কপিলের অপরাজিত ১৭৫ এক আফসোসের নামও!
বিশ্বকাপ ক্রিকেট ১৯৮৩
উৎপল শুভ্র
১৮ জুন ২০২১
১৭ রানে নেই ৫ উইকেট। এমন পরিস্থিতিতেই কপিল দেব খেললেন ১৭৫ রানের হার না মানা ইনিংস। তারপরও এটিকে `আফসোস` বলছি কেন? আসলে বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় আফসোস। কারণ ১৯৮৩ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানব্রিজ ওয়েলসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিলদের সেই ইনিংসের কোনো ভিডিও নেই।
১৯৮৩ সালের ১৮ জুন টানব্রিজ ওয়েলসের নেভিল গ্রাউন্ডে কোনো টিভি ক্যামেরা ছিল না। এটাকে বলা যেতে পারে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডির অর্থ হচ্ছে, সেদিন টানব্রিজ ওয়েলসে উপস্থিত হাজার কয়েক দর্শক ছাড়া আর কেউ বিশ্বকাপে খেলা সেরা ইনিংসটি দেখতে পাবেন না। শুধু বিশ্বকাপই নয়, সীমিত ওভারের ক্রিকেট ইতিহাসেই এরচেয়ে ভালো ইনিংস খেলা হয়েছে খুবই কম। বিবিসির কর্মীরা সেদিন ধর্মঘটে গিয়েছিল, তাই কপিল দেবের অপরাজিত ১৭৫ রানের সেই অবিস্মরণীয় ইনিংসটির সোনালি মুহূর্তগুলো কোনো ভিডিওতে বন্দী হয়ে নেই। সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলোর একটি সম্পর্কে তাই প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে সবার।
একক নৈপূণ্যে ম্যাচ জেতানোর উদাহরণ ক্রিকেটে খুব কম নেই। কিন্তু সেদিন কপিল দেব যা করেছিলেন, সেটা রীতিমতো অতিমানবীয় পর্যায়ে পড়ে। সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে রান রেটটা ভালো করা প্রয়োজন ছিল ভারতের। এ কারণেই টস জিতে ভেজা উইকেটেও ব্যাটিং নিয়েছিলেন কপিল দেব। সেই ম্যাচ কভার করা ভারতীয় এক সাংবাদিকের কাছ থেকে শোনা, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু দ্বিধাতেই ছিলেন কপিল। ‘টস জিতলে ব্যাট করো। যদি মনে সংশয় থাকে, তাহলে ভাবো এবং তারপর ব্যাট করো’—শেষ পর্যন্ত ডব্লিউ জি গ্রেসের এই অমর বাণীর পথেই হাঁটেন।
সিদ্ধান্তটা কত বড় ভুল হয়েছে, তা ভাবার সময় অবশ্য কপিল দেব পাননি। এর আগেই যে মাঠে নামার সময় হয়ে গেছে তাঁর। গাভাস্কার (০), শ্রীকান্ত (০), অমরনাথ (৫) ও পাতিল (১) ফেরার পর কপিল দেব যখন মাঠে নামছেন, তখন স্কোরবোর্ডের দিকে তাকানো যায় না। ৪ উইকেটে ৯! যশপল শর্মার (৯) আউটটা কপিল অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়েই দেখলেন। ভারতের রান তখন ১৭। কপিল দেব তখন কি ভাবছিলেন, সেটা জানার খুব ইচ্ছা ছিল। সে ইচ্ছাটা পূর্ণও হয়েছে। ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কায় কপিল দেবের প্রথম সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এই প্রশ্নটা এসেছিল অবধারিতভাবেই। কপিল দেবের জবাবটা ছিল খুবই সরল প্রকৃতির, ‘শেষ পর্যন্ত ব্যাট করতে হবে আমাকে। নিজেকে এটাই শুধু বলেছি বারবার। আমি আর কিছুই ভাবিনি।’
কপিল দেব শেষ পর্যন্তই ব্যাট করেছিলেন। এতক্ষণ আনপ্লেয়েবল মনে হওয়া জিম্বাবুয়ের বোলারদের মাঠের প্রতিটি কোণে আছড়ে ফেলে ৬০ ওভার শেষে যখন বিস্ময়ে বিমূঢ় দর্শকদের সামনে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসলেন, তাঁর নামের পাশে অপরাজিত ১৭৫। তখন যা শুধু বিশ্বকাপেই নয়, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড। পেছন ফিরে তাকালে সবচেয়ে বিস্ময় লাগে, কপিল দেব ব্যাট করতে নেমেছিলেন ৬ নম্বরে!
রজার বিনি, মদনলাল ও কিরমানির সঙ্গটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিনির সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ৬০, মদনলালের সঙ্গে অষ্টম উই্কেটে ৬২ রান তুলেছিলেন কপিল। এই দুটি পার্টনারশিপের সময় নির্ভেজাল ক্রিকেটিং শটই বেশি খেলেছেন। কিন্তু ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান কিরমানির যখন নামার সময় হলো, হাতে সময় নেই বুঝতে পেরে কপিল দেব আবির্ভূত হলেন স্বরূপে। সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল ৪৯তম ওভারে। সৈয়দ কিরমানির সঙ্গে অসমাপ্ত নবম উইকেট জুটিতে রান উঠল ১২৬। পার্টনারশিপের এই রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় ২৭ বছর।
১২৬ রানের পার্টনারশিপে কিরমানির অবদান কত ছিল, জানেন? মাত্র ২৪। ওই বিপর্যয়ের মধ্যে নেমেছিলেন বলে শুরুতে কপিল কপিলের মতো ব্যাটিং করেননি। নইলে কপিল দেব হাফ সেঞ্চুরিতে একটিও বাউন্ডারি নেই, ভাবা যায়! অথচ ইনিংস শেষে দেখা গেল, শুধু চার-ছয়েই তাঁর সেঞ্চুরি হয়ে যায়। ঠিক ১০০ রানই এসেছিল বাউন্ডারি থেকে। ১৬টি চার ও ৬টি ছক্কা। ৬টি ছয়ও তখন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের রেকর্ড।
অনেক দিন জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ল্যান্স কেয়ার্নসের সঙ্গে এই রেকর্ডটা ভোগ করেছেন কপিল। পরে ভিভ রিচার্ডস দুবার ৭টি করে ছক্কা মেরে রেকর্ড বুক থেকে এঁদেরকে মুছে দেন। রিচার্ডসকে বেশিদিন থাকতে দেননি গর্ডন গ্রিনিজ। ১৯৮৯ সালের ১৮ মার্চ সেন্ট জনসে ভারতের বিপক্ষে ১১৭ রানের ইনিংসটিতে ৮টি ছক্কা মারেন এই ওপেনার। এরপর তো ক্রিকেটে ছক্কার মহোৎসব শুরু হয়ে যাওয়ায় এই রেকর্ডও অনেক পেছনে পড়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে, এখন ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত এক ইনিংসে সবচেয়ে ছক্কা মারার যে রেকর্ডটি ইংল্যান্ডের এউইন মরগ্যানের, সেটিও আরেকটি বিশ্বকাপেই। এর চেয়েও কাকতালীয় মিল, তা ৩৬ বছর আগে-পরের একই তারিখে!
জিম্বাবুয়ের প্রশংসা করতেই হয়, প্রতিপক্ষকে অমন চেপে ধরার পর কপিল দেবের ওই উন্মাতাল ব্যাটিংয়ে ম্যাচের চেহারা বদলে যাওয়ায় তাদের হতোদ্যম হয়ে পড়াটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু ওরা হাল ছেড়ে না দিয়ে ভালোই ফাইট দিয়েছিল। ইংল্যান্ডের কারেন ব্রাদার্স, স্যাম ও টমের বাবা কেভিন কারেন সাত নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৭৩ রানের দারুণ এক ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ভারতের ৮ উইকেটে ২৬৬ রানের ৩১ রান পেছনে থাকতে অলআউট হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে।
ব্যাটিংয়ে ১৭৫ করেই কাজ শেষ মনে করেননি কপিল। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ডানকান ফ্লেচারকে আউট করে ভারতের জয়ে অবদান রাখেন বোলার হিসেবেও। ভারতের এই জয়ের তাৎপর্য শুধুই একটা ম্যাচ জয়ে শেষ হয়নি, এটাই এর আগ পর্যন্ত ওয়ানডেতে 'মিনোস' হিসেবে বিবেচিত ভারতীয় দলের মনে বুনে দেয় আত্মবিশ্বাসের বীজ। যেটির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে বিশ্বকাপ জয়ে। যে জয় বদলে দেয় ওয়ানডে ক্রিকেটকেই।