আম্পায়ার-ক্রিকেটার বৈরিতার সেই ব্যতিক্রমী গল্প
হেয়ার-মুরালিকে মিলিয়ে দিয়েছিল সুনামি-সেতু
উৎপল শুভ্র
৮ মে ২০২১
বোলার-ব্যাটসম্যানের লড়াইটাই ক্রিকেট আর এটি যেখানে একের বিপক্ষে এক; খুবই স্বাভাবিক যে, খেলোয়াড়ে খেলোয়াড়ে লড়াইয়ের অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনীতে ভরে আছে ক্রিকেট ইতিহাস। কিন্তু খেলোয়াড়-আম্পায়ারে এমন তিক্ত বৈরিতার ইতিহাস এই একটাই। মুত্তিয়া মুরালিধরন বনাম ড্যারেল হেয়ার। যে বৈরিতার মাঝখানে সেতু বসিয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় সুনামিতে দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে আয়োজিত চ্যারিটি ম্যাচ।
প্রথম প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০০৫। প্রথম আলো।
দশম ওভারটি করতে যখন মুরালিধরনের হাতে বল তুলে দিলেন শন পোলক, নড়েচড়ে বসল পুরো টেলস্ট্রাডোম। বিশ্বের সেরা অফ স্পিনারের বোলিং দেখার রোমাঞ্চের কারণে নয়, মুরালি যে বল করতে এলেন ড্যারেল হেয়ারের প্রান্ত থেকে।
মুরালিধরন বনাম হেয়ার--ক্রিকেট ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়ই হয়ে আছে এই লড়াই। বোলার-ব্যাটসম্যানের লড়াইটাই ক্রিকেট আর এটি যেখানে একের বিপক্ষে এক; খুবই স্বাভাবিক যে, খেলোয়াড়ে খেলোয়াড়ে লড়াইয়ের অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনীতে ভরে আছে ক্রিকেট ইতিহাস। ব্র্যাডম্যান-লারউড, মিয়াঁদাদ-লিলি...চাইলে স্টিভ ওয়াহ-সৌরভও যোগ করতে পারেন এর সঙ্গে, কিন্তু খেলোয়াড়-আম্পায়ারে এমন তিক্ত বৈরিতার ইতিহাস এই একটাই। মুত্তিয়া মুরালিধরন বনাম ড্যারেল হেয়ার।
সেই বৈরিতার দশ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। ১৯৯৫ সালে মেলবোর্নে 'বক্সিং ডে' টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে মুরালিধরনকে থ্রোয়িংয়ের দায়ে সাত-সাতবার 'নো' ডেকে রীতিমতো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছিলেন ড্যারেল হেয়ার। ড্রেসিংরুমে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মুরালিধরন। অর্জুনা রানাতুঙ্গা ওভাবে পাশে না দাঁড়ালে কে জানে, শেষ হয়ে যেতে পারত তাঁর ক্যারিয়ারই। তখন থেকেই শ্রীলঙ্কার 'জাতীয় শত্রু’ ড্যারেল হেয়ার।
আইসিসি সুপার সিরিজের চার আম্পায়ারের একজন হিসেবে ড্যারেল হেয়ারের নাম ঘোষণার পর থেকেই দশ বছর আগের সেই ছবিটা বারবার ফিরে ফিরে আসছিল সবার মনে। সেই মেলবোর্নেই হেয়ার মুরালি নাটকের নতুন কোনো পর্ব অভিনীত হতে যাচ্ছে না তো? নতুন করে পুরনো বিতর্ক খুঁচিয়ে তুলে প্রীতি ম্যাচ-প্রীতি ম্যাচ আবহে জল ঢেলে দেবেন না তো হেয়ার? এ আশঙ্কা আসলে ছিলই না। আইসিসির নতুন নিয়ম অনুযায়ী আম্পায়াররা এখন আর মাঠে কাউকে থ্রোয়িংয়ের দায়ে 'নো' ডাকেন না, সন্দেহজনক কিছু দেখলে রিপোর্ট করেন ম্যাচ রেফারির কাছে। তার পরও হেয়ারের প্রান্ত থেকেই সাত আর তিন ওভারের দুটি স্পেল করার সময় মুরালিধরনের মনে কি একবারও সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি জেগে ওঠেনি?
হয়তো উঠেছে। 'হয়তো' শব্দটা এ কারণেই যে, এখন আর হেয়ার আর মুরালির সম্পর্ক আগের মতো সাপে-নেউলে হয়ে নেই। নিশ্চয়ই বন্ধু বলা যাবে না, তবে অন্তত একটা সামাজিক সম্পর্ক হয়েছে। সেই সম্পর্কের সেতু সুনামি। এই সিরিজ শুরুর আগে মুরালিধরনের সঙ্গে অনেকবারই কথা হয়েছে হেয়ারের, সুনামির ধ্বংসযজ্ঞ শ্রীলঙ্কা কতটুকু সামলে উঠেছে, মূলত তার খোঁজখবর নিতেই। দশ বছর আগে যা ঘটেছে, সেটিকে এখন 'অতীত' বলেই এড়িয়ে যেতে চান হেয়ার। তবে ওই ঘটনা যে মুরালির মতো তাঁর ক্যারিয়ারও শেষ করে দিতে পারত, গত পরশু সেটিই বলেছেন এখন ইংল্যান্ডে বসত গড়া সাবেক এই পেস বোলার।
মুরালিধরনকে 'নো' ডাকার পর সিডনিতে তাঁর বাড়িতে ফিরে চিঠির বাক্সে হত্যার হুমকি দেওয়া চিঠি পেয়েছেন। তাতে পোস্ট অফিসের কোনো সিলমোহর ছিল না। যার অর্থ, নিজের হাতেই কেউ তা দিয়ে গেছে ওখানে। ওই সময়টাকে শুধু 'কঠিন' ই বলছেন না, অনেকবারই আম্পায়ারিং ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন বলেও জানাচ্ছেন হেয়ার। সুপার সিরিজে মুরালির সঙ্গে আবার তাঁর দেখা হয়ে যাওয়া নিয়ে এত হইচই হচ্ছে দেখে মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত বছর শ্রীলঙ্কা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের সময়ও আম্পায়ারিং করেছেন তিনি। থ্রোয়িং বিতর্কের পর এটাই তাই মুরালির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা নয়। তবে মেলবোর্নে মুরালির সঙ্গে হেয়ারের কথাবার্তার এমন প্রচার পাওয়া থেকেই অনুমান করা যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময়ও হয়েছে কি না সন্দেহ!
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পরও যে তাঁর হাতে পর্যাপ্ত অবসর থাকে, সেটির প্রমাণ দিয়ে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড মুরালির বোলিং অ্যাকশনের শুদ্ধতা নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। সেই গবেষণার ফল যে মুরালির পক্ষে যায়নি, তা বলাই বাহুল্য। মুরালির অস্ট্রেলিয়ায় আর খেলতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আরও পোক্ত হয়েছিল তাতে। সুনামির কারণেই না তা বদলাল।
শুধু হেয়ার মুরালি সম্পর্কটাকে একটু ভদ্রস্থ রূপ দেওয়াতেই সুনামির ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকছে না, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আবার যে মুরালিধরনকে বোলিং করতে দেখা যাচ্ছে, তার মূলেও তো ওই সুনামিই। টেস্টে হেয়ারের পর ওয়ানডেতে রয় এমারসনও 'নো' ডেকেছিলেন মুরালিকে। এরপর বোলিং করতে এলেই দর্শকরা ‘চাকার’ ‘চাকার’ বলে চেঁচিয়েছে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পরও যে তাঁর হাতে পর্যাপ্ত অবসর থাকে, সেটির প্রমাণ দিয়ে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড মুরালির বোলিং অ্যাকশনের শুদ্ধতা নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। সেই গবেষণার ফল যে মুরালির পক্ষে যায়নি, তা বলাই বাহুল্য। মুরালির আর কোনোদিন অস্ট্রেলিয়ায় না খেলার সিদ্ধান্ত আরও জোরালো হয়েছিল তাতে। ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার অস্ট্রেলিয়া সফরে আসেনওনি।
গত জানুয়ারিতে মেলবোর্নে 'সুনামি ম্যাচ'ই মুরালিধরনের মান ভাঙাল। সেই ম্যাচ খেলতে এসে হাওয়ার্ডের সঙ্গে তাঁর হাত মেলানোর খবরটা ম্যাচের চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছিল। আইসিসি সুপার সিরিজের চেয়ে বড় হতে না পারে, তবে হেয়ার আর মুরালির বৈরিতার অবসান হওয়াটা তো বড় খবরই।