁড়ে স্বর্ণ আর ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে রৌপ্যপদক জয় করেন। এমনিতেই তিনি ছিলেন টপ-ফেবারিট। সাফ গেমসে দুটি ব্যক্তিগত ইভেন্ট ২০০ ও ৮০০ মিটার এবং দুটি দলগত ইভেন্ট ৪ গুণন ১০০ এবং ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে অংশ নিয়ে সবটিতেই স্বর্ণপদক অর্জন করে নিজেকে সেরা অ্যাথলেট হিসেবে প্রমাণ করেন। তিনটিতে গড়েন নতুন সাফ রেকর্ড। সাফল্য ও সৌন্দর্য দিয়ে তিনি সবার হৃদয় জয় করে নেন।
এছাড়া সাফল্য দিয়ে যাঁরা নজর কাড়তে সক্ষম হন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সাঁতারে মোশাররফ হোসেন খান (বাংলাদেশ), ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা শিশির ঘোষ (ভারত), কাবাডিতে সুখবিন্দর সিং (ভারত), কুস্তিতে আবদুল মজিদ (পাকিস্তান), ভারোত্তোলনে জি মথুস্বামী (ভারত), বক্সিংয়ে এস. জয়রাম (ভারত), অ্যাথলেটিকসে শাহ আলম (বাংলাদেশ) প্রমুখ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোশাররফের এককভাবে পাঁচটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্যপদক জয় আর শাহ আলমের শত কোটি মানুষের 'দ্রুততম মানব' হওয়াটা ছিল অসাধারণ কৃতিত্ব। পদক তালিকায় ভারত আর পাকিস্তানের পরই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া উৎসব সাফ গেমস বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের একটা ছাপ রেখে যায়। এই আসরের মাধ্যমে অনেক ক্রীড়াবিদ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কেউ কেউ পদকও জয় করেন। বিস্তৃত হয়েছে অনেকের স্বপ্নের পরিধি। সংগঠকরা পেয়েছেন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার তালিম। বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এই গেমস। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বড় বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনে দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে। প্রকৃত অর্থেই যার বীজ বপন করে দিয়েছিল দ্বিতীয় সাফ গেমস।