ব্রায়ান লারাকে এক ভক্তের চিঠি
‘ক্রিকেটপাত্র’ উছলিয়া মাধুরী করেছ দান
বিদায় ব্রায়ান চার্লস লারা
উৎপল শুভ্র
২ মে ২০২১
ব্রায়ান লারা যখন ব্রিজটাউনে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা খেলছেন, আমি তখন আকাশে। ব্রিজটাউন থেকে জ্যামাইকার পথে। লারার শেষ ম্যাচে মাঠে থাকতে না পারার দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে পরদিন কিংস্টনে বসে একটা খোলা চিঠি লিখে ফেলেছিলাম। সেই চিঠি লেখার সময় আমি যত না সাংবাদিক, তার চেয়ে বেশি ফ্যান। লেখার শিরোনামেও যার স্বীকারোক্তি ছিল। জীবনে এই ঘটনা একবারই। ব্রায়ান লারাও তো ক্রিকেটে একবারই আসেন।
প্রথম প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০০৭। প্রথম আলো।
প্রিয় ব্রায়ান,
আপনার অত্যাশ্চর্য সব ইনিংসের স্মৃতি ছাপিয়ে ‘ডিড আই এন্টারটেইন’ প্রশ্নটাই শুধু কানে বাজছে। যাওয়ার আগে আপনার শেষ প্রশ্ন। উপচে পড়া কেনসিংটন ওভালের ‘ইয়েস’ চিৎকারটা শুনেছেন। সঙ্গে পুরো ক্রিকেট বিশ্বই যে চিৎকার করে ‘ইয়েস’ বলেছে, তাও কি!
তা শুধু বিদায়বেলায় আপনাকে খুশি করার জন্য নয়। তা-ই যদি হবে, টেলিভিশনের সামনে বসে কেনসিংটন ওভালের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও কেন ‘ইয়েস’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম! আপনার কানে যে এই চিৎকর পৌঁছুবে না, তা কি আর আমি জানি না! তারপরও বলেছি, কারণ আপনার ব্যাটিংয়ের চেয়ে বড় বিনোদন যদি ক্রিকেটে কিছু থেকে থাকে, সেটির সঙ্গে আমার এখনো পরিচয় হয়নি। গত দেড় দশক সাংবাদিক হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখার অভিজ্ঞতায় আপনার ব্যাটিং দেখার অনির্বচনীয় অনুভবের কাছাকাছি রাখতে পারছি শুধু ওয়াসিম আকরাম ও শেন ওয়ার্নের বোলিংকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার শেষ ইনিংসটা মাঠে বসে দেখার সুযোগ পেয়েও দেখতে না পারাটা আমার বাকি জীবনের আফসোস হয়ে থাকবে। আপনি যখন শেষবারের মতো মাঠে নামছেন, আমি তখন আকাশে। বারবাডোজ থেকে জ্যামাইকা আসছি। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দেখতে বারবাডোজ থেকে জ্যামাইকা আর সেন্ট লুসিয়ায় দর্শকদের এমনই ঢল নেমেছে যে, প্লেনের টিকিট পাওয়াটা আপনার ইন্টারভিউ পাওয়ার চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল!
অনেক চেষ্টাচরিত্র করে টিকিট একটা পেলাম বটে, তবে সেটি ২১ তারিখের। ২১ এপ্রিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড ম্যাচ, এটি না দেখলে আর কী হবে! অর্থহীন একটা ম্যাচ। হ্যাঁ, এটিই আপনার শেষ ওয়ানডে জানতাম। সেটিকে খুব বড় কিছু মনে হয়নি। টেস্ট ক্রিকেটে তো থাকছেন। টেস্ট ক্রিকেটের লারাই তো আসল লারা। ওয়ানডের ক্যানভাস আপনার মতো শিল্পীর জন্য বড্ড ছোট বলে আপনার ব্যাটিংয়ের সব পাপড়ি মেলে ফুটে ওঠার ঘটনা তাতে খুবই কম। সাত-আট দিন আগে টিকিট কাটার সময় তো আর জানি না, এই ‘অর্থহীন’ ম্যাচটিই বিশ্বকাপ ফাইনালের চেয়েও অর্থবহ হয়ে উঠবে!
বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচের পর যে সংবাদ সম্মেলনে আপনি বোমাটা ফাটালেন, তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম। আপনার ওই ঘোষণা শোনার পর বিস্ময়, অবিশ্বাস সব পার হয়ে শেষ পর্যন্ত যে অনুভূতিটি হলো, সেটি অদ্ভুত এক শূন্যতার। কিছুটা আপনার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা দেখতে পারছি না বলে, তার চেয়ে বেশি আপনার ব্যাটিংই আর দেখতে পাব না বলে। রাতে হিলটন হোটেলের লবিতে আপনার সঙ্গে দেখা হলো, হাত মিলিয়ে ‘আমি আপনার বিরাট ফ্যান ছিলাম। আপনাকে খুব মিস করব’ বলার পর আপনি হেসে কী যেন বললেন, আমি ঠিক বুঝতেই পারলাম না। একজন ক্রিকেটারের বিদায়ে এত আবেগাক্রান্ত হওয়ার কী আছে, সেটিও যেমন বুঝতে পারছি না।
কিন্তু হাবিবুল বাশারকেও যে আবেগাক্রান্ত দেখাল! আপনাকে শুভকামনা জানিয়ে এসে তিনি কী বললেন, জানেন? ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখার মজাটাই চলে গেল! টেন্ডুলকার না লারা, এ নিয়ে এত কথা হয়, ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললে দেখবেন, সবাই লারার ভক্ত।’
জ্যামাইকামুখী বিমান যখন মাঝ-আকাশে, পাইলট স্কোর জানালেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কত, ঠিকমতো শুনলামও না। ব্রায়ান লারা ১৮ রানে আউট—এ নিয়েই তখন যাত্রীদের মধ্যে গুঞ্জন। যাওয়ার বেলা রাঙিয়ে দিতে পারলেন না ভেবে একটু মন খারাপ হলো, আপনাকে সত্যি কথাটা বলে দিই, একটু খুশিও হলাম! আমার চাওয়া না-চাওয়ায় তো তখন আর কিছু আসছে যাচ্ছে না, আপনি বড় কিছু করে ফেললে তা দেখতে না পাওয়ার দুঃখটা যে আরও বাড়ত!
পরে কিংস্টনে হোটেলে এসে টেলিভিশনে দেখলাম, আপনি ব্যাট করতে নামার সময় ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা গার্ড অব অনার দিয়েছে। ঠিক যেন ৫৮ বছর আগের একটা দৃশ্যের পুনরাভিনয়। ১৯৪৮ সালের ওভাল টেস্টে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান শেষবারের মতো ব্যাট করতে নামার সময় নরম্যান ইয়ার্ডলি যা করেছিলেন, মাইকেল ভনও তা-ই করলেন। ব্র্যাডম্যান করেছিলেন শূন্য, তাঁর চেয়ে ১৮ রান বেশি করেও আপনার দুঃখটা বেশি হওয়ার কথা। ব্র্যাডম্যান আউট হয়েছিলেন নিজের ভুলে, আর আপনি রান আউট হলেন পার্টনারের কারণে। আপনি জেনে খুশি হবেন, হয়তো একটা পরিতাপের হাসিও দেবেন, বিদায়ের পর দ্বীপে-দ্বীপে রেষারেষি ঘুচিয়ে আপনি ‘ত্রিনিদাদের লারা’ থেকে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের লারা’ হয়ে গেছেন! নইলে কিংস্টন বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভার কেন ‘জ্যামাইকার স্যামুয়েলস’কে গালমন্দ করতে করতে বলবেন, ‘ওই হতচ্ছাড়াই লারাকে রান আউট করে দিয়েছে!’
টেস্টে আপনার অতিমানবীয় কীর্তিগুলোর কিছুই প্রায় মাঠে বসে দেখার সুযোগ হয়নি। টেস্ট সেঞ্চুরি দেখেছি মাত্র একটি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে কিংস্টনে আপনার দুর্দান্ত ওই সেঞ্চুরিটি দেখতে দেখতে কী মনে হচ্ছিল, সেটাও আজ বলেই ফেলি। স্যাবাইনা পার্কের পুরোনো প্রেসবক্সটা ছিল ঠিক যেন উইকেটের ওপরে। আপনি ব্যাট করতে নামলেন, সেই প্রথম বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো ম্যাচে আমি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের অমঙ্গল কামনা করিনি! প্রাণভরে আপনার ব্যাটিং দেখলাম। সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর একটু অপরাধবোধ হতে লাগল। তা বুঝতে পেরেই কি না, ব্যাটে একটু বল লেগেছে কি লাগেনি, আম্পায়ার বুঝতে না পারলেও আপনি নিজে থেকেই চলে গেলেন!
আপনার পিছু ধাওয়া করার সময় যে আমি যত না পেশাদার সাংবাদিক, তার চেয়ে বেশি নাছোড়বান্দা ভক্ত হয়ে যেতাম!
আপনার ৩৪টি টেস্ট সেঞ্চুরির ওই একটিই মাঠে বসে দেখা। তবে ওয়ানডেতে আপনার সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটিও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ১৯৯৫ সালে শারজায় চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬৯, কুমারা ধর্মসেনার সাধারণ এক বলে বোল্ড হয়ে যাওয়ার আগে মনেই হয়নি, আপনি আউট হতে পারেন! ১০০ থেকে ১৬৯-এ যেতে লেগেছিল মাত্র ২৯ বল! এর কদিন আগেই টেস্টে ৩৭৫ করে এসেছেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৫০১, ওয়ানডের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিও সেদিন হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছিল। এত কাছে এসে তা হারিয়ে ফেলায় আপনার মন খারাপ হয়নি? ওই ইনিংস খেলার চার দিন পর দেওয়া ইন্টারভিউয়ে আপনি বলেছিলেন, ‘রেকর্ডের কথা মাথায় ছিল না। তবে সুযোগ আরও আসবে।’ সুযোগ এলেও তা আর কাজে লাগাতে পারেননি। কেন যেন মনে হয়, সেটি ওয়ানডে ক্রিকেট আপনার কাছে খুব মূল্য পায়নি বলেই!
ওই শারজাতেই আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর ও একই সঙ্গে সবচেয়ে তৃপ্তিকর ইন্টারভিউটি উপহার দিয়েছিলেন আপনি। টানা বারো দিন আপনার পেছনে লেগে থেকেও আপনাকে গলানো যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত আপনার ইন্টারভিউ করতে না পারলে আমার চাকরি চলে যাবে—এই গল্পে আপনার মন গলেছিল। অনেক দিন ঘুরেও ইন্টারভিউ না পাওয়া এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সাংবাদিক তা জেনে মহা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছিলাম, আপনি তাঁকে বলেছেন, ‘আমি ওকে কোনোভাবেই এড়াতে পারিনি।’ পারবেন কীভাবে? আপনার পিছু ধাওয়া করার সময় যে আমি যত না পেশাদার সাংবাদিক, তার চেয়ে বেশি নাছোড়বান্দা ভক্ত হয়ে যেতাম!
বিদায়বেলায়ও বলে গেছেন পুরোনো সেই দুঃখের কথা। সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলতে শুরু করে সেটিকে তলিয়ে যেতে দেখার দুঃখ। সব সময়ই বলেছেন, কেন যেন লোকে তা বিশ্বাস করতে চায়নি। দলের চেয়ে আপনি নিজের কথাই বেশি ভাবেন—এ অপবাদটাই আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ বলে অনুমান করি। অথচ আপনি আর কী করতে পারতেন? তিনবার নিজে ডাবল সেঞ্চুরি করেও টেস্ট ম্যাচ হারার রেকর্ড শুধু আপনারই আছে। দু শ’র বেশি রান করেও হারতে হয়েছে ৮টি টেস্ট। নিজে এত কিছু করার পরও সতীর্থদের ব্যর্থতায় ম্যাচের পর ম্যাচ হেরে কখনো কি আপনি টিমগেমের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেননি, মনে হয়নি এর চেয়ে টেনিস বা গলফের মতো ব্যক্তিগত খেলা খেললেই ভালো হতো! এই প্রশ্নটা করে গত বিশ্বকাপের সময় অনেক সাধ্যসাধনায় পাওয়া আপনার ইন্টারভিউটা বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। আমি সরল মনেই প্রশ্নটা করেছিলাম, এটি যে আপনার এমন স্পর্শকাতর জায়গা, বুঝতেই পারিনি। এমনই রেগে গিয়েছিলেন যে, ইন্টারভিউটা অসম্পূর্ণ থাকার দুঃখ ভুলে আমি তখন মানসম্মান বাঁচাতে পারলেই বাঁচি!
পরে ভেবে দেখেছি, স্পর্শকাতর তো আপনার হওয়ারই কথা। কত ম্যাচে নিজে অসাধারণ খেলেও সতীর্থদের ব্যর্থতায় পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবতে হয়েছে, সেই দুঃখের কথা না ভেবে মানুষ কিনা উল্টো অপবাদ দিয়েছে আপনাকে! ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই টেস্ট সিরিজটি কীভাবে ভুলবেন? আপনি তিন টেস্টে ৬৮৮ রান (১৭৮ ও ৪০, ৭৮ ও ৪৫, ২২১ ও ১৩০) করার পরও টেস্ট সিরিজের ফলাফল হলো: শ্রীলঙ্কা ৩-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ০। পরশুই বারবাডোজ বিমানবন্দরে আমার মতোই আপনার বিদায়ব্যথায় কাতর এক ভারতীয় সাংবাদিকের মুখে সেই সিরিজের একটা ঘটনা শুনলাম। ওই সাংবাদিক শুনেছেন রামনরেশ সারওয়ানের মুখে।
সারওয়ান ব্যাট করছেন আপনার সঙ্গে, মুরালিধরনের বল কিছুই বুঝতে পারছেন না। ওভারের মাঝখানে গিয়ে আপনি তাঁকে ডেলিভারির সময় মুরালির গ্রিপের অনুকরণ করে বুঝিয়ে এলেন, ‘না বোঝার কী আছে? এটা হলো দুসরা।’
সারওয়ান তাও অকূল পাথারে। মুরালির পরের ওভারে চার বলের মধ্যে দুটি ছক্কা মেরে আপনি সারওয়ানকে গিয়ে বললেন, ‘ওই দুটি বল ছিল দুসরা।’
চলে যাচ্ছেন যান। চলে যাওয়া মানেই তো সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। গল্পগাথা মনে হওয়া এই ঘটনাগুলো তো রইলই। আর রইল আপনার ব্যাটিংয়ের ভিডিও।
ইতি,
উৎপল শুভ্র
কিংস্টন, জ্যামাইকা
২২ এপ্রিল, ২০০৭