সাকিবের সঙ্গে `ঢাকা টু মাগুরা`
উৎপল শুভ্র
২৪ মার্চ ২০২১
সাকিবের সঙ্গে ‘ঢাকা টু মাগুরা’ পরিকল্পনাটা হুট করেই। আবার প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার সাকিবময় হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে বিশেষ কী করা যায় ভাবছি, তৃতীয় ট্রফিটা নিয়ে এসে সাকিব বললেন, পরদিন চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, সেখান থেকে ফিরেই মাগুরায়। বিদ্যুচ্চমকের মতো চিন্তাটা খেলে গেল—আচ্ছা, সাকিবের সঙ্গে মাগুরা গেলে কেমন হয়!
প্রথম প্রকাশ: ৭ জুলাই, ২০১২। প্রথম আলো।
রোমাঞ্চকর এই গল্পটার যেখানে শুরু, লেখাটাও না-হয় সেখান থেকেই শুরু হোক। চলুন, ঘুরে আসি আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে। গত ১৬ জুন রোদতপ্ত দুপুরে যেখানে দাঁড়িয়ে স্মৃতিকাতর চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন সাকিব আল হাসান।
বড় রাস্তার পাশে বিশাল মাঠ। মানুষের পায়ে পায়ে মাঝখানে ফুট তিনেক চওড়া কোনাকুনি একটা পায়ে চলার পথ তৈরি হয়েছে। প্রথম আলোর আলোকচিত্রী শামসুল হকের অনুরোধে সাকিব যখন ওই ‘রাঙামাটির পথ’ ধরে হাঁটেন, দৃশ্যটা প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়ে যায়। পেছনে পেরিয়ে আসা পথ, সামনে পথ এগিয়ে যাওয়ার—সাকিব হেঁটে যাচ্ছেন...গন্তব্য কি অমরত্ব?
‘অমরত্ব-টমরত্ব’-জাতীয় ভাবালুতা সাকিবের একদমই নেই। তবে ১১ বছর পর এই মাঠে আবার পা দিয়ে একটু স্মৃতিকাতর তো বটেই। সেটি প্রকাশ করার আগেই অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ‘নিয়ম’ হয়ে যাওয়া মধুর বিড়ম্বনার কবলে। সাকিবকে দেখতে পেয়ে ভিড়টা দেখতে না দেখতেই বেশ বড়। অটোগ্রাফ-প্রার্থী মাত্র দুই-তিনজন, তবে সাকিবের সঙ্গে ছবি তোলা চাই সবারই। আবদার মিটিয়ে শেষ করা যাচ্ছে না দেখে মাঠটায় আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে দ্রুতপায়ে গাড়িতে ফিরতে হলো।
সাকিব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে আলোকদিয়ার মাঠে যেতে চাই বলার পর ‘ওই মাঠে গিয়ে কী হবে’-জাতীয় একটা প্রতিক্রিয়া ছিল। এখন ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, মাঠটাতে ফিরে তাঁর ভালোই লেগেছে। প্রশ্ন করি, এত দিন পর এই মাঠে এসে কী মনে হলো? সাকিব যেন একটু আনমনা, ‘মনে হচ্ছিল, এই মাঠ থেকেই সব শুরু হয়েছিল। এই মাঠের জন্যই এত দূর এসেছি।’ তাহলে তো এখানে একটা মনুমেন্ট-জাতীয় কিছু বসানো উচিত, যাতে লেখা থাকবে, ‘ভাইসব, এটি যেনতেন মাঠ নয়, এখানেই বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারের যাত্রা শুরু।’ সাকিবের রসবোধ ভালো। তিনি হেসে উত্তর দেন, ‘আপনি একটা উদ্যোগ নেন তাহলে।’
আলোকদিয়ার আলো
২০০১ সালে ক্লাস সেভেনের এক কিশোর আলোকদিয়ার ওই মাঠটাতে ‘খ্যাপ’ খেলতে গিয়েছিল। মাগুরা থেকে বাসের ছাদে চেপে। বাসে সিট ছিল না এমন নয়। কিন্তু ছাদে যে খুব মজা! রাস্তার দুই পাশ থেকে রাস্তার ওপরে এসে পড়া গাছের ডালে বাড়ি খাওয়ার ভয় আছে। মাথা এদিক-ওদিক সরিয়ে, কখনো বা শুয়ে পড়ে সেগুলো এড়ানোর ‘খেলা’টা বড় রোমাঞ্চকর! ম্যাচটা ছিল টেপ টেনিসের। দলের নাম মনে নেই, কত ওভারের খেলা, রানটান কত করেছিল—সেসবও না। ১১ বছর পর ওই কিশোরের শুধু মনে পড়ে, সে খুব ভালো খেলেছিল আর তার খেলা দেখে ওই ম্যাচের আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন (গোর্কি) তাকে বলেছিলেন, ‘মাগুরায় ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব নামে আমার একটা ক্লাব আছে। তুমি খেলতে চাইলে আসতে পারো।’
ওই কিশোর তখন মারকাটারি ব্যাটিং করে আর সঙ্গে পেস বোলিং। ইসলামপুরপাড়া ক্লাবের নেটে প্রথমে পেস বোলিং করল, পরে শখের স্পিন। সাদ্দাম দেখেটেখে বললেন, ‘তুমি স্পিনই করো।’ কদিন পরই মাগুরা লিগে অভিষেক। সত্যিকার ক্রিকেট বলে প্রথম বোলিং, প্রথম বলেই উইকেট! শুরু হলো সাকিব আল হাসানের গল্প। যে গল্পের শিরোনাম হতে পারে—ফ্রম মাগুরা টু ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ান।
সাকিবের সঙ্গে মাগুরায়
সাকিবের সঙ্গে ‘ঢাকা টু মাগুরা’ পরিকল্পনাটা হুট করেই এসেছিল মাথায়। গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানটা সাকিবময় হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে বিশেষ কী করা যায় ভাবছি, তৃতীয় ট্রফিটা নিয়ে এসে সাকিব বললেন, পরদিন চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, সেখান থেকে ফিরেই মাগুরায়। বিদ্যুচ্চমকের মতো চিন্তাটা খেলে গেল—আচ্ছা, সাকিবের সঙ্গে মাগুরা গেলে কেমন হয়! বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের উৎসমুখটা দেখে আসা যাবে। প্রস্তাবটা দেওয়ার পর সাকিব ‘সমস্যা কী, চলেন’ বললেন বটে, তবে তাঁকে যে খুব উৎসাহী বলে মনে হলো, তা নয়। সেটিই স্বাভাবিক। কয়েকটা দিন নিজের মতো কাটাতে বাড়ি যাচ্ছেন। সাংবাদিকের উটকো ঝামেলা কে চায়! তবে মনে যা-ই থাক, মুখে তার প্রকাশ নেই। শুধু বললেন, ‘মাগুরা গিয়ে কী করবেন? আমি ওখানে সারা দিন শুধু ঘুমাব।’ ছুটির প্রথম দুই দিন সেই ঘুম বিসর্জন দিয়ে সাকিব ঠিকই আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন তাঁর শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত শহরে।
যাত্রা হলো শুরু
ঢাকা থেকে বিমানে যশোর, সেখান থেকে গাড়িতে মাগুরা এক ঘণ্টার পথ। ১৫ জুন সাতসকালে ঢাকা-যশোর ফ্লাইট। বিমানবন্দরে পৌঁছাতে একটু দেরিই হয়ে গেল। এয়ারলাইনসের কাউন্টারের সামনে বসে সাকিব মোবাইলে গেম খেলছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি ফ্লাইট মিস করবেন।’ এটা আপনার ‘আশঙ্কা’ ছিল, না ‘আশা’? অন্য কেউ হলে হয়তো ‘ছি ছি কী বলেন’ বলে তীব্র প্রতিবাদ হতো। সাকিব শুধু হাসলেন। একটু পর সাকিবের সঙ্গে ছবি তুলতে এলেন রায়হান নামে পুলিশের এক সদস্য। তাঁর দেখাদেখি আরেক যাত্রী। বললাম, ‘মাত্র দুজন! আমি তো ভেবেছিলাম, বিমানবন্দরে ছবি তোলার একটা হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যাবে।’ সাকিব আবার হাসলেন, ‘আপনার ধারণা ঠিকই আছে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লাইনে যতজনকে দেখছেন, সবার ছবি তোলা কমপ্লিট।’
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়-কথা
বিমানে উঠে প্রথম আলোর খেলার পাতায় আগের দিন চট্টগ্রামে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনার ছবিটা দেখেই প্রথম পাতায় চলে এলেন সাকিব। একটা নিউজ পড়তেও শুরু করলেন। কী পড়ছেন, তা দেখে রীতিমতো বিস্মিত—‘বাজেটে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে।’ কী ব্যাপার, বাজেট নিয়ে আপনার আগ্রহ? ‘আমি দেশের সব খোঁজখবর রাখি তো! টিভিতে নিয়মিত নিউজ দেখি’ বলে একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘মাঝেমধ্যে এ-ও ভাবি, প্রধানমন্ত্রী হলে আমি কী কী করতাম!’
মনে করার চেষ্টা করছি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দেশের বাইরে আর সাকিব বাংলাদেশে—সর্বশেষ কবে হয়েছে এমন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ২০০৮ সালে পাকিস্তান এশিয়া কাপে। এইচএসসি পরীক্ষার জন্য সাকিব যাননি। সাকিবের সঙ্গে দুষ্টুমি করি, ‘আচ্ছা, আপনি যে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পাস করেছিলেন?’ ‘পাস করব না মানে... ক্রিকেটের জন্যই-না পড়াশোনা করলাম না, নইলে ছাত্র ভালোই ছিলাম। ফোর্থ সাবজেক্ট ছাড়াই থ্রি পয়েন্ট নাইন জিরো পেয়েছি’...বলতে বলতে সাকিবের মুখে হাসি ফোটে, ‘ওই পরীক্ষার একটা মজার গল্প আছে।’
বলেন, বলেন...
‘আমার ফোর্থ সাবজেক্ট ছিল যুক্তিবিদ্যা। প্রশ্ন পাওয়ার পর দেখি কিছুই পারি না। পরদিন ইতিহাস পরীক্ষা, আমি যুক্তিবিদ্যার খাতায় ইতিহাসের একটা প্রশ্ন লিখতে শুরু করলাম। ওই পরীক্ষার সময় এক ম্যাডাম এসে নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিতেন। তো সেদিনও এসেছেন। কী লিখছি জানতে চাইলে বললাম, পরদিন ইতিহাস পরীক্ষায় এই প্রশ্নটা আসবেই, তাই প্র্যাকটিস করছি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “তুমি কীভাবে জানো?” আমি বললাম, “কীভাবে জানি জানি না, তবে আমি জানি।” পরদিন ইতিহাস পরীক্ষার খাতা দেওয়ার পর প্রশ্ন দেওয়ার আগেই আমি ওই প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করেছি। ওই ম্যাডাম আবার এসে বললেন, “যদি এই প্রশ্নটা না আসে?” আমি বললাম, “না এলে, না আসবে। তবে আমি জানি, আসবেই।” প্রশ্ন দিল, এক নম্বরেই ওই প্রশ্নটা। ম্যাডাম এমন অবাক হলেন যে দেখে মনে হলো উনি হয়তো ভাবছেন, আমি আগেই কোনোভাবে প্রশ্ন পেয়ে গেছি।’
আসলে তা পাননি, তাহলে এর ব্যাখ্যা কী? ‘আমি অনেক কিছুই আগে থেকে বুঝতে পারি। অনেক ম্যাচে যা বলেছি, তা-ই হয়েছে। লাস্ট এশিয়া কাপেই যেমন ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচে বলেছি, রিয়াদ ভাই চার মেরে জেতাবেন। তা-ই হয়েছে। আইপিএল ফাইনালে আমি আর মনোজ (তিওয়ারি) প্যাড পরে বসে আছি। সবাই খুব টেনস্ড। আমি বললাম, যখন বিশ-টিশ রান লাগবে, আমি আর মনোজ ম্যাচটা জেতাব। তা-ই হলো।’
এসব হয়তো কাকতালীয়। তবে প্রশ্ন মিলে যাওয়ার পেছনে কার্যকারণ আছে। ক্রিকেট-ব্যস্ততার কারণে খুব একটা পড়াশোনা করতে পেরেছেন কই! আগের কয়েক বছরের প্রশ্ন দেখে নিজেই একটা সাজেশন বানিয়েছেন। ‘পাঁচ-ছয় বছরের প্রশ্ন দেখলে এবার প্রশ্ন কী হবে, তা বোঝা যায়। বিকেএসপিতে পড়ার সময়ও আমি এটাই করতাম।’
যশোর থেকে মাগুরা
যশোর বিমানবন্দরে নেমে সাকিব জিজ্ঞেস করেন, মাগুরায় আপনি কোথায় উঠবেন? আমি বললাম, ‘এই প্রশ্নটা কি ঠিক হলো! আপনার সঙ্গে মাগুরায় যাচ্ছি। একটা ভদ্রতার ব্যাপার আছে না! কোথায় বলবেন, দুই দিনের ব্যাপার, হোটেলে ওঠার দরকার কী, আমাদের বাড়িতেই থাকবেন; উল্টো জিজ্ঞেস করছেন, কোথায় উঠব?’ এ কথার পর সাকিব কী বলতে পারেন অনুমান করা খুব সহজ, ‘চলেন, আমার বাড়িতে। ভয় পাই নাকি?’ অথচ সাকিব কিছু না বলে শুধু হাসলেন। সাকিব আল হাসানের কাছে সামাজিকতা-সৌজন্যের সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন। আগেই জানিয়েছি, আমি অন্য কোথাও উঠব। লোক দেখানো ভদ্রতা বা আদিখ্যেতাটা একদমই তাঁর ধাতে নেই।
যশোর বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা। গাড়ির সামনের সিটে সাকিব, পেছনে বসলাম আমরা দুজন। টয়োটা এলিয়েন গাড়িটা সাকিবই বাবা-মায়ের জন্য মাগুরা পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুপাশে একঘেয়ে প্রকৃতি দেখি আর সাকিবের বাবার সঙ্গে এটা-ওটা কথা বলি। এই যে সাকিব আজ দেশের মানুষের নয়নমণি—কেমন লাগে আপনার? সাকিব লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, ‘আব্বুর ইন্টারভিউটা মাগুরা গিয়ে করেন না!’
সাকিবের নাম ফয়সাল
মাগুরায় গিয়ে উঠলাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডাকবাংলোতে। কথামতো বিকেলে এলেন সাকিব। আগেই বলে রেখেছিলাম, মাগুরা শহরটা ঘুরে দেখাতে হবে। রিকশায় উঠতে যাচ্ছি, এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ফয়সাল, কবে এসেছ?’ ফয়সাল! ফয়সালটা আবার কে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও কয়েকবার ‘ফয়সাল, কী খবর’ ‘ফয়সাল, কদিন আছ’ শুনে বোঝা গেল মাগুরায় এটাই সাকিবের পরিচয়। রিকশায় করে এ-রাস্তা সে-রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি আর সাকিব ধারাবর্ণনা করে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই বললেন, ‘জানেন, বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের সঙ্গে প্রথম প্র্যাকটিস ম্যাচটা হেরে গেছে!’ যাননি বলে কি খারাপ লাগছে এখন? ‘না, বিশ্রামটা আমার খুব দরকার ছিল।’
রাস্তার পাশে একটা প্রাইমারি স্কুল। সাকিব বলেন, ‘আমি এই স্কুলে পড়েছি।’ একটু পরে আরেকটা প্রাইমারি স্কুল দেখিয়েও একই কথা। মানে কী? ‘আমি তিনটা প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। যখন যেটিতে পাঠানোর লোক থাকত, সেটিতেই ভর্তি করে দেওয়া হতো আমাকে।’ হাইস্কুলটাও দেখালেন একটু পরে। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ছায়াবাণী সিনেমা হলটা কই গেল?’ সিনেমা হল এখন মার্কেট। সাকিব একটু স্মৃতিকাতর, ‘আমার বন্ধুরা স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে আসত। স্যাররা আমাকে পাঠাত ওদের ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ আপনি সিনেমা দেখতে আসতেন না? ‘না, না আমি খুব ভদ্র ছেলে ছিলাম। এই যে দেখেন না, এই গার্লস স্কুলটা পথে পড়বে বলে আমি অনেক ঘুরে স্কুলে আসতাম।’
সন্ধ্যা নামছে। রিকশাটা তখন নির্জন একটা রাস্তায়। সাকিব, কখনো কি দূরতম কল্পনাতেও ভেবেছিলেন এই মাগুরা থেকে একদিন আপনি হবেন বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার? সাকিব ‘কী যে বলেন’ ভঙ্গিতে উত্তর দেন, ‘প্রশ্নই আসে না। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর বড়জোর জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেছি। এবার আইপিএল খেলার সময় আপনার এই প্রশ্নটা আমার মাথায়ও ঘুরত। কোথায় ছিলাম আর কোথায় এসেছি! কত কী হচ্ছে আমার জীবনে!’ এর মধ্যেই একটু দুঃখ হানা দেয়, ‘আইপিএলের ফাইনাল জেতার উত্সবের মধ্যে মাঠে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এশিয়া কাপটা যদি আমরা জিতে যেতাম, কী কী হতো! আইপিএলে শেষ ওভারে ৯ রান দরকার ছিল, এশিয়া কাপেও তা-ই। ইস্, আমি বা মুশফিক ভাই যদি আরেকটু থাকতে পারতাম।’
রিকশায় সাকিবকে দেখে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে অনেকে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় বেরোলে যে উন্মাদনাটা দেখা যায়, সেটি কই? সাকিব আগেই বলেছিলেন, ‘মাগুরায় গিয়ে দেখবেন আমাকে নিয়ে কোনো হইচই নেই।’ সেটি মনে করিয়ে দেওয়ায় ব্যাখ্যা দেন, ‘এখানে সবাই তো আমাকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। আমি এখানে ঘরের ছেলে।’
সাকিবকে নিয়ে মাগুরা স্টেডিয়ামে যাই। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি দাবি করেন, সাকিবকে প্রথম দেখেই নাকি তিনি বুঝেছিলেন এই ছেলে শুধু দেশের না, বিশ্বের মধ্যে নামকরা কেউ হবে! রুমের পেছনে জানালায় শিশু-কিশোরেরা ভিড় করে। ফোকলা দাঁতের সাত-আট বছরের একটা ছেলে বলে, ‘আপনারে নাকি তিন কোটি টাকা দিয়া শাহরুখ খান কিইন্যা নিছে!’ বলেই এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দেয়, ‘একটা অটোগ্রাফ লেইখ্যা দেন।’
নাতবউয়ের অপেক্ষায়
পরদিন সাকিবের গাড়িতে আলোকদিয়ার ওই মাঠে। সেখান থেকে ফেরার পথেই সাকিবের মামার বাড়ি। সাকিব অবশ্য বলেন নানিবাড়ি। কারণটা বোঝা গেল সেখানে যাওয়ার পরই। সত্তরোর্ধ্ব নানি ছায়েরা বেগম ছুটে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন সাকিবকে। এরপর সারাক্ষণই যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকতে চাইলেন নাতিকে। বাড়িতে একটা হুলস্থুল পড়ে গেল। সাকিবের পায়েস পছন্দ। দ্রুত তা রান্না হয়ে গেল। ৮৫ বছর বয়সী নানা সোলায়মান বিশ্বাস খুব অসুস্থ, হাঁটাচলা করতেও সমস্যা, তার পরও তাঁর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ঠিকই চোখে পড়ে। ছোটবেলায় সাকিব গল্প শোনার পাগল ছিলেন। নানা গল্প শোনাতেন, ‘একদিন তুমি অনেক বড় হবে। গাড়িতে করে মাগুরা আসবে। তোমাকে দেখতে সবাই ভিড় করবে।’ স্মৃতিচারণা করতে করতে সাকিব নানাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘নানা, মনে আছে আপনি যে এমন বলতেন!’ নানার ঘোলাটে চোখে আলো জ্বলে ওঠে।
মামারা গাছে আম রেখে দিয়েছেন সাকিব এসে পাড়বেন বলে। ভুলে কেউ এর একটা আম ছিঁড়ে ফেলেছে আবিষ্কৃত হওয়ার পর কাকে যেন বকাবকিও হলো। শৈশব-কৈশোরে এই নানিবাড়িতে প্রচুর সময় কেটেছে সাকিবের। বাড়ির উঠোন ঘেঁষেই আম-কাঁঠালের বাগান, এরপর একটু ধানী জমি শেষ হয়েছে গিয়ে নদীতে। হাঁটতে হাঁটতে সেই নদীর পাড়ে গিয়ে নানা পোজে ছবি তোলা হলো। পেছনে একটা গরু রেখে টেংকু ছবি তুলবেই। প্রথমে একটু আপত্তি করেও শেষপর্যন্ত সাকিব ঠিকই বসে পড়লেন ঘাসে।
নানিবাড়িতে ঢোকার আগেই সাকিব বলে দিয়েছিলেন, ‘দেখবেন, নানি বিয়ের কথা বলবে।’ কথার সত্যতা প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগল না। সাকিবের গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নানি বললেন, ‘এই নাতি আমার আকাশের চাঁদ, কেমন চাঁদ যে ঘরে আনবে কে জানে!’ নানি খুব চিন্তিত, নাতির বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছে! সাকিবের জন্য তো অনেক মেয়েই এখন পাগল। কেমন নাতবউ চান? ছায়েরা বেগম হাসেন, ‘ওর পছন্দমতো হলেই হলো।’
খেলার নেশায়
আলোকদিয়ার মাঠ আর নানিবাড়ি হয়ে দুপুরে সাকিবদের মাগুরার বাসায়। তিনতলা বাড়ি। সাকিবরা থাকেন দোতলায়। সাকিবের গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, হয়তো এ কারণেই পাশে বিশাল গ্যারেজের নির্মাণযজ্ঞ চলছে। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি, এলাহি আয়োজন। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের টেঙ্গাখালী থেকে তাজা মাছ কিনে এনেছেন সাকিবের বাবা। খেতে-খেতে এবং খাওয়ার আগে-পরে সাকিবের শৈশব-কৈশোর নিয়ে গল্প চলতে থাকে। মায়ের মুখে শুনি খেলাপাগল সাকিবের গল্প, ‘ছোটবেলা থেকে খেলার অস্বাভাবিক নেশা ছিল ওর। বাসায়ও সব সময় হাতে বল থাকতই। লোফালুফি করছে, নয়তো দেয়ালে মেরে ক্যাচ ধরছে, খাওয়ার সময় পর্যন্ত নাই। বিকেএসপিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে খাইয়ে দিতে হয়েছে আমাকে।’
খেলার জন্য মায়ের প্রশ্রয় ছিল, বাবার রক্তচক্ষু। দা দিয়ে সাকিবের বেশ কটি ব্যাটও নাকি কেটে ফেলেছেন বাবা। মারধরের চর্চা তো ছিলই। সাকিবের বাবার সঙ্গে রসিকতা করি, ‘আপনি যে সাকিবের ব্যাট কেটে ফেলতেন, এ জন্য বাংলার মানুষ তো আপনার ওপর ক্ষুব্ধ। সাকিব যদি আর না খেলত, তাহলে কেমন ক্ষতিটা হতো বলেন!’ মাশরুর রেজা বলেন, ‘যত শুনেছেন তত না। আমি একটা মাত্র ব্যাট কেটেছি, আর একটা ভেঙেছি। তখন তো ক্রিকেট এমন বড় কোনো খেলা ছিল না। তা ছাড়া সারা দিনের খেলা, পড়াশোনা করতে হবে না! ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই ওকে ক্রিকেট খেলতে বাধা দিতাম।’
আর এখন? এখন কেমন লাগে? বাবার চোখে গর্ব খেলা করে, ‘মানুষ বাবাকে দিয়ে ছেলেকে চেনে, আর আমার ক্ষেত্রে ছেলেকে দিয়ে চেনে বাবাকে। ব্যথা যেমন উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু বলে বোঝানো যায় না, এই অনুভূতিও বলে বোঝানো যাবে না। মাগুরার মতো ছোট্ট জায়গা থেকে আমার ছেলে আজ বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার!’
মায়ের চিন্তাটা ছিল খুব পরিষ্কার, ‘খেলাটা ওর এমন নেশা ছিল যে, মনে হতো খেলতে পারলে ওর পড়াশোনায় মন বসবে।’ সাকিবকে বিকেএসপিতে পাঠিয়েও তাই মায়ের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ঝরেনি, ‘মনে হতো খেলা ওর নেশা, ও খেলার জায়গায় গিয়েছে।’ তবে এতটা মায়েরও কল্পনা ছিল না, ‘চাওয়ার চেয়ে পাওয়া অনেক বেশি হয়ে গেছে। আল্লাহ দুই হাত ভরে দিয়েছে।’
বিদায়বেলায়
বিকেলে সাকিবের সঙ্গে আবার বের হই। ছোটবেলায় বাড়ির পাশে কোথায় কোথায় খেলতেন দেখাচ্ছেন আর টাইম মেশিনে চড়ে যেন ফিরে যাচ্ছেন সেসব দিনে। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত যে হাইস্কুলে পড়েছেন, সেই স্কুলের মাঠেও ‘এখানে খেলতাম’ ‘ওখানে খেলতাম’ স্মৃতির মিছিল। শিক্ষকদের রুমে যাওয়ার পর ছাড়া পাওয়াই মুশকিল। শিক্ষকেরা সব সমস্বরে বলছেন, ‘স্কুল ছুটি দিয়ে দিই, তুমি ওদের উদ্দেশে কিছু বলো।’ ‘আজ সাকিবকে নিয়ে আমার অনেক কাজ। অন্য কোনো দিন আসবে’ বলে আমিই কোনোমতে মুক্ত করে নিয়ে আসি। সেখান থেকে মাগুরা স্টেডিয়ামে আরেকটি চক্কর। আরেকজন সাকিবকে খুঁজে পাওয়ার আশায় সেখানে শিশু-কিশোরদের নিয়ে ব্যস্ত সাকিবের প্রথম কোচ সাদ্দাম হোসেন। সাকিবকে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হয়। আকাশের তারাকে পাশে পেয়ে তারা সবাই আনন্দে হাততালি দেয়।
সন্ধ্যা নামার পর সাকিব তাঁর গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে যান ডাকবাংলোয়। বিদায় নেওয়ার সময় বলেন, ‘রাতে ইমারজেন্সি কিছু হলে ফোন দিয়েন।’ বলেই কেন যেন লজ্জা পেয়ে যান। ‘একটু সামাজিকতা করলাম আর কি’ বলে হেসে ফেলেন।