সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটিও তাঁর!
উৎপল শুভ্র
৮ মে ২০২১
ক্রিকেট ব্যাট হাতে অত্যাশ্চর্য কত কীর্তিই না করেছেন! বইয়ে দিয়েছেন রানবন্যা, করেছেন সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, ক্রিকেট ইতিহাসে মনুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়। ভাবতে একটু অবাকই লাগে, ক্রিকেটে সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটাও কি না তাঁর! স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে কথা হচ্ছে, এটা কি আর বলার দরকার আছে? তাঁকে শূন্য রানে আউট করে দেওয়া বোলারের নামটাও তো মনে হয় আপনি জানেন।
সংশয় জাগতেই পারে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর ৩৩৪ বা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ৪৫২ নিয়ে যত কথা হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর শেষ ইনিংসটি নিয়ে কি কথা হয়েছে এর চেয়েও বেশি? আর কারো জন্যই যেন কোনো কীর্তি অবশিষ্ট রাখতে চাননি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। নইলে টেস্ট ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ইনিংসের মতো সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটাও কেন তাঁরই হবে?
১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সুপার সিক্স ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকারকে শূন্য রানে আউট হয়ে ফিরতে দেখে হঠাৎই ৫১ বছর আগের একটি দৃশ্য ভেসে উঠেছিল কল্পনায়। সেই একই মাঠ, এই ওভালেই তো জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস শূন্য রানেই ফিরে আসতে হয়েছিল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। নিজেই টেন্ডুলকারকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি বলে মেনেছেন, তাই রঙিন পোশাক আর ওয়ানডে সার্কাসের চোখে ধাক্কা দেওয়া পার্থক্য সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্য আমার চোখে স্যার ডনের রূপ নিয়ে ফেললেন ড্রেসিংরুমে ফিরে আসতে থাকা ভারতীয় লিটল মাস্টার। সেই কৈশোর থেকে অসংখ্যবার পড়তে পড়তে ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্টের সেই সাদা-কালো ওভাল, ব্যাট করতে নামা ডন ব্র্যাডম্যানকে অধিনায়ক নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বে ইংলিশ খেলোয়াড়দের 'থ্রি চিয়ার্স' দেওয়া থেকে শুরু করে দুই বলের ইনিংস শেষে তাঁর ধীর পদক্ষেপে টেস্ট ক্রিকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কিছুই চোখে দেখার মতো স্পষ্ট একটা রূপ নিয়ে নিয়েছে। জীবনে প্রথমবারের মতো ওভাল মাঠে পা রাখার পর থেকে আর সব কিছু ছাপিয়ে 'এখানেই শেষ টেস্ট খেলেছিলেন স্যার ডন' এই স্মৃতিই তাই মনে জেগে উঠছিল বারবার।
টেস্ট ক্রিকেট তাঁর শেষ ইনিংস খেলতে নামার সময় প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় আর দর্শকদের দেওয়া সংবর্ধনায় আবেগাক্রান্ত ব্র্যাডম্যানের চোখে জল চলে এসেছিল, এ কারণেই তিনি হলিসের গুগলিটি দেখতে না পেয়ে আউট হয়ে যান--খুব জনপ্রিয় এই ধারণাকে নিজেই নস্যাৎ করে দিয়ে গেছেন স্যার ডন। আসলে নিজেকে তিনি এমনই এতটা ‘ঈশ্বরতুল্য' উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে চায়নি ক্রিকেটিং কোনো কারণে তাঁর টেস্ট অ্যাভারেজ পুরোপুরি ১০০ করার জন্য প্রয়োজনীয় ৪টি রান করতে পারেননি। এ কীভাবে হয়!
চোখে জল-টলের ব্যাপার নেই, তবে অন্য একটা সমস্যা যে তাঁর হয়েছিল, সেটি স্যার ডন লিখে গেছেন ১৯৫০ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী 'ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট'-এ। যেটির বঙ্গানুবাদ এমন দাঁড়ায়: 'আরেকটি দারুণ সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে যখন আমি নামছি, আমার মন চলে গিয়েছিল ১৮ বছর আগে এই মাঠেই জ্যাক হবসের শেষ টেস্টে। সেই দৃশ্যেরই যেন পুনরাভিনয় হচ্ছে এখানে। ফিল্ডাররা সব একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থ্রি চিয়ার্স দিচ্ছে, জানাচ্ছে শুভকামনা (অবশ্যই পরের বছরগুলোর জন্য)। খেলা শুরু হলো, তার পর আমি মনে-প্রাণে ভালো করতে চাইছিলাম। কিন্তু তা হওয়ার নয়। ওই অভ্যর্থনা আমার আবেগকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে আমার মনকে উদভ্রান্ত করে তুলেছিল, যে মানসিক অবস্থাটা যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই খুব মারাত্মক। আমি হলিসের প্রথম বলটি খেললাম, যদিও তা ঠিকমতো দেখতে পেরেছিলাম কিনা ঠিক নিশ্চিত নই সে ব্যাপারে। দ্বিতীয় বলটি হলো নিখুঁত লেংথে পড়া এক গুগলি যা বোকা বানাল আমাকে। আমি শুধু ব্যাটের ভেতরের কানাটা ছোঁয়াতে পারলাম তাতে, এরপর শুধু অফ স্টাম্পের বেল পড়ে যাওয়ার শব্দ।'
এই হলো স্যার ডনের নিজের কলামে তাঁর শেষ টেস্ট ইনিংস, যেটি স্যার ডনকে সাধারণ মানুষে পরিণত করার পাশাপাশি এরিক হলিসকে উপহার দিয়েছে অমরত্ব। এই কীর্তিটি না করে ফেললে ক'জন জানত ১৩ টেস্টে ৪৪ উইকেট নেওয়া এই লেগ স্পিনারের নাম? তবে এই টেস্টের আগেই স্যার ডনের কাছ থেকে ভালো বোলার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন হলিস। ওয়ারউইকশায়ারের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচটিতে টানা ৪৩.৫ ওভার বোলিং করে ১০৭ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন হলিস, যে পারফরম্যান্স স্যার ডনও ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ বলে রায় দিয়েছেন আত্মজীবনীতে, এই পারফরম্যান্সই হলিসকে সুযোগ করে দিয়েছিল পঞ্চম ও শেষ টেস্টে।
৮০ ইনিংসে যার ২৯টি সেঞ্চুরি, তাঁর শেষ ইনিংসে শূন্য; এটুকুই যথেষ্ট ছিল এই 'শূন্য'কে অমর করে রাখতে। ৪ রান করলেই অ্যাভারেজটা ঠিক ১০০ হতো—এই হাহাকার এতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে স্যার ডন এমনই এক রান মেশিন ছিলেন যে, তাঁর সকল শূন্য নিয়েই আছে বাড়তি কৌতূহল। টেস্ট ক্রিকেটে বোলারদের জন্য বর্ণনাতীত আনন্দের এই ঘটনা ঘটেছে সাতবার। এর মধ্যে দুবারই ১৯৪৮ সালের ওই ইংল্যান্ড সফরে। শেষ টেস্টের আগে নটিংহ্যামে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও কেন যেন রান করা হয়ে ওঠেনি ব্র্যাডম্যানের। সেবার বোলারের নাম অ্যালেক বেডসার।
এই মিডিয়াম পেসার ভদ্রলোকই টেস্টে দ্বিতীয় সর্বাধিক ছয়বার আউট করেছেন ব্র্যাডম্যানকে (বাঁহাতি স্পিনার হেডলি ভেরিটি করেছেন সবচেয়ে বেশি আটবার), তাঁকে একাধিকবার শূন্য রানে আউট করার কীর্তিটিও তাঁরই। ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শূন্যটির কারণ এই বেডসার। ১৯৪৮ সিরিজের শেষ দুটি শূন্য ছাড়া তাঁর বাকি ৫টি শূন্যই দেশের মাটিতে। এর মধ্যে ১৯৩৬-৩৭ অ্যাশেজ সিরিজে স্যার ডনকে পর পর দুই ইনিংসে শূন্য রানে আউট করার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল ইংল্যান্ডের বোলাররা। ব্রিসবেনে বিল ভোসের বলে ক্যাচ নিয়ে যে গ্যাবি অ্যালেন শূন্যতে ফিরিয়ে দেন ব্র্যাডম্যানকে, সিডনিতে পরের টেস্টে তিনিই নামেন মূল হন্তারকের ভূমিকায়। আরেকটা ছোট্ট তথ্য যোগ করা যায় এখানে। ওভালে শেষ টেস্টে একটি ইনিংসই ব্যাট করেছেন ডন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করার সুযোগ পেলে কী হতো, তা অনুমান করা এমন দুঃসাধ্য কিছু নয়। কারণ বাকি ৬টি শূন্যর ৩টিতেই অন্য ইনিংসটিতে সেঞ্চুরি এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে।
৫২ টেস্টে ৬,৯৯৬ রান, গড় ৯৯.৯৪, ২৯টি সেঞ্চুরি যার ২টি ট্রিপল, ১০টি ডাবল–এসবের পাশাপাশি ব্র্যাডম্যানের শূন্য নিয়ে এমন আলোচনাটাও কিন্তু তাঁর গ্রেটনেসেরই প্রমাণ। স্যার ডনের শূন্য নিয়ে লিখতে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের মন্তব্য তুলে দেওয়াই ভালো মনে করছি–'গত কিছুদিন ধরে অনেককে দেখি স্যার ডনের সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকারের তুলনা করতে। আমাকে বলুন তো, আজ থেকে ৫০ বছর পর টেন্ডুলকারের শূন্য নিয়ে কি এমন কিছু লেখা হবে?'
কিছু প্রশ্ন আছে, যার উত্তর সবারই জানা। এটিও এমনই একটা প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংস