অ্যাথলেটিকসে অনেক `প্রথম`-এর নায়ক
মুজিবুর রহমান মল্লিক
দুলাল মাহমুদ
২০ জুন ২০২১
অ্যাথলেটিকসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে তিনরঙা তিনটি পদকই প্রথম জিতেছেন তিনি। প্রথমটি রিলেতে বলে আরও তিনজন অংশীদার ছিল, তবে রৌপ্য আর স্বর্ণপদক জিতেছেন একাই। ধারাবাহিকের আজকের পর্বে `প্রথম`-এর কীর্তিতে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে অমর হয়ে থাকা মুজিবুর রহমান মল্লিক।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অ্যাথলেটিকসে একটা পদকের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে একজন মুজিবুর রহমান মল্লিকের জন্য। ১৯৮০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত তুরস্কের ইজমিরে অনুষ্ঠিত প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে তিনি অবসান ঘটান বাংলাদেশের সেই অপেক্ষার। তাঁর প্রিয় ইভেন্ট ট্রিপল জাম্পে জয় করেন ব্রোঞ্জ পদক। ১৪ দশমিক ৪৫ মিটার লাফিয়ে আসে বহু কাঙ্ক্ষিত এই পদক। ১০ জাতির গেমসে এই ইভেন্টে তুরস্ক স্বর্ণ এবং পাকিস্তান রৌপ্য পদক পায়। প্রকৃত অর্থে খেলাধুলা বললে সবার আগে বোঝায় অ্যাথলেটিকসকে। অর্থাৎ দৌঁড়, ঝাঁপ, নিক্ষেপ আর হাঁটার সমষ্টিই অ্যাথলেটিকস। এটিতে সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়েই পরিমাপ করা যায় একটা জাতির ক্রীড়াচর্চা, সুস্থতা ও সক্ষমতার মাপকাঠি। মল্লিকের পদক জয়ের তাই ভিন্ন তাৎপর্য ছিল। আর আর দশটা পদকের চেয়ে যে কারণে এটি আলাদা হয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আর অ্যাথলেটিকসে পদক পাওয়া খুবই কঠিন। যে কারণে পরবর্তী পদকের জন্য আবার প্রায় আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হয়। এবারও যা আসে মল্লিকেরই কৃতিত্বে। ১৯৮৩ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি কুয়েতে তৃতীয় আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় লং জাম্প এবং ট্রিপল জাম্পে জয় করেন রৌপ্য পদক। এই প্রতিযোগিতায় শটপুটে ব্রোঞ্জ পদক পান সাইদুর রব। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ২০টি দেশ। দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মল্লিকের নৈপুণ্যে পর্যায়ক্রমে ব্রোঞ্জের পর আসে রৌপ্য পদক।
কিন্তু অ্যাথলেটিকসে কি বাংলাদেশের স্বর্ণপদক অধরা হয়ে থাকবে? না, শেষ পর্যন্ত সেটিও ধরা দেয়। খুব বেশি দিন অপেক্ষায়ও থাকতে হয়নি। এবারও নায়ক মুজিবুর রহমান মল্লিক। ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ এশীয় ফেডারেশন (সাফ) গেমসে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক আসে ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলেতে। ২১ সেপ্টেম্বর রিলে দৌড়ে ছিলেন সাইদুর রহমান ডন, মুজিবুর রহমান মল্লিক, মো. শাহ আলম আর মো. আফতাব মোল্লা। শ্রীলঙ্কা আর ভারতকে হারিয়ে ৪২ দশমিক ৪০ সেকেন্ড সময় নিয়ে তাঁরা জয় করেন নিখাদ স্বর্ণপদক। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক। সব দিক দিয়েই এই পদক দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নিয়ে আসে খুশির উচ্ছ্বাস।
এই উচ্ছ্বাসের ঢেউ মিলিয়ে যেতে না যেতেই বড় ধরনের সুখবর বয়ে আনেন মুজিবুর রহমান মল্লিক। ট্রিপল জাম্পে তিনি জয় করেন স্বর্ণপদক। এই ইভেন্টে ফেবারিট ছিলেন এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ভারতের বালাসুব্রামানিয়াম। সেদিন তিনি একদমই সুবিধা করতে পারেননি। পঞ্চম জাম্পের আগ পর্যন্ত এগিয়ে ছিলেন রৌপ্যপদক জয়ী পাকিস্তানের হায়দার আলী শাহ। ব্রোঞ্জ পদক লাভকারী শ্রীলঙ্কার আথুলা কুমারাও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেন। কিন্তু শেষ জাম্পে বাজিমাত করেন মল্লিক। ষষ্ঠ এই জাম্পে ১৪ দশমিক ১৮ মিটার অতিক্রম করে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। প্রথম সাফ গেমসে বাংলাদেশের পাওয়া দুটি স্বর্ণপদকেই খোদাই হয়ে আছে তাঁর নাম। সাফ গেমসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশের পক্ষে এককভাবে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্বও তাঁর। এভাবেই বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের সঙ্গে চিরদিনের জন্য জড়িয়ে আছেন তিনি।
এছাড়াও মল্লিক বাংলাদেশ দলের হয়ে ১৯৮৩ সালে কুয়েতে পঞ্চম এশিয়ান অ্যাথলেটিকস, ১৯৮৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ষষ্ঠ এশিয়া ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, একই বছর ঢাকায় সাফ গেমস, ১৯৮৬ সালে সিউলে দশম এশিয়ান গেমস এবং ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে অংশ নেন। এরমধ্যে ঢাকা সাফ গেমসে লং জাম্প এবং কলকাতা সাফ গেমসে ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলে দলের হয়ে রৌপ্যপদক লাভ করেন। রিলে দৌড়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিলজার হোসেন, মো. গিয়াস উদ্দিন ও শাহানউদ্দিন চৌধুরী। দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক রিলে দৌড়ে তিনি সুযোগ পেতেন না। বিদেশে বেশি অ্যাথলেট অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকত না। সেক্ষেত্রে রিলে দৌঁড়ে শূন্য স্থান পূরণের জন্য চতুর্থ স্প্রিন্টার হিসেবে তাঁকে অংশ নিতে হতো। আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে সর্বাধিক পদক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের মধ্যে তাঁর নাম রয়েছে শীর্ষস্থানীয়দের তালিকায়।
যশোরের কৃষক পরিবারের সন্তান মুজিবুর রহমান মল্লিকের জাতীয় অ্যাথলেটিকসে পদার্পণ ঘটে ১৯৭৬ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা দিয়ে। নিজ জেলার হয়ে লং জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক দিয়ে শুরু হয় পথ চলা। তখন তো তাঁর ইভেন্টে নজরুল ইসলাম রুমীর দোর্দণ্ড প্রতাপ। যে কারণে দীর্ঘ দিন তাঁর ছায়ায় মল্লিককে ঢাকা পড়ে থাকতে হয়। ১৯৭৮ সালে বিটিএমসির হয়ে লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক, ১৯৭৯ সালে লং জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক পাওয়ার পর ১৯৮০ সালে বিজেএমসিতে যোগ দেন। সেবার ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ১৯৮১ সালে পদক জয়ের ক্ষেত্রে তাঁর পদোন্নতি হয়। লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে লাভ করেন রৌপ্যপদক। পরের বছর আবার পদাবনতি। দুটি ইভেন্টেই ব্রোঞ্জ পদক।
কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। শীর্ষে পৌঁছনোর জন্য নিরন্তর অনুশীলন চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে মোক্ষ অর্জন হয়। নজরুল ইসলাম রুমীকে টপকে লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে প্রত্যাশিত স্বর্ণপদক জয় করেন। তারপর থেকেই তাঁর জয়জয়কার। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ট্রিপল জাম্পে আর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত লং জাম্পে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৮৬ সালে ৭ দশমিক ২৭ মিটার লাফিয়ে লং জাম্পে রেকর্ড গড়েন। ১৯৮৫ সালে ট্রিপল জাম্পে এবং ১৯৮৮ সালে লং জাম্পে লাভ করেন রৌপ্যপদক। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে বিজেএমসির হয়ে ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলে দৌড়ে স্বর্ণপদক এবং ১৯৮৭ সালে ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলে দৌড়ে ব্রোঞ্জ পদক পান। তিনি স্প্রিন্টার না হলেও দেশ ও দলের প্রয়োজনে রিলে দলের হয়ে দৌড়িয়েছেন। তাতে যে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন, তা লেখার অপেক্ষা রাখে না।
আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশের নামটি সবার আগে খচিত করেন মুজিবুর রহমান মল্লিক। প্রথম ব্রোঞ্জ, প্রথম রৌপ্য এবং প্রথম স্বর্ণপদক পাওয়ার সঙ্গে তাঁর নামটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। পরবর্তীকালে অনেকেই আরও বেশি সাফল্য পেলেও তাঁর কীর্তি কখনোই ম্লান হওয়ার নয়। চিরদিনই তা অম্লানই থাকবে। কারণ খুব সহজ। আর কেউই তো 'প্রথম' হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারবেন না।