ম্যারাডোনাকে নিয়ে ভালদানো

উৎপল শুভ্র

৪ এপ্রিল ২০২১

ম্যারাডোনাকে নিয়ে ভালদানো

ছবি: পোপারফটো

ডায়েরিতে না লিখে এটা বোধ হয় ‘ছুটির দিনে’র কী পড়ছি-কী দেখছি বিভাগে লিখলেই ভালো হতো! বিষয়টা যে তা-ই। সর্বশেষ যা পড়লাম, মূলত তারই প্রতিক্রিয়া। খেলার পাতাতেই লিখছি, কারণ বিষয় ম্যারাডোনা।\r\n\r\nজার্মানিতে বই-ম্যাগাজিনের দোকানে ঢুকে মূলত ছবিই দেখতে হয়, প্রায় সবই যে

প্রথম প্রকাশ: ১৮ জুন ২০০৬। প্রথম আলো।

ডায়েরিতে না লিখে এটা বোধ হয় ‘ছুটির দিনে’র কী পড়ছি-কী দেখছি বিভাগে লিখলেই ভালো হতো! বিষয়টা যে তা-ই। সর্বশেষ যা পড়লাম, মূলত তারই প্রতিক্রিয়া। খেলার পাতাতেই লিখছি, কারণ বিষয় ম্যারাডোনা।

জার্মানিতে বই-ম্যাগাজিনের দোকানে ঢুকে মূলত ছবিই দেখতে হয়, প্রায় সবই যে জার্মান ভাষায়। গত পরশু সকালে গেলসেনকারসেন স্টেশনে তা-ই দেখতে দেখতে হঠাৎ পেয়ে গেলাম বিশ্বকাপ ফুটবলের ওপর জার্মানির বিখ্যাত সাময়িকী স্পিগেলের বের করা আন্তর্জাতিক সংস্করণ। ‘আন্তর্জাতিক’ বলেই ইংরেজিতে এবং সেটি অসাধারণ সব লেখায় সাজানো। ফুটবলকে শুধুই খেলার চোখে না দেখে এর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সব ব্যাপারই এসেছে লেখাগুলোতে। আছে একটা সাক্ষাৎকারও। যার সাক্ষাৎকার, তিনি সাবেক ফুটবলার, বিশ্বকাপ জিতেছেন, ফাইনালে একটি গোলও করেছিলেন। তবে ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের মিডফিল্ডার হোর্হে ভালদানোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার আসল কারণ এটি নয়। সাক্ষাৎকারের বিষয় ‘পুঁজিবাদ ও সৃজনশীলতা’—এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে ভালদানো ফুটবলারের চাইতেও বেশি কিছু।

আসলেই তা-ই। ফুটবলের আগাপাশতলা তার চেয়ে বেশি খুব কম মানুষই দেখেছে। খেলোয়াড় হিসেবে অনেক সাফল্য, কোচের ভূমিকায় শিরোপা জিতিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবকে। সেই ক্লাবেরই কমকর্তা হয়ে জিদান-রোনালদো-বেকহামদের পেছনে ২০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করে রিয়ালকে ব্যবসা বুঝিয়েছেন। বাজারে তার বই আছে, পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন, সেগুলোতে উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও হোর্হে লুইস বোর্হেস থেকে উদ্ধৃতি থাকে। এরপর তাকে ‘ফুটবলের দার্শনিক’ বলাটা খুবই স্বাভাবিক। সাক্ষাৎকারে ফুটবল-ব্যবসা-পুঁজিবাদ অনেক বিষয়ই এসেছে। পুরোটাই অসাধারণ। তবে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য ম্যারাডোনা বিষয়ক অংশটুকুকেই বেছে নিলাম। ম্যারাডোনাকে নিয়ে এমন অসাধারণ বিশ্লেষণ এর আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না।

স্পিগেল: ম্যারাডোনা তো আপনার বন্ধু, বলুন তো তার এমন পরিণতি হলো কেন?

ভালদানো: ম্যারাডোনার এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাতারাতি ও হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটিদের একজন। ওর জীবন হয়ে গেল দর্শনীয় একটা জিনিস—এতে তাঁর সম্মতি আছে কি নেই, এটা কোনো বিবেচনাই ছিল না। ম্যারাডোনার মতো বিখ্যাত হওয়াটা দুর্বহ এক ভার। ম্যারাডোনার কাঁধে আর্জেন্টাইনদের চাপিয়ে দেওয়া তারকাখ্যাতির বোঝাটা এমনই ভারী ছিল যে, ম্যারাডোনা কখনোই মুক্ত-স্বাধীন হতে পারেনি। আর্জেন্টিনার গত ৩০ বছরের ইতিহাস দেখলে আপনি শুধু পতনই দেখবেন। সামরিক অভ্যুত্থান, আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, লাখ লাখ মধ্যবিত্তের দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া—দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটা দেশ। এসব থেকে বাঁচার অবলম্বন ছিল ওই একটাই লোক—ম্যারাডোনা। এই দেশের কাছে সে হলো রূপকথার এক নায়ক, আধুনিক যুগের সেন্ট মার্টিন। পুরো জাতি তাদের জীবনের রূঢ় বাস্তবতা, হতাশা থেকে উত্তরণের সহায় ভাবছে তাকে—এই প্রত্যাশার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। ম্যারাডোনা তো শুধু ফুটবল মাঠেই ম্যারাডোনা হয়ে ফুটে ওঠে, তা করেই অবাস্তব এক প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে ও। মাঠের ম্যারাডোনা মাঠের বাইরেও সব সমস্যার সমাধান হবে—এটা একটা ভয়ঙ্কর ভুল ধারণা। আমি তো বলব, ম্যারাডোনা যা করেছে, তারই তুলনা নেই। দারিদ্র্যের চরম সীমা থেকে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছে ও। একবার নয়, অনেকবারই ও তা করেছে।

স্পিগেল: ম্যারাডোনার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?

ভালদানো: মাঝে-মধ্যে হয়। ফোনে কথা হয়। সবাই যে ম্যারাডোনাকে দেখে, ব্যক্তিগত জীবনের ম্যারাডোনা তার চেয়ে একেবারেই আলাদা। সেখানে ওর মতো মজার লোক আর হয় না। এই তো সম্প্রতি আমাদের কথা হলো। আমাকে ফোনে ধরার জন্য বারবার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত আমাকে পাওয়ার পর বলল, ‘হোর্হে, কী ব্যাপার, তোমাকে ধরাটা দেখছি খুব কঠিন! নিজেকে তুমি কী ভাবো? ম্যারাডোনা?’

যাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে, তিনি ভালদানো। আর যাঁকে দেখা যাচ্ছে না, তিনি আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি পরতেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

স্পিগেল: তাঁর বর্তমান অবস্থা কী?

ভালদানো: সে ওজন কমিয়েছে। তাঁর টক শো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান। এক সময়ের পাগলাটে ব্যক্তিগত জীবনেও পাগলাটে এক ব্যক্তিত্ব। ম্যারাডোনা-সম্পর্কিত যেকোনো কিছুই বিশাল। এমনকি তার শত্রুরাও বড় বড়: মেনেম, পোপ, জর্জ ডব্লিউ বুশ। এ জন্য সাহস লাগে। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, ও কখনো পিছু হটে না, হাল ছাড়ে না।

স্পিগেল: রোমান্টিক এক চরিত্র।

ভালদানো: তবে ওর সময়েও কিন্তু টেলিভিশন খেলার শুরুর সময়টা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল। এটা একটা দিক। অন্য দিকটা হলো, ম্যারাডোনা নিজে ছিল শিল্প। ছিল সহজাত এক শিল্পী, যার নিজেরই জানা ছিল না সে কী করছে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে যখন ড্রেসিংরুমে বসে ছিলাম, আমাদের ঘিরে ছিল মৃত্যুর মতো এক স্তব্ধতা। এটাই স্বাভাবিক, আমরা জানতাম, আমাদের পুরো জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্তটা অপেক্ষা করছে বাইরে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই ম্যারাডোনা ওর মাকে ডাকতে ডাকতে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ওর মায়ের নাম টোটা। ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘টোটা, তুমি এসে আমার পাশে দাঁড়াও। আমি ভয় পাচ্ছি।’ আমাদের প্রতি ওর বার্তাটা ছিল খুব পরিষ্কার: ভয় পেলেও তোমাদের উদ্বেগের কিছু নেই। কারণ ম্যারাডোনাও ভয় পাচ্ছে। ও ছিল ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জিনিয়াস। একমাত্র ফুটবল মাঠেই ও সুখী থাকত। বল ছাড়া ও বাকিদের মতোই সাধারণ এক মানুষ, শুধু স্মৃতি সম্বল করে যার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×