হার্ড হিটিংয়ের বিচারে উলমারের চোখে আফ্রিদিই এক নম্বর

উৎপল শুভ্র

১২ মে ২০২১

হার্ড হিটিংয়ের বিচারে উলমারের চোখে আফ্রিদিই এক নম্বর

পাকিস্তানের সে সময়ের কোচ বব উলমারের সাথে। ছবি: এএফপি

ক্রিকেট ইতিহাস এত সব হার্ড হিটার দেখেছে, প্রয়াত বব উলমারও তাঁর জীবনে স্বচক্ষে তাঁদের অনেককেই দেখেছেন। তারপরও ২০০৬ সালে ভারত-পাকিস্তান সিরিজের সময় শহীদ আফ্রিদির ব্যাটে প্রলয়ঙ্করী ঝড় দেখে ঘোষণা করে দিলেন, এই পাঠানই তাঁর দেখা সবচেয়ে হার্ড হিটিং ব্যাটসম্যান।

প্রথম প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০০৬। প্রথম আলো।

ছয় বলে ছয় ছক্কা মেরেছেন—এটা শুনলেও কারও খুব বেশি বিস্মিত হওয়ার কথা নয়। তবে সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করবেন—এই কিছুদিন আগেও বুকমেকাররা এটি বাজারে ছাড়লে বাজির দর হতো ৫০০-১। অর্থাৎ এক টাকা ধরলে ৫০০ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা। সেই প্রায় অসম্ভব কাজটাই করে ফেললেন আফ্রিদি। 

লাহোরে সেঞ্চুরি করেছিলেন, কাল করলেন ফয়সালাবাদেও। গত চার টেস্টের সাত ইনিংসে এটি তাঁর তৃতীয় সেঞ্চুরি, আরেকটি ইনিংস আছে ৯২ রানের। এখন যে শহীদ আফ্রিদিকে টেস্ট ব্যাটসম্যান বলে না মেনে উপায় থাকছে না! নিশ্চিত থাকতে পারেন, এটিকেই তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা স্বীকৃতি বলে মানবেন তিনি।

ফয়সালাবাদে সেঞ্চুরির পর। ছবি: এএফপি

সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যানদের একজন—এই স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন অনেক আগেই। সেটি শুধু ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরির অত্যাশ্চর্য রেকর্ড গড়েছিলেন বলেই নয়, এর পরও এই পাঠানের ব্যাট একই তালে বোলারদের বিনিদ্র রাতের কারণ হয়ে থেকেছে বলে। ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইক রেট (১০৮.৩৬) তাঁর, সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ডও। ২০৭ ইনিংসে ২১৩ ছক্কা—ওয়ানডে ইতিহাসে আর কারও এমন ইনিংসের চেয়ে ছক্কার সংখ্যা বেশি নেই। ওয়ানডের দ্রুততম ১২টি হাফ সেঞ্চুরির ৪টিই এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। সব কিছু মিলিয়ে ‘ওয়ানডে স্পেশালিস্ট’-এর তকমাটা এমনভাবেই শহীদ আফ্রিদির গায়ে লেগে গিয়েছিল যে, সেটি তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারকে কখনোই ডানা মেলে উড়তে দেয়নি। ৬৬টি ওয়ানডে খেলে ফেলার পর টেস্ট অভিষেক। এর চেয়ে বেশি ওয়ানডে-অভিজ্ঞতা নিয়ে টেস্ট খেলতে নেমেছেন মাত্র তিনজন (অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস-৯৪, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-৭৬, যুবরাজ সিং-৭৩)। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকের পরও ওয়ানডে স্পেশালিস্ট পরিচয়টা মুছে ফেলতে পারেননি বলেই সোয়া সাত বছরে মাত্র ২২তম টেস্ট খেলছেন ফয়সালাবাদে। ওয়ানডের সংখ্যা? ২১৬!

লাহোরের গাদ্দাফির মতো ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়ামের বাইরেও পোস্টার বিক্রেতার কাছেও তিনটি পোস্টারই দেখলাম। ইনজামাম-উল হক, শোয়েব আখতার ও শহীদ আফ্রিদি। বছর বিশেকের বিক্রেতা জানালেন, শহীদ আফ্রিদির পোস্টারই বেশি করে আনা উচিত ছিল, ইনজামাম-শোয়েব তেমন চলছে না। লাহোরের পর ফয়সালাবাদের দর্শকদের প্রতিক্রিয়াও স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছে, এই মুহূর্তে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তার রেটিং হলে আফ্রিদির ধারে-কাছেও কেউ থাকবেন না।

আফ্রিদির জনপ্রিয়তা তখন এমনই তুঙ্গস্পর্শী। ছবি: এএফপি

শুধু ব্যাটিং করতে নামার সময়ই নয়, বোলিং করতে আসতেই দর্শকদের যে শোরগোলটা শোনা গেল, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, আফ্রিদি এখন পাকিস্তানি ক্রিকেটের ‘হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা’। বাঁশির বদলে হাতে ব্যাট, এই যা! দ্বিতীয় দিনের সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথাটা শুনে তিনি অবশ্য খুবই অবাক হয়ে বললেন, ‘এ আর নতুন কী, সব সময়ই তো তা-ই ছিলাম।’ 

কথাতেও ব্যাটিংয়ের মতো ঝাঁজ। তবে একটু পর বব উলমার যা বললেন, সেটি শুনলে আফ্রিদিও বোধহয় বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন। লাহোর টেস্টে হরভজনের পরপর চার বলে ছক্কা মারার পর গ্রেগ চ্যাপেল তাঁর দেখা সেরা হিটারদের তালিকায় রিচার্ডস-বোথাম-লয়েডদের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছিলেন আফ্রিদির নামটিও। উলমার যে এর চেয়েও এগিয়ে। পাকিস্তানের ইংলিশ কোচ স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, টেস্ট ক্রিকেটে আর কাউকে তিনি এত জোরে বল মারতে দেখেননি। ‘আমি বোথামকে দেখেছি। না, বোথামও ওর কাছে কিছু নয়’—বলে দিলেন উলমার। 

বোথাম-রিচার্ডস বেশি দিন আগের কথা নয়। এর আগেও অনেক বিখ্যাত হিটারকে দেখেছে ক্রিকেট। গ্লস্টারশায়ারের মাঠ ব্রিস্টলে গেলে স্থানীয় লোকজন এখনো আপনাকে গিলবার্ট জেসপের গল্প শোনাবেন। মাঠের প্যাভিলিয়ন-লাগোয়া পাবে কেউ মাত্র বিয়ার নিয়ে বসেছেন, ঝনঝন করে কোথাও কাচ ভাঙল। বারটেন্ডার আশ্বস্ত করছেন, ‘ও কিছু নয়। জেসপ ব্যাট করতে নেমেছে’। এই গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মুখে মুখে ফিরে বেঁচে আছে এখনো। সেই ১৯৫৫ সালেই মরে গেছেন জেসপ, কে জানে, শহীদ আফ্রিদির রূপ ধরে তাঁরই পুনর্জন্ম হলো কি না!

আফ্রিদির ব্যাট থেকে আরও একবার উড়ে যাচ্ছে বল, ধোনি তাকিয়ে আছেন সেদিকেই। ছবি: এএফপি

টেস্টটাও তিনি ওয়ানডের মতোই খেলেন। ক্রিকেট বলটা মারবার জিনিস, সেটি টেস্ট হলেই কী বা ওয়ানডে হলেই কী—এই বিশ্বাস থেকে সরবার কোনো কারণ দেখেন না শহীদ আফ্রিদি। এ কারণেই মাত্র ৪২টি টেস্ট ইনিংসে তার ছক্কার সংখ্যা ৪৪! ওয়ানডেতেই যেখানে ইনিংসের চেয়ে বেশি ছক্কা আর কারও নেই, টেস্টে যে থাকবে না, সেটি তো না বললেও চলছে। টেস্টে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড ক্রিস কেয়ার্নস ও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের, ৮৭টি ছক্কা মারতে কেয়ার্নসের লেগেছে ১০৪ ইনিংস, গিলক্রিস্টের ১১৬। আফ্রিদির তাঁদের ধরে ফেলতে খুব বেশি দিন লাগবে না। টেস্টটা যে এখন তিনি নিয়মিতই খেলবেন।

.....................................................

সংযোজন: পনের বছর আগের লেখা, অনেক কিছুই তাই বদলে যাওয়ার কথা। খুব বেশি কিছু অবশ্য নয়। ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বব উলমার তাঁর বিশ্বাস থেকে সরেননি বলেই জানি। বদল যা হয়েছে, তা কিছু পরিসংখ্যান আর রেকর্ডেই। শেষ অনুচ্ছেদটা অবশ্য নতুন করেই লেখা যায়। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (৩৫১) ছক্কার রেকর্ডটা এখনো আফ্রিদিরই আছে, তবে শেষ পর্যন্ত ইনিংসের চেয়ে তাঁর ছক্কার সংখ্যা আর বেশি থাকেনি। যে কৃতিত্বটা এখন দাবি করতে পারেন ক্রিস গেইল (২৯৪ ইনিংসে ৩৩১) ও রোহিত শর্মা (২২০ ইনিংসে ২৪৪)। 'টেস্টটা এখন নিয়মিতই খেলবেন' ধারণাটা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় টেস্টে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড ভাঙার কোনো সম্ভাবনাই জাগাতে পারেননি। এই লেখাটার সময় ৪২টি টেস্ট ইনিংসে ৪৪টি ছক্কার কথা বলা হয়েছে, এরপর খেলেছেনই আর মাত্র ৫টি টেস্ট। অনেকবার অবসর-নাটক করার পর ২০১০ সালে চূড়ান্তভাবে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার পর ২৭ টেস্টের ৪৮ ইনিংসে আফ্রিদির ছক্কার সংখ্যা ৫২। যাঁদের ক্যারিয়ারই তিন/চার ইনিংসের, তাঁদের তো হিসাবের বাইরে রাখাই ভালো। নইলে টেস্ট ক্রিকেটে ছক্কার সংখ্যা ইনিংস সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা একমাত্র শহীদ আফ্রিদির ব্যাটেই ঘটেছে।

আরও পড়ুন:
শহীদ আফ্রিদির একান্ত সাক্ষাৎকার

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×