মুরালিধরন ‘জিনিয়াসের’ ব্যাখ্যা খুঁজতে কুন্ডেসালে মুরালিধরনের বাড়িতে
উৎপল শুভ্র
৪ এপ্রিল ২০২১
ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার, সবচেয়ে বড় বিতর্কের নামও। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তাঁর ওপর দিয়ে, বেশির ভাগ খেলোয়াড় তা সামলে পারফর্ম করা দূরে থাক, খেলা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচত। কোথা থেকে পেলেন মুরালিধরন এই অসম্ভব মানসিক শক্তি? তা খুঁজতেই ক্যান্ডি শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের শহরতলি কুন্ডেসালে মুরালিধরনদের বাড়িতে যাওয়া। এই লেখায় সেই গল্পই।
প্রথম প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।
ক্যান্ডি নামটা এসেছে ‘কানডা উডা রাতা’ থেকে। ইংরেজিতে কানডা উডা রাতা মানে ‘ল্যান্ড অব মাউন্টেনস’। বাংলা কী হবে—পাহাড়ের শহর? এই শহরের এক মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁত আছে বলে দাবি। কাচের একটা আধারে রাখা সেই দাঁত হাতির পিঠে চড়িয়ে বার্ষিক একটা শোভাযাত্রাও হয় এখানে। তা দেখতে বিপুল পর্যটক সমাগমও হয়। ক্রিকেট বিশ্বের কাছে অবশ্য পাহাড়, মন্দির বা বুদ্ধের দাঁত নয়, ক্যান্ডির একটাই পরিচয়—মুুত্তিয়া মুরালিধরনের শহর।
ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার, অফ-লেগ সব মিলিয়েই তাঁকে সর্বকালের সেরা স্পিনার বলে মানেন অনেকে। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রও। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তাঁর ওপর দিয়ে, বেশির ভাগ খেলোয়াড় তা সামলে পারফর্ম করা দূরে থাক, খেলা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচত। কোথা থেকে পেলেন মুরালিধরন এই অসম্ভব মানসিক শক্তি? তা খুঁজতেই কাল সকালে ক্যান্ডি শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের শহরতলি কুন্ডেসালে যাওয়া। সেখানেই যে মুত্তিয়া মুরালিধরন নামের বোলিং-বিস্ময়ের জন্ম।
কিন্তু মুরালির বাবা সিন্নাস্যামি মুত্তিয়ার সঙ্গে কথা বলে মুরালি-রহস্য উদঘাটন দূরে থাক, উল্টো আরও ধাঁধায় পড়ে যেতে হলো। এমন সাদাসিধে এক পরিবারে জন্ম নিয়ে কীভাবে মুরালিধরন মুরালিধরন হলেন!
সাদাসিধে বলতে আচার-আচরণের কথা বলছি। আর্থিক অবস্থা নয়। বাবা-মায়ের জীবন-দর্শনের কারণে মুরালিধরন হয়তো অঢেল প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হননি, তবে আর্থিক কষ্টের সঙ্গে পরিচয় হয়নি কখনোই। ১৯৬৪ সালে ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ছোট্ট একটা ছাপরা-ঘরে যে লাকিল্যান্ড বিস্কিটস ফ্যাক্টরির জন্ম দিয়েছিলেন মুরালির বাবা, ক্রমশ ফুলে-ফেঁপে উঠে সেটিই এখন ক্যান্ডির সবচেয়ে বড় বিস্কিট ফ্যাক্টরি। শ্রীলঙ্কার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং ইংল্যান্ডেও যায় এই বিস্কিট। মাসে লেনদেন হয় সাত কোটি টাকার ওপরে।
বিশাল জায়গা নিয়ে তিনতলা ভবন, ফ্যাক্টরি আর অফিসও সেখানেই। পেছনেই মুরালিধরনদের বাড়ি। ‘তখন আর এখন’-এর নিদর্শন হয়ে পাশাপাশি দুটি বাড়ি। জীর্ণ-রঙচটা পুরোনো বাড়িটার পাশেই ঝকঝকে নতুন বাড়ি, যে বাড়ির গ্যারেজে নতুন তিনটি গাড়ি। তারই একটি দেখিয়ে মুত্তিয়া বললেন, ‘ওই গাড়িটা মুরালির।’
ইংরেজি একটু-আধটু বুঝলেও বলতে পারেন না প্রায় একদমই। লাকিল্যান্ড বিস্কিটসের সেলস ম্যানেজারকে তাই দোভাষীর কাজ করতে হলো। এটা তো পরের কথা। মুরালিধরনের বাবাকে প্রথম দেখার বিস্ময়টা আগে বলি। চেহারায় এমন মিল যে, দেখলেই যে কেউ চিনে ফেলবেন। কিন্তু এত বড় একটা বিস্কিট ফ্যাক্টরির মালিক হয়েও তিনি যে অন্য সব কর্মচারীর সঙ্গে একই ঘরে বসবেন, শুধু সামান্য একটু বড় টেবিল ছাড়া অন্যদের সঙ্গে আর কোনো পার্থক্য থাকবে না—এটা কীভাবে ভাববেন? কথা বলতে গিয়ে তাঁকে যেমন মনে হলো, বাংলায় সেটিকে বলে ‘মাটির মানুষ’। এত বড় একজন তারকার বাবা, নিজেরও টাকা-পয়সা কম নেই, অথচ লাজুক-লাজুক একটা ভাব সারাক্ষণ খেলা করল তাঁর মুখে।
ছোটবেলায় কেমন ছিলেন মুরালি? ‘খুব শান্ত। কোনো কিছু নিয়েই উত্তেজিত হতো না। শুধু ক্রিকেট বলতে পাগল ছিল’—টেস্টে ৬৮৮ ও ওয়ানডেতে ৪৩২ উইকেট এবং খ্যাতি-অর্থও তাঁর ছেলের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি, বলার সময় গর্বিত পিতার হাসি খেলা করে গেল মুত্তিয়ার মুখে। পরিবারের কারও তো নয়ই, আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও কারও ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্রব ছিল না, এখনো নেই। অথচ মুরালি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ। মুত্তিয়া জানালেন, পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। এক মাস পরই ফিরে এসেছেন শ্রীলঙ্কায়, শুধুই ক্রিকেট খেলার জন্য। তবে একদিন বড় ক্রিকেটার হতে হবে—এমন কোনো স্বপ্নই নাকি তাঁর ছিল না। শুধুই খেলার আনন্দে খেলাটাই ছিল মুরালির ধ্যান-জ্ঞান। তা খেলতে খেলতেই ক্রিকেট ইতিহাসের ‘গ্রেট’দের একজন হয়ে গেছেন তাঁর ছেলে—কেমন লাগে এটা ভাবতে? মুত্তিয়ার মুখে তামিল শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, কী আর বলবেন, ‘আমার খুব গর্ব হয়’—এই তো! আসলে কী বললেন, জানেন? ‘মুরালি আজ যা হয়েছে, পুরো কৃতিত্বই ওর কোচ সুনীল ফার্নান্দোর।’
মাঝখানে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে এত যে ঝড়ঝাপ্টা গেল, মুরালি কীভাবে সামলালেন সব? কোথায় পেলেন এই মানসিক শক্তি? এখানেও মুত্তিয়া নিজের কোনো অবদান দেখলেন না, ‘অর্জুনা রানাতুঙ্গা ওকে বলেছিল, যা-ই হোক, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি একটুও ভেবো না, যা হবে দুজন মিলে সামলাব।’ এতে মুরালির মায়েরও অবশ্য অবদান দেখছেন, ‘ও ওর মাকে সব বলে। ও এমনিতেই খুব ঠান্ডা ছেলে। ওর মা-ও ওকে এমন থাকতে সাহায্য করে।’ শুনে মুরালির মায়ের সঙ্গেও একটু কথা বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু তিনি গেছেন ক্যান্ডিতে শপিংয়ে।
তামিল আর সিংহলিজের সীমা ছাড়িয়ে মুরালিধরন হয়ে উঠেছেন শ্রীলঙ্কার জাতিগত ঐক্যের প্রতীক। বাবার কাছে এর আসল কারণ ক্রিকেটীয় নয়, ‘মুরালিকে যে সবাই খুব ভালোবাসে, এর আসল কারণ হলো মানুষ হিসেবে ও একটুও বদলায়নি, আগের মতোই আছে।’
শ্রীলঙ্কায় তামিল আর সিংহলিজদের মধ্যে এমন হানাহানি, তামিল মুত্তিয়াদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি? পড়েছিল, তবে তা মুত্তিয়া মুরালিধরন ক্রিকেট মাঠে তাঁর বোলিং-জাদু দেখানো শুরু করার আগে। ১৯৮৩ সালে শ্রীলঙ্কায় জাতিগত দাঙ্গার সময় তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মুরালিধরন মুরালিধরন হয়ে ওঠার পর তামিল আর সিংহলিজের সীমা ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন শ্রীলঙ্কার জাতিগত ঐক্যের প্রতীক। সব শ্রীলঙ্কানের ভালোবাসার ধন। বাবা সিন্নাস্যামি মুত্তিয়ার কাছে এর আসল কারণ ক্রিকেটীয় নয়, ‘মুরালিকে যে সবাই খুব ভালোবাসে, এর আসল কারণ হলো মানুষ হিসেবে ও একটুও বদলায়নি, আগের মতোই আছে।’
মুরালি যতই আগের মতো থাকুন, মুরালির বাবা বলে শ্রীলঙ্কানদের চোখে সিন্নাস্যামি মুত্তিয়া নিশ্চয়ই অন্যরকম। সেটি তিনিও প্রতিনিয়তই টের পান। একটা উদাহরণও দিলেন। একবার ট্রাফিক আইন ভাঙার অপরাধে তাঁর ড্রাইভারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার আইন খুব কড়া, শাস্তি অবধারিত। অথচ বিচারক যখন জানলেন, আসামি মুরালিধরনের বাবার ড্রাইভার, সঙ্গে সঙ্গে বেকসুর খালাস দিয়ে দিলেন তাঁকে!
মুরালি কীভাবে মুরালি হলেন—কুন্ডেসালে মুরালিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। পেলাম সেই পুরোনো উত্তরটাই।
জিনিয়াসদের ব্যাখ্যা হয় না!
আরও পড়ুন......
• সবার ওপরে মুরালিধরন
• ক্রিকেটীয় রূপকথা লিখে শেষ মুরালির
• সেই মুরালি এই মুরালি
• ‘আমার শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে’