বেডসার-ম্যাসির শুরু, ট্রুম্যানের শেষ
২২ জুন মিলিয়ে দিয়েছে তাঁদের তিনজনকে
উৎপল শুভ্র
২২ জুন ২০২১
বব ম্যাসি, অ্যালেক বেডসার ও ফ্রেড ট্রুম্যান--এই তিন বোলারকে বিনি সুতোর মালায় গেঁথে রেখেছে ২২ জুন। এই দিনেই প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন বেডসার আর ম্যাসি। ট্রুম্যান ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। কাকতালীয়ভাবে তা একই মাঠে, লর্ডসে। তিন জনের শুরু ও শেষ ধরে তাঁদের জীবনের গল্প উৎপল শুভ্রর এই বিশেষ লেখায়।
অ্যালেক বেডসার পৃথিবী ছেড়ে গেছেন প্রায় ১১ বছর আগে। দীর্ঘায়ুই পেয়েছিলেন, ২০১০ সালে শেষবারের মতো নিঃশ্বাস ফেলার ঠিক তিন মাস আগে পালন করেছেন ৯২তম জন্মদিন। বয়সে প্রায় তের বছরের ছোট হয়েও ফ্রেড ট্রুম্যান চলে গেছেন এরও বছর চারেক আগেই। ৭৫ বছরের জীবনটা অবশ্য পরিপূর্ণভাবেই যাপন করে গেছেন। ফ্রেড ট্রুম্যানকে নিয়ে তো গল্পের শেষ নেই। ডব্লিউ জি গ্রেস ছাড়া আর কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে এত গল্প চালু আছে বলে মনে হয় না। তার কিছু সত্যি, কিছু বানানো, কোনো কোনোটাতে হয়তো সত্যি-মিথ্যের মিশেল। ট্রুম্যান তাঁকে নিয়ে এসব গল্প উপভোগ করতেন। নিজেও খুব সরসভাবে বর্ণনা করতেন বলে যে কারণে আফটার ডিনার স্পিকার হিসেবে বিপুল চাহিদা ছিল তাঁর। বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালে ক্রিকেট কমেন্ট্রিও করেছেন অনেক বছর।
এই গল্পের তৃতীয়জন বব ম্যাসিও রেডিও কমেন্টটর হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান তো, তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল তাই এবিসি রেডিও। প্রথম দুজন স্বর্গবাসী হলেও বব ম্যাসি এখনো ধরাধামে বর্তমান। বয়স হয়েছে, গত বাংলা নববর্ষের দিন ৭৪তম জন্মদিন উদযাপন করলেন, বাড়ি থেকে তাই খুব একটা বেরোন না।
বেরোলেই বা কি, এই তিনজনের তো আর আজ একত্র হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নইলে কল্পনায় তিনজনকে একসঙ্গে বসিয়ে দেওয়া যেত। তা না হয় যাচ্ছে না, কিন্তু বাকি দুজনকে নিয়ে কল্পনার একটা খেলা তো খেলাই যায়। এমন যদি হয়, আজ স্বর্গে একই টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছেন তাঁরা দুজন। ফ্রেড ট্রুম্যান আর অ্যালেক বেডসার।
আড্ডার বিষয়? বিষয় একটাই, ২২ জুন।
২২ জুনই এই তিনজনকে গেঁথেছে বিনি সুতোর এক মালায়। ২২ জুনেই অ্যালেক বেডসার আর বব ম্যাসির শুরু আর ফ্রেড ট্রুম্যানের শেষ। ১৯৪৬ সালের ২২ জুন টেস্ট অভিষেক হয়েছিল বেডসারের। ১৯ বছর পর, ১৯৬৫ সালের ২২ জুন ছিল ট্রুম্যানের বর্ণাঢ্য টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ দিন। এরও সাত বছর পর, ১৯৭২ সালের ২২ জুন টেস্ট ক্রিকেটে বব ম্যাসির আবির্ভাব। এই তিনটি ঘটনাই যে লর্ডসে, সেই বিস্ময় কাটানোর জন্য ‘কাকতালীয়’ শব্দটিকেও ঠিক যথেষ্ট মনে হচ্ছে না।
টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ উইকেটের এভারেস্টে প্রথম পা রাখার কৃতিত্বটি তাঁর, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদেরই একজন ফ্রেডি ট্রুম্যান, ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্রগুলোরও একটি। ৬৭ টেস্টে মাত্র ২১.৫৭ গড়ে ৩০৭ উইকেট আর তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া বেশির ভাগই সত্যি আর সামান্য অতিরঞ্জিত অসংখ্য গল্প পেছনে রেখে ১৯৬৫ সালের যে ২২ বিদায় নিলেন ট্রু্ম্যান, সে দিনটিতে তাঁকে সেভাবে দেখতেই পায়নি দর্শকরা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করছিল ইংল্যান্ড, ট্রুম্যানের তাই বোলিং করার প্রশ্নই নেই। মাত্র ৩ উইকেট হারিয়েই ইংল্যান্ড ২১৬ রানের জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ায় তাঁকে ব্যাট করতেও নামতে হয়নি। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর শেষ দিনটিকে ঘিরে ট্রুম্যানের তাই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কোনো স্মৃতি নেই।
অ্যালেক বেডসার আর বব ম্যাসির কাছে তা নয়। তাঁদের কাছে ২২ জুন তারিখটি স্বপ্নপূরণের অন্য নাম, আবেগ-উত্তেজনায় বিনিদ্র রাত কাটানোর পর স্বপ্নের হাত ধরে ভেসে যাওয়ার দিন। বেডসারের বাড়িতে কল্পিত আড্ডাটা যদি হয়ই, তাহলে কিছুক্ষণ পরই ম্যাসি চুপচাপ হয়ে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবেন, বেডসারকে হয়তো সান্ত্বনাও দিতে হতে পারে তাঁকে। কারণ ২২ জুন তারিখটি অ্যালেক বেডসারের জন্য রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া প্রভাত হলেও ম্যাসির জন্য যে তা নয়। তাঁর বেলায় প্রভাত দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়নি। তাঁর দিনের যতটুকু আলো, তা ওই প্রভাতেই শেষ।
ক্রিকেট ইতিহাসে বব ম্যাসির আবির্ভাব আর হারিয়ে যাওয়া বোঝাতে পারে একটু শব্দই—ধূমকেতু! ধূমকেতুর মতোই ম্যাসির আবির্ভাব, ধূমকেতুর মতোই পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। ১৯৭২ সালের ২২ জুন লর্ডসে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর প্রথম দিনেই ইংল্যান্ডের পাঁচ ব্যাটসম্যানকে বধ করলেন ম্যাসি। সে দিন ৭টি উইকেট পড়েছিল ইংল্যান্ডের, বাকি ২টি নিয়েছিলেন ডেনিস লিলি। পর দিন ইনিংসের বাকি ৩টি উইকেটও নিয়ে বসলেন ম্যাসি। সেখানে থেমে থাকলেও কথা ছিল। ইচ্ছেমতো বল সুইং আর সোয়ার্ভ করিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসেও ম্যাসির ৮ উইকেট। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৩৭ রানে ১৬ উইকেট, অভিষেক সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল তা ১৫ বছর, মাত্র ১ রান কম দিয়ে ১৬ উইকেট নিয়ে রেকর্ডটি ভেঙেছেন ভারতীয় লেগ স্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি।
অভিষেক টেস্টেই যাঁর ১৬ উইকেট. পুরো ক্যারিয়ারে তাঁর অর্জন মাত্র ৩১ উইকেট। সেই ক্যারিয়ারও মাত্র ৬ টেস্টের, সময়ের হিসেবে স্থায়ী মাত্র ২০৩ দিন। নটিংহ্যামে সে সিরিজেরই পরের টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন, টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম তিন ইনিংসেই যাঁর ২০ উইকেট, তাঁর ক্যারিয়ার কেন ৬ টেস্টে ৩১ উইকেটেই শেষ হয়ে গেল, তা এক রহস্য হয়েই রয়েছে। ইংল্যান্ডে অভিষেক সিরিজে ৪ টেস্ট খেলার পরের মৌসুমে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেন দুটো টেস্ট। সেটাই শেষ, ১৯৭৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে স্কোয়াডে থাকলেও টেস্ট দলে ঢোকার মতো ফর্মের প্রমাণ রাখতে পারেননি। লর্ডস টেস্টে তাঁর বল সুইং করানোর যে ক্ষমতাকে খাওয়া-ঘুমুনোর মতোই সহজাত ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল, রহস্যজনকভাবে হারিয়ে ফেলেন সেটিই। সেই রহস্যের উত্তর হিসেবে ফিসফাস শোনা গিয়েছিল, বলে ঠোঁটে দেওয়ার ক্রিম ব্যবহার করে তা সুইং করাতেন ম্যাসি, স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নির্দেশে সেটি বন্ধ করতে হওয়াতেই ফুরিয়ে যান। যদিও এ কথা তাঁর কানে পৌঁছানোর পর প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েই তা অস্বীকার করেছিলেন স্যার ডন।
সব মিলিয়ে ম্যাসির টেস্ট অভিষেকটা অনেক বেশি স্মরণীয়, তবে শুধু টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম দিনটির কথা বললে অ্যালেক বেডসার তাঁর চেয়েও এগিয়ে। ১৯৪৬ সালের ২২ জুন ভারতের বিপক্ষে লর্ডসে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর প্রথম দিনটিতেই বেডসারের ৭ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪। প্রথম টেস্টের মতো দ্বিতীয় টেস্টেও বেডসারের ১১ উইকেট। মজার ব্যাপার হলো, সেবার উল্টো—প্রথম ইনিংসে ৪, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭। এই শুরু যে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের পূর্বাভাস দেয়, ৫১ টেস্টে ২৪.৮৯ গড়ে ২৩৬ উইকেট সেটিকে যথার্থভাবেই অনুবাদ করেছে। ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা মিডিয়াম-ফাস্ট বোলারদের তালিকায় বেডসারের নামটি একেবারে সামনের সারিতেই থাকে এখনো। ১৯৫৫ সালে খেলা ছাড়ার পর কিছুদিন পরই অন্য ভূমিকায় জড়িয়ে যান খেলার সঙ্গেই। ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছিলেন ইংল্যান্ডের সিলেকশন কমিটিতে, ’৬৯ থেকে ’৮১ পর্যন্ত চেয়ারম্যান; ইংলিশ ক্রিকেটের বড় সুসময় ছিল সেটি। এ সময়ে খেলা ৭টি অ্যাশেজ সিরিজের মাত্র দুটিতে হেরেছিল ইংল্যান্ড।
স্বর্গে অ্যালেক বেডসার আর ফ্রেড ট্রুম্যান যদি সত্যি সত্যিই আজ আড্ডায় বসে থাকেন, সশরীরে না হলেও সেই আলোচনার বিষয় হিসেবে বব ম্যাসিও তাতে আসতেই পারেন। পৃথিবীতে থাকতে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বেডসার আর ট্রুম্যানকে ২২ জুন নিয়ে ম্যাসির সঙ্গে তাঁদের সেতুবন্ধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে লর্ডসে বব ম্যাসির টেস্ট অভিষেক তো দুজনই মাঠে বসে দেখেছেন। দেখতে দেখতে দুজনেরই হয়তো মনে পড়েছে নিজেদের স্বর্ণালি অতীত। বব ম্যাসির মতো এই লর্ডসেই একজনের শুরু। আরেকজনের শেষও এই মাঠেই।
পরে ম্যাসির অভিষেকটা অমন স্মরণীয় না হয়ে না গেলে নিশ্চয়ই এই মিলের কথা তাঁদের মনে হতো না। আমিও নিশ্চয়ই '২২ জুন'-কে কেন্দ্র করে এই লেখাটা লিখতাম না।