দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেডিংলিতে সেই অপরাজিত ১২০

স্টিভ ওয়াহর জীবনের ইনিংস

১৯৯৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

উৎপল শুভ্র

১৩ জুন ২০২১

স্টিভ ওয়াহর জীবনের ইনিংস

১৯৯৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই মহাকাব্যিক ইনিংস খেলার পথে স্টিভ ওয়াহ। ছবি: গেটি ইমেজেস

চাপের মধ্যেই সেরাটা বেরিয়ে আসে, একথা বললে যে কয়েকজন ক্রিকেটারের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে, তাঁদের পুরোভাগেই থাকেন স্টিভ ওয়াহ। প্রমাণ তো অসংখ্য। এর মধ্যে অন্তত ওয়ানডেতে সবচেয়ে বিখ্যাত অবশ্যই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে স্টিভের হার না মানা ১২০ রানের ইনিংস। যে পটভূতিতে খেলেছেন, তা জানলে সেটির মাহাত্ন্য বেড়ে যাবে আরও। হেডিংলির সেই কাব্যিক ইনিংস এবং এর আগে-পরের গল্প।

তখন একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়নি–এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। বাড়াবাড়ি মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। পরিস্থিতিটা দেখুন না! স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া, তা সেই জয়কে কে গুরুত্ব দেয়, এরপর পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচ হেরে তখন অনেকেরই খরচের খাতায় চলে গেছে স্টিভ ওয়াহর দল। নিজেদের দেশে ’৯২ বিশ্বকাপে অবিসংবাদিত ফেবারিট হিসেবে শুরু করা অস্ট্রেলিয়া যে সেমিফাইনালের আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল, তার কারণ হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছিল--হট ফেবারিট হওয়ার চাপটাই দুঃসহ হয়ে ওঠাতে অ্যালান বোর্ডারের দলের এমন সর্বনাশ। ’৯৯ বিশ্বকাপে অমন ‘হট’ না হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াই ছিল যুগ্ম ফেবারিট। তা ’৯২-এর মতো এবারও কি ফেবারিট হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়ার?

আজ বছর দেড়েক পর এই লেখা লিখতে গিয়ে আবার যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই মুখ। ঠোঁটে মৃদু হাসি, প্রিয় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাগি ক্যাপ মাথায় একটু তেরছা করে তাকানো স্টিভ ওয়াহর মুখ। চেস্টার-লি-স্ট্রিটের রিভারসাইড মাঠে তখন অস্ট্রেলীয় দল ছাড়া লোক বলতে অস্ট্রেলিয়ার তিন আর বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক। অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে কথা বলার পর একটু আলাদা সময়ের অনুরোধ করতেই সানন্দে তা মঞ্জুর করলেন স্টিভ ওয়াহ। পরদিন বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ, তাই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বাড়তি কিছু জিজ্ঞাসা থাকতেই পারে। মিডিয়ার এসব চাহিদা সম্পর্কে স্টিভ ওয়াহকে সচেতন দেখেছি বরাবরই, তাই তিনি যে মাঠে দাঁড়িয়েই একটা ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে গেলেন, তাতে মোটেই বিস্মিত হইনি। তবে প্রথম জবাবটা শুনে একটা বিস্ময় তো ধাক্কা দিয়েছিলই, ‘স্টিলম্যান’-এর চরিত্রটা জানা থাকার পরও তখন একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছিল তাঁর অগাধ আত্মবিশ্বাসকে। ’৯২-এর মতো এবারও কি প্রত্যাশার চাপেই আপনার দলের এই অবস্থা? প্রশ্নটা শুনেই স্টিভ ওয়াহর অমন তেরছা করে তাকানো। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে যে বাক্যটি বললেন, এখনো যেন চেষ্টা করলেই তা শুনতে পাই, ‘খুব বেশি দেরি নেই, আপনিই আমাকে অন্য প্রশ্ন করবেন।’

প্রশ্নটিতে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, উত্তরে এমন কোনো ঝাঁজ নেই। বরং স্টিভ ওয়াহর ভঙ্গিটা এমন যেন খুবই সাধারণ একটি তথ্য জানাচ্ছেন। তথ্যটা ভবিষ্যদ্বাণীর রূপ নিচ্ছে, সেটি তাঁর ভালোই জানা এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্যি হবে, সে বিষয়েও ভবিষ্যদ্বক্তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

এরপর বিশ্বকাপ যতই এগিয়েছে, ততই মনে পড়েছে রিভারসাইড মাঠে দাঁড়ানো স্টিভ ওয়াহর সেই মুখ। মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলা তাঁর সেই কথা, ‘খুব বেশি দেরি নেই, আপনিই আমাকে অন্য প্রশ্ন করবেন।’ অন্য কেউ বললে বলে ফেলা যেত দম্ভোক্তি, স্বীকার করে নেওয়া ভালো, স্টিভ ওয়াহর মুখেও তখন কথাটি অমনই শুনিয়েছিল। তবে ধাক্কা দিয়েছিল তাঁর বলার ভঙ্গিটা, এমন বিশ্বাস নিয়ে কথাটি বললেন যে, মনে হলো তিনি জানেন কোনোভাবেই এর অন্যথা হতে পারে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও যে দলনেতা অমন কথা বলতে পারেন, তাঁর দলের পক্ষে যেকোনো কিছুই করা সম্ভব--মনে হয়েছিল এটিও। মনে হয়েছে বিশ্বকাপের বাকি দিনগুলোতেও। সবচেয়ে বেশি ১৩ জুন লিডসের হেডিংলিতে।

চেস্টার-লি-স্ট্রিটে ওই কথা বলার পর স্টিভ ওয়াহর দল বাকি দুই ম্যাচে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চূর্ণবিচূর্ণ করে উঠেছে ‘সুপার সিক্স’ পর্বে। নিজেদের গ্র“প থেকে সুপার সিক্সে ওঠা অন্য দুদলের বিপক্ষে পাওয়া পয়েন্টটাই শুধু থাকবেএই নিয়মের কারণে তাদের ‘সুপার সিক্স’ শুরু শূন্য হাতে। প্রথম দুই ম্যাচে ভারত ও জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দেওয়ার পরও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি তাই হয়ে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়ার জীবন-মরণ লড়াই। দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালে উঠে গেছে এ ম্যাচের আগেই, তবে সেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হলে অস্ট্রেলিয়াকে জিততেই হবেএমন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক কী বলতে পারেন? স্টিভ ওয়াহ অনেকে কথাই বললেন, তবে শুরুতেই একটি ব্যাপার পরিষ্কার করে দেওয়ার পর। প্র্যাকটিস শেষে মাঠে দাঁড়িয়েই কথা বললেন, এবারও এবং সে কথার শুরুতেই এই ঘোষণা, ‘আমরা সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছি।’

বিশ্বকাপে ওয়ার্নকে ওয়ার্নের মতো দেখা না ফর্মে দেখা না গেলেও স্টিভ ওয়াহ ঠিকই আস্থা রেখেছিলেন ওয়ার্নের ওপর। ছবি: গেটি ইমেজেস

সেমিফাইনাল খেলতে পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতেই হবে, অস্ট্রেলিয়ার সে সামর্থ্য আছে, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল না কারো। তবে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনা যতটা, হারার সম্ভাবনাও তার চেয়ে একটুও কম ছিল না বলে স্টিভ ওয়াহর ওই ঘোষণাও বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। তবে খুব বেশি নয়, কারণ তত দিনে অস্ট্রেলিয়া অনেকটাই ফিরে এসেছে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের সমীহ জাগানো ফর্মে। তারপরও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর কিছু পূর্বশর্ত ছিল। গ্লেন ম্যাকগ্রা ভালো বল করতে শুরু করায় তার একটি পূরণ হয়ে গিয়েছিল এই ম্যাচের আগেই। স্টিভ ওয়াহ তখন প্রত্যাশায় আছেন ‘ওয়ার্ন ম্যাজিক’-এর। ওয়ার্নকে তখন পর্যন্ত বলে চেনা যায়নি, ‘শুধু অতীতের সুনাম সম্বল করে খেলে যাওয়ায়’ অস্ট্রেলিয়া মিডিয়া ছিঁড়ে ফেলছে তাঁকে। অধিনায়কের যা কর্তব্য তা-ই করলেন স্টিভ ওয়াহ। পাশে দাঁড়ালেন ওয়ার্নের এবং এই ম্যাচের আগে আরও বেশি করে। সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বলছেন, প্র্যাকটিস সেরে পাশ দিয়ে যেতে যেতে ওয়ার্ন রসিকতা করলেন, ‘কী বলছ ওদের, কাল আমাকে নাম্বার থ্রিতে পাঠাবে?’ জবাবে শুধু মৃদু হাসলেন অধিনায়ক। ‘কাল ও-ই আমার মূল অস্ত্র’--কয়েক সেকেন্ড পর অপসৃয়মাণ ওয়ার্নের দিকে তাকিয়ে স্টিভ ওয়াহ যখন এ কথা বলছেন, তখন রসিকতার চিহ্নমাত্র নেই তাঁর চোখেমুখে। বরং এক সাংবাদিক এটি নোট করেননি দেখে তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কী ব্যাপার, আপনি এটি লিখলেন না? বড় করে লিখুন, কালকের ম্যাচে শেন ওয়ার্নই আমার ট্রাম্পকার্ড।’ 

১০ ওভারে ৩৩ রানে ২ উইকেট--‘ট্রাম্পকার্ড’ পরদিন খারাপ করেনি। সেমিফাইনাল-ফাইনালে তাঁর অসাধারণ কীর্তির ছটায় আড়াল হয়ে গেছে এ ম্যাচের পারফরম্যান্স, নইলে হেডিংলিতেই আবার পুরোনো রূপে দেখা হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল ওয়ার্নের আঙুল (রিস্ট স্পিনার যেহেতু, আঙুলের পরিবর্তে কবজি বলাই কি ঠিক?)। শুধু ওয়ার্ন নন, আড়াল হয়ে গেছে আসলে সে ম্যাচের বাকি সবই। এই এত দিন পরও হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা ম্যাচটির কথা একটু ভাবুন, বাকি সব ঝাপসা হয়ে গিয়ে শুধু একটি ছবিই কি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে না? বাঁ হাতে ব্যাট, লাফিয়ে উঠে শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ছুড়ে বিজয়বার্তা ঘোষণা করছেন স্টিভেন রজার্স ওয়াহ।

আধুনিক ক্রিকেটের গতিপ্রকৃতিই খানিকটা নিশ্চিত করে দিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো এক সাংবাদিক হওয়ায় টেস্টের চেয়ে অনেক বেশি ওয়ানডে কাভার করার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েছে আরো। ক্রিকেট দেখা যেদিন শুধু উপভোগ করার বিষয়ের পরিবর্তে ‘চাকরি’তে পরিণত হলো, সেদিন থেকে হিসাব করলেও ৫০টির মতো এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ কভার করা হয়ে গেছে। ’৯৯-এর ১৩ জুনের আগে আমার দেখা সেরা ওয়ানডে ইনিংস বিষয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলে শুধু সমস্যাতেই পড়তে হতো। দু-তিনটি ইনিংস স্মৃতি থেকে উঠে এসে প্রায় একই তীব্রতায় দাবি জানাতে থাকত শ্রেষ্ঠত্বের। ’৯৯ সালের ১৩ জুন এই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন স্টিভ ওয়াহ। সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ১২০ রানের যে ইনিংসটি খেললেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক, সেটি অনেকটা ব্যবধানে এগিয়ে থেকে ‘আমার দেখা সেরা ওয়ানডে ইনিংস’। প্রতিপক্ষ, পরিস্থিতি, চাপ--এসব বিবেচনায় এটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া ইনিংস ওয়ানডে ইতিহাসেই খুব বেশি নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই সেরা খেলাটা বের করে আনার অভ্যাসের প্রমাণ এর আগেও দিয়েছেন স্টিভ ওয়াহ, আর অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপে দেবেন না? ‘আমরা সেমিফাইনালে খেলতে যাচ্ছি’--আগের দিন এই ঘোষণা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের দায়িত্বটাও তাই নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন অধিনায়ক। গত কিছুদিন বলে আসা আত্মবিশ্বাসী কথাবার্তা নিছক বাগাড়ম্বরে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাই আরো বেশি জাগিয়ে দিয়ে থাকবে তাঁকে।

তাঁকে অবশ্য জাগিয়ে তোলার তেমন প্রয়োজন হয় না। ক্রিকেট মাঠে তাঁর চেয়ে তীব্র জিগীষা নিয়ে কেউ কোনো দিন নেমেছে কিনা, তা নিয়ে তর্ক হয়। তাঁর সমান সাফল্যের ক্ষুধা নিয়ে আর কেউ নেমেও থাকতে পারে, কিন্তু তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব? গত এক দশকের ক্রিকেট থেকে ‘জীবনের জন্য খেলবে’--এমন কাউকে বেছে নিতে বললে পছন্দ হিসেবে স্টিভ ওয়াহর নামটিই শোনা যাবে সবচেয়ে বেশি। ক্যারিয়ারে স্মরণীয় ইনিংস কম খেলেননি, কিন্তু সেদিন হেডিংলিতে নিজের ভেতরকার সবকিছু--সাহস, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সামর্থ্যরে শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত বের করে স্টিভ ওয়াহ খেললেন ‘ইনিংস অব হিজ লাইফ’। সেই ইনিংসের সবকিছুই আজীবন স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। তা বাঁধানো আছেও, তবে সেখানে স্টিভ ওয়াহর ব্যাটিংয়ের মতোই জ্বলজ্বলে হয়ে আছে ব্যাট করতে নামার আগের কিছু দৃশ্যও। হেডিংলিতে দুদলের খেলোয়াড়দের জন্য একটিই ব্যালকনি। পাশাপাশি দুটি ড্রেসিংরুমের এক পাশে সেই ব্যালকনির গায়ে লাগানো প্রেসবক্স। প্রায় দুই শ সাংবাদিক বসতে পারেন সেই প্রেসবক্সে এবং সেটির যে প্রান্তটা খেলোয়াড়দের ব্যালকনিতে গিয়ে মিশেছে, সৌভাগ্য আমার, সেখানেই আগে থেকে নির্দিষ্ট হয়ে ছিল আমার আসন। মাত্র হাত পাঁচ-ছয় দূরে খেলোয়াড়েরা বসেছেন ব্যালকনিতে, মাঝখানে শুধু একটি কাচের দেয়াল। অস্ট্রেলীয় ইনিংস শুরু হওয়ার পর সেখানে দেখা দৃশ্যগুলোর মতো মাঠের বাইরের কোনো কিছু আমাকে এমন রোমাঞ্চিত করতে পেরেছে কমই।

অস্ট্রেলীয় স্পিরিটের ওপর যত শ্রদ্ধাই থাক, হার্শেল গিবসের ১০১ রানের দারুণ ইনিংসটির কল্যাণে ৫০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৭১ রান করে ফেলার পর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে বাজি ধরার লোক কি খুব বেশি ছিল? মনে হয় না। তখন পর্যন্ত ওই বিশ্বকাপে এত রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড নেই, তার ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিংয়ের বিপক্ষে ২৭২ রানের টার্গেট মানে কমপক্ষে ৩০০। আগের দিনই যে অমন নিষ্কম্প গলায় ম্যাচের ফলাফল ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, তা এখন স্টিভ ওয়াহ কী বলেন, খুব জানতে ইচ্ছে হ্িচ্ছল। এই ইচ্ছে পূর্ণ করার কোনো উপায় নেই। তবে দুই ওপেনার মার্ক ওয়াহ ও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে ব্যালকনিতে এসে বসা স্টিভ ওয়াহর মুখ দেখে তো মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করা যায়! সেই চেষ্টাতেই অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধু স্টিভ ওয়াহকেই অনুসরণ করছে আমার চোখ। তা মুখ দেখে যা বোঝা গেল, সেটি যে আবার বিশ্বাস করা কঠিন। স্টিভ ওয়াহর হাবভাব দেখে মনে হলো না আগের দিনের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। মুখে টেনশনের চিহ্নমাত্র নেই, কথাবার্তা কানে আসছে না, তবে ভাবভঙ্গি আর হাসি দেখে মনে হলো মহা আনন্দে আছেন তিনি। কখনো কারো রসিকতা শুনে হাসছেন, কখনো রসিকতা করছেন নিজেই। বেশিক্ষণ অবশ্য নয়। তার ৫ নম্বরে নামার কথা, তারপরও দ্বিতীয় ওভারে এলওর্দির বল গিলক্রিস্টের স্টাম্প ছত্রখান করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে যখন ড্রেসিংরুম থেকে ফিরে এলেন, প্যাড-ট্যাড পরা হয়ে গেছে। এক হাতে ব্যাট, অন্য হাতে হেলমেট, বসলেন এসে আগের চেয়ারেই। কিন্তু আগের লোকটিই কি ফিরে এল?

স্টিভ ওয়াহই, তবে আগের স্টিভ ওয়াহ নন। মুখে তাঁর হাসি নেই, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে, মাঝেমধ্যে শুধু স্কোরবোর্ড থেকে ঘুরে আসছে দৃষ্টিটা। যষ্ঠ ওভারে দলকে ২০ রানে রেখে রানআউট হয়ে ফিরে এলেন  ইন-ফর্ম মার্ক ওয়াহও। আরেকটু যেন দৃঢ়সংবদ্ধ দেখাল বড় যমজের চোয়াল। হয়তো পরিস্থিতিটা হালকা করতেই পাশে বসে থাকা ব্রেন্ডন জুলিয়ান, টম মুডি, ড্যারেন লেম্যানরা ইয়ার্কি-ফাজলামো করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু স্টিভ ওয়াহ যেন শুনতেই পেলেন না সেসব। অগ্নিপরীক্ষায় নামার আগে নিজেকে একাগ্র করে নিতে তিনি তখন ধ্যানমগ্ন। দ্বাদশ ওভারে স্কোরবোর্ডে মাত্র ৪৮ রান উঠতেই ডেমিয়েন মার্টিনও যখন ফিরতি পথ ধরলেন, উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ধীরেসুস্থে হেলমেট পরলেন, তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে পা বাড়ালেন সেনাপতি। সতীর্থদের জন্য অভয়বাণী হয়ে ক্ষীণ একটা হাসির রেখাও কি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটে?

মাঠে নেমে পেলেন রিকি পন্টিংকে। দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররা তখন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ। তাড়াতাড়ি আর একটি উইকেট, তাহলেই মোটামুটি নিশ্চিন্তএই বিশ্বাস তখন আরো তাড়িয়ে তুলছে তাঁদের। শুরুতে স্টিভ ওয়াহ-রিকি পন্টিং পার্টনারশিপটি তাই যে গতিতে সামনে এগোল, তাতে এভারেস্ট-উচ্চতার ২৭২ রানের টার্গেটটিকে মনে হতে লাগল আরো অনেক উঁচুতে। পরে পরিষ্কার হলো, কতটা উঁচুআসলে তখন তা বোঝার চেষ্টা করছেন স্টিভ ওয়াহ আর ঠিক করছেন সেই শৃঙ্গে ওঠার কৌশল। বেশি সময় নিলেন না তা করতে, পথ পেয়ে গেছেন তা বোঝাতে একটু পরই শুরু হলো স্ট্রোকের ফুলঝুরি। সেসব শটের অনেকগুলোই খুঁজে পাওয়া যাবে না কোচিং বইয়ে। তা ক্রিকেট আর বইয়ে খেলা হলো কবে! স্টিভ ওয়াহ তখন যা ইচ্ছে তা-ই করছেন, তাঁর হাতের ব্যাট যেন রূপ নিয়েছে তলোয়ারের, তা থেকে ঝরছে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের রক্ত। অধিনায়ককে এমন রূপে দেখে পন্টিংও খেললেন কিছু দুঃসাহসী স্ট্রোক। ২৩ ওভারে এ দুজনের গড়া ১২৬ রানের পার্টনারশিপে পায়ের নিচে মাটি পেল অস্ট্রেলিয়া।

পাশাপাশি স্টিভ ওয়াহ আর শন পোলকের ছবি দুটিই বলে দিচ্ছে সেদিনের হেডিংলির গল্প

পার্টনারশিপের সেঞ্চুরি হতে লাগল ১৮.২ ওভার, সেঞ্চুরির শেষ ৫০ মাত্র ২৮ বলে। ৪৭ বলে স্টিভ ওয়াহর হাফ সেঞ্চুরি, যাতে ৫টি চার আর ১টি ছয়। এরপর পরই যা ঘটল, সেটিই আসলে ’৯৯ বিশ্বকাপের ভাগ্য লিখে দেওয়া মুহূর্ত। ল্যান্স ক্লুজনারকে ফ্লিক করেই একটা হার্টবিট মিস করে ফেললেন স্টিভ ওয়াহ। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন ক্যাচ উঠে গেছে মিড উইকেটে! এমন ক্যাচ, যা দেখার পর ব্যাটসমান আর দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ খুঁজে পান না। হার্শেল গিবসও মুহূর্তের জন্য ক্যাচটিকে সে রকমই বানিয়ে ছিলেন, কিন্তু পরের মুহূর্তটিই তাঁকে উপহার দিল বাকি জীবন পোড়ানোর মতো এক স্মৃতি। স্টিভ ওয়াহকে ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দটা উদ্যাপন করার মতোই ব্যাপার, শূন্যে বল ছুড়ে দিয়ে তা করতে গিয়েই গিবসের হাতে থেকে মাটিতে পড়ে গেল বল। স্টিভ ওয়াহ তখন ৫৬ রানে, জয় থেকে অস্ট্রেলিয়ার দূরত্ব তখনো ১২০ রান। প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার পর মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসার আনন্দেই বিভোর হয়ে থাকতেন অন্য যেকোনো ব্যাটসম্যান। কিন্তু তিনি স্টিভ ওয়াহ! পুড়তে থাকা গিবসের গায়ে ঘৃতাহুতি দেওয়ার সুযোগ তিনি ছাড়বেন কেন! ‘বাছা, তুমি যে বিশ্বকাপটাই হাত থেকে ফেলে দিলে’--খুবই সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা তাঁর এ কথা ক্রিকেটের স্মরণীয় বাণীভুক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তখন স্টিভ ওয়াহর এ কথাও দম্ভোক্তি বলে মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। ওই ম্যাচই তো তখনো শেষ হয়নি, তা জিতলেও বাকি সেমিফাইনাল-ফাইনাল, অথচ তখনই ওই কথা! গিবস বিশ্বকাপটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন বলার পরোক্ষ অর্থ একটাইস্টিভ ওয়াহর হাতে উঠছে তা। ভাবা যায়অমন টেনশনে ঠাসা, তখনো অনিশ্চয়তায় ঘিরে থাকা একটি ম্যাচের মাঝখানে অমন কথা! লোকটি যদি স্টিভ ওয়াহ হন, তাহলে অবশ ভাবা যেতে পারেই পারে!

শেষ ১৬ ওভারে প্রয়োজন ৯৮ রান, ওভারে ৬-এর সামান্য বেশি, কিন্তু ৩৫তম ওভারের প্রথম বলেই পন্টিং যখন আউট, হঠাৎই আরো বেশি বলে মনে হতে লাগল সেটিকে। বেশিক্ষণ অবশ্য তা মনে হলো না, কারণ মাইকেল বেভানকে সাক্ষী রেখে তখন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করছেন স্টিভ ওয়াহ। মনে রাখার মতো শটের ছড়াছড়ির মধ্যে আলাদাভাবে মনে গেঁথে আছে অ্যালান ডোনাল্ডের বলে মারা স্কয়ার ড্রাইভটি। বুলেটের মতো বল ছুটে গেল সীমানার দিকে, অ্যাডভার্টাইজিং বোর্ডে ধাক্কা খেয়ে যখন তা আবার মাঠে ফিরে এসেছে, ঠিকমতো ফলো থ্রু শেষ করতে পারেননি ডোনাল্ড। স্টিভ ওয়াহর সেদিনের ব্যাটিং অবশ্য সবচেয়ে বেশি প্রতীকায়িত হয়েছিল অন্য একটি শটে। তাঁর দ্বিতীয় ছক্কাটিতে। সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ‘গ্রেট’ রোহান কানহাইয়ের সুইপ করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার অভ্যাস ছিল, যেটি পরিণত হয়েছিল সে সময়কার ক্রিকেটের অন্যতম দর্শনীয় শটে। ১৯৭১ সালে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়া তরুণ সুনীল গাভাস্কার এই ‘ফলিং সুইপ’ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকার কথা লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। কানহাইয়েরটি যদি ‘ফলিং সুইপ’ হয়, তাহলে সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার স্টিভ এলওর্দিকে স্টিভ ওয়াহ যা মারলেন, সেটিকে বলতে হবে ‘ফলিং হুক’। হুক করার পর ক্রিজে প্রায় শুয়ে থেকেই দেখলেন, মিড উইকেটের ওপারে দর্শকদের মধ্যে দিয়ে পড়েছে বল। নিজের সর্বস্ব ঢেলে দেওয়ার প্রতিজ্ঞাটি ওভাবে রূপায়িত হতে দেখে তখনই মনে হয়েছিল, এই ম্যাচে এখন একটি দলই জিততে পারে। ম্যাচের বাকি অংশে আর যা-ই হোক না কেন, বিজয়ী নির্ধারিত হয়ে গেছে।

দুর্দান্ত খেলেছ--ম্যাচ শেষে কী স্টিভ ওয়াহকে এমনই বলেছিলেন হানসি ক্রনিয়ে? ছবি: গেটি ইমেজেস

তা হতে অবশ্য আরেকটু সময় লাগল, নির্দিষ্ট করে বললে ’৯৯ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো শেষ ওভারে গড়াল এই ম্যাচটিই। এরই মধ্যে সেঞ্চুরি হয়ে গেছে স্টিভ ওয়াহর, লেগেছে মাত্র ৯১ বল। ২৬৬ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মাত্র দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, তারপরও দর্শকদের উচ্ছ্বসিত অভিনন্দনের জবাবে ব্যাট তুললেন কি তুললেন না--কাজ এখনো শেষ হয়নি, এখনো ম্যাচ জেতাতে বাকি! তা জেতাতে বেভানের সঙ্গে ৭৩ রানের পার্টনারশিপটি এগিয়ে দিয়েছিল অনেকটাই। এই পার্টনারশিপেও স্টিভ ওয়াহই উজ্জ্বলতর, ৭৩ রানে বেভানের অবদান মাত্র ২৭। ৪৬তম ওভারের চতুর্থ বলে বেভান যখন তাঁকে ছেড়ে চলে এলেন, তখনো ২৬ বলে প্রয়োজন ২৫ রান। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব একবারই, ’৮৭-এর বিশ্বকাপজয়ী সেই দলের যে দুজন টিকে ছিলেন ’৯৯-এর দলেও, তাঁদের ওপরই পড়ল দায়িত্বটা। টম মুডি যোগ দিলেন অধিনায়কের সঙ্গে। তখনো অনিশ্চয়তায় দুলছে ম্যাচ, দক্ষিণ আফ্রিকানরা আগেই হার মেনে নেওয়ার পাত্র নয় (হায়! এখন এ কথা বলতে গেলেই যে হানসি ক্রনিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান! দক্ষিণ আফ্রিকানরাও তো আগে হার মেনে নিয়েছে। কতবার, কে জানে!), নয় বলেই শেষ ওভারটি করতে শন পোলক যখন দৌড় শুরু করলেন, তখনো ম্যাচে আছে দুদলই। বাউন্ডারি মেরে অন্তত এই ওভারে টম মুডিই রেখেছেন বড় ভূমিকা। তবে যা হওয়া উচিত ছিল হয়েছে তা-ই, উইনিং শটটি এসেছে স্টিভ ওয়াহর ব্যাট থেকেই। মাঠে আবেগ-টাবেগ লুকিয়ে রেখে নিজের কঠিন চেহারাটা দেখানোই পছন্দ তাঁর, কিন্তু এ এমন এক জয়, এমন এক ইনিংস যে ‘ইস্পাতমানব’ও একটু টললেন। জয়সূচক রানটি নিয়েই লাফিয়ে উঠলেন স্টিভ ওয়াহ, বাতাসে ছুড়ে দিলেন মুষ্টিবদ্ধ হাত। তা হয়ে গেল বিশ্বকাপের সবচেয়ে স্মরণীয় দৃশ্যগুলোর একটি।

বিস্ময়কর এক ইনিংস, তবে বিস্ময়ের বাকি ছিল তখনো। ১১০ বলে ১২০, ১০টি চার, ২টি ছয়--এমন একটা ইনিংস খেলে আসার পরও স্টিভ ওয়াহর মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলল সংবাদ সম্মেলনের পারফরম্যান্স। তার সংবাদ সম্মেলন সব সময়ই দারুণ এক অভিজ্ঞতা। যেকোনো সফরে ভিনদেশি জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাকে যিনি অবশ্যজ্ঞান করেন, কলকাতায় এলে যিনি মাদার তেরেসার সঙ্গে দেখা না করে ফেরার কথা ভাবতেই পারতেন না, নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলাটা যাঁর কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের স্মরণীয়তম অভিজ্ঞতা, লন্ডন থিয়েটারে যাঁকে দেখা গেছে একাধিকবার, এই মহাব্যস্ততার মধ্যেও কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম গড়ে দিতে টাকা তুলে কলকাতা এসে তা দিয়ে যাওয়ার সময় হয় যার, সেই কলকাতা নিয়ে যিনি বই পর্যন্ত লিখে ফেলেন--এমন বহুমাত্রিক লোকের কথা শুনতে ভালো লাগারই কথা। সেদিন স্বাভাবিকভাবেই স্টিভ ওয়াহ আরো দুর্দান্ত ফর্মে। পায়ের পেশিতে টান পড়ায় মাঠেই স্ট্রেচিং করতে হয়েছে একটু পরপর, ড্রেসিংরুমে ফিরেই লাগাতে হয়েছে বরফ--কিন্তু সেসব তাঁর মুখে ঝিলমিল করে খেলতে থাকা আনন্দের রেণুগুলো সরিয়ে দেয় কী সাধ্য! স্টিভ ওয়াহর হাসারই দিন সেটি, হাসলেনও কারণে-অকারণে। শুধু নিজেই হাসলেন না, সিরিয়াস মুখে হিউমার করে হাসালেনও সবাইকে। যেমন ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে যে প্রশ্নটি মোটামুটি কমন, সেটিই করলেন এক সাংবাদিক, জানতে চাইলেন একটু আগে শেষ হওয়া ম্যাচ সম্পর্কে। ‘দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ২৭১ রান তোলে। আমরা ৪৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে যাই। পন্টিং আর আমি একটা পার্টনারশিপ গড়ে একটু সামলে উঠি, এরপর...’ আপনি নিশ্চয়ই একটু বিস্মিত, হঠাৎ করে আবার সংক্ষিপ্ত ম্যাচ রিপোর্ট কেন? না ম্যাচ রিপোর্ট নয়। এটিই ছিল স্টিভ ওয়াহর উত্তর এবং এমন সিরিয়াস মুখ করে সেই উত্তর দিলেন যে, প্রথমে কিছুক্ষণ রসিকতাটা কেউ বুঝতেই পারেনি। তারপরই পুরো ঘর ফেটে পড়ল হাসিতে। এত ম্যাচ খেলে মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি, রসিকতা করলেন এ নিয়েও। রসিকতা করছেন ঠিকই, কিন্তু সিরিয়াস উত্তরটাও দিচ্ছেন এরপর। এখানে যেমন বললেন, ‘৫-৬ নম্বরে ব্যাট করে সেঞ্চুরি করার সুযোগ কই, বলুন?’

সেঞ্চুরির সংখ্যা দুই হোক, স্মরণীয় ইনিংস তো আর কম খেলেননি, সেগুলোর মধ্যেও একটু আগে খেলা ইনিংসটা একটু অন্য রকম--সবাই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে আগেই। তাদের সঙ্গেই সুর মেলালেন স্টিভ ওয়াহ, ‘চাপের মধ্যে সবাই ভালো খেলার স্বপ্ন দেখে। দল যখন সর্বনাশের কিনারায়, তখন এমন কিছু করতে পারলেই না বিশ্বাস জাগে যে, আমি যথেষ্ট ভালো। ৪৮ রানে ৩ উইকেট পড়ে গেছে, উইকেটও বোলারদের যথেষ্ট উৎসাহ জোগাচ্ছে--এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি আর কী হতে পারে? এটাই আমার সেরা ইনিংস।’ বিশ্বকাপের শুরুতে দলের ব্যর্থতায় অস্ট্রেলীয় মিডিয়া ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাঁকে, অনেক সাবেক প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর ক্যাপ্টেনসি নিয়ে, ৫-৬ নম্বরে ব্যাট করায় স্টিভ ওয়াহর মধ্যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সাহসের অভাব পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন ইয়ান চ্যাপেল। ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলে দলকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেওয়ার পর এসবের জবাব তো একটু দিতেই পারেন। সেটিও দিলেন চমৎকারভাবে, ‘ব্যাট করতে নামার আগে গত কিছুদিন যেসব লেখা হয়েছে সেসব মনে পড়েছে আমার। সেগুলোই আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।’ এ কথা বলেই ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকদের অংশটায় তাঁর চোখ, গলায় কৌতুক, ‘থ্যাংক ইউ, গাইস!’

ম্যাচ শেষে ইয়ান চ্যাপেলের মুখোমুখি স্টিভ। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিশ্বকাপ থেকে যখন তাঁর দলের ছিটকে পড়ার মতো অবস্থা, হাসাহাসি হতে পারে--এই ভয় না পেয়ে তখনো বলে গেছেন তিনি যতগুলো দলে খেলেছেন, তার মধ্যে এটিই ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার সেরা দল। যখন সবাই অস্ট্রেলিয়াকে বাতিল করে দিচ্ছে, তখনো তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। আর এমন একটি জয়ের পর তো স্টিভ ওয়াহর কণ্ঠস্বর একটু উচ্চগ্রামে ওঠারই কথা। অথচ কণ্ঠস্বর সেই একই মাত্রায় রইল, তার চেয়েও যা বিস্ময়কর মনে হলো, এই সাফল্য থেকেও নিজেকে যেন আলাদা করে নিয়েছেন ততক্ষণে। কঠিন এক ম্যাচ জয়, সব অনিশ্চয়তা উড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা, ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলা--এসব তৃপ্তি প্রকাশ করতে করতেও স্টিভ ওয়াহ বারবার মনে করিয়ে দিলেন একটি প্রয়োজনীয় তথ্য, ‘এখনো দুম্যাচ বাকি। দুম্যাচ হারার পরই আমার খেলোয়াড়দের বলেছি আমাদের টানা সাত ম্যাচ জিততে হবে। এখনো দুম্যাচ বাকি!’

প্রমাণ দেওয়া কঠিন, তবে সত্যি বলছি, দুম্যাচ পর লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ হাতে উল্লাসরত স্টিভ ওয়াহকে দেখা যাবে--এ ব্যাপারে তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×