ক্রাইস্টচার্চের রক্তাক্ত সেই ভয়াল দুপুর
উৎপল শুভ্র
৯ জানুয়ারি ২০২২
পরদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর কথা। যে টেস্ট আর শুরুই হয়নি কখনো। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে বর্ণোন্মাদ এক সন্ত্রাসীর হামলা এমনই কাঁপিয়ে দিয়েছিল সবাইকে যে, বাংলাদেশ দল পরদিনই ফিরে এসেছিল দেশে। মিনিট কয়েকের এদিক-ওদিক হলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও থাকতেন ওই মসজিদে। সেই ভয়াল দুপুরের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম আমিও।
লিখতে বসার আগে কল্পনাও করিনি, লেখাটা শুরু করতেই এমন কষ্ট হবে! ল্যাপটপের কি-বোর্ডে আঙুল রেখে মনিটরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হবে এভাবে! মিনিট বিশেক পর সচল আঙুল ওপরের দুটি লাইন লিখে আবারও নিশ্চল৷ কোত্থেকে শুরু করব? কী দিয়ে?
অথচ এই লেখাটা তো খুব সহজ হওয়ার কথা ছিল৷ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি নেই, ঝামেলা নেই রেফারেন্স খোঁজার, যা দেখেছি, যা শুনেছি, যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, সেটি তরতর করে লিখে ফেলব, এই তো! সেটিই যে এমন কঠিন হবে, কে জানত!
কারণ কী এই যে, ক্রাইস্টচার্চের সেই ভয়াল শুক্রবারে ফিরে যেতে চাইছে না মন! যেটির অবচেতন অংশ বলছে, কী দরকার সেই দুঃস্বপ্নকে ফিরিয়ে আনার! দুঃস্বপ্নেরও তো রকমফের থাকে৷ সেটি কি আর সবসময় এমন ভয়াবহ হয়! এ এমন এক দুঃস্বপ্ন, একটু এদিক-ওদিক হলেই গায়ের রঙের গর্বে উন্মাদ এক নরপিশাচের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা৷ একরকম নিশ্চিহ্নই হয়ে যেত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল৷ লাশ হয়ে যেতে পারতাম তামিম ইকবালের ভয়ার্ত ফোন পেয়ে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া আমরা তিন সাংবাদিকও!
পরে না জেনেছি, বাংলাদেশ দলের খোঁজে আমরা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি, একটু আগে আল নূর মসজিদ থেকে সেই রাস্তা দিয়েই হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় পর্ব চালাতে লিনউড মসজিদের দিকে ছুটে গেছে ঘাতকের গাড়ি৷ আর কয়েক মিনিট আগে হলেই আমরা যার মুখোমুখি হয়ে যেতাম৷ গায়ের রংই যেখানে একমাত্র বিবেচনা, বুলেটের ‘সদ্ব্যবহার’ হয়তো আমাদের গায়েও হতো৷
এসবই মনে হয়েছে পরে৷ তখন আমরা তিন সাংবাদিক-ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম, ডেইলি স্টারের মাজহারউদ্দিন, অমি আর আমি বলতে গেলে কিছুই না জেনে, কিছুই না বুঝে ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আল নূর মসজিদের দিকে৷ আমাদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তামিম ইকবালের একটা ফোন৷
পরদিন ক্রাইস্টচার্চে তিন টেস্ট সিরিজের শেষটি শুরু হওয়ার কথা৷ প্রিভিউ ডেতে এমনিতেই একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে৷ নিউজিল্যান্ডে আরও বেশি৷ সেদিন আবার সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃ্ষ্টি৷ নিউজিল্যান্ডের প্র্যাকটিস সেশন বাতিল হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশ দল মাঠে এলেও প্র্যাকটিস করবে কি না ঠিক নেই৷ বাংলাদেশে ঘড়ি নিউজিল্যান্ডের চেয়ে সাত ঘণ্টা পেছনে হাঁটে বলে মাঠে ল্যাপটপও নিয়ে যাইনি৷ দুই দলের সংবাদ সম্মেলন শেষ করে হোটেলে ফেরার পরও লেখার জন্য হাতে অঢেল সময়৷
সেই সংবাদ সম্মেলন শেষ হয়েছে একটু আগে৷ ইনজুরির কারণে কেন উইলিয়ামসন খেলবেন না বলে পরিবর্ত অধিনায়ক টিম সাউদি সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন উইলিয়ামসনের বদলী উইল ইয়াংকে সঙ্গী করে৷ যেটি শেষ করে সেই সিরিজ কাভার করতে যাওয়া আমরা বাংলাদেশের সাত সাংবাদিক অপেক্ষা করছি বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর জন্য৷ দুপুর ১টায় টিম বাস মাঠে ঢোকার পরও যিনি সংবাদ সম্মেলনে আসতে দেরি করছেন বলে আমরা একটু বিরক্ত৷ মাহমুদউল্লাহ এলেন ১টা ২৭ মিনিটে৷
হ্যাগলি ওভাল মাঠের পেছনে বিশাল যে হলরুমটাতে সংবাদ সম্মেলন হয়, আমি সেটির দরোজায় দাঁড়িয়ে৷ সেই হলরুমে ঢুকতে ঢুকতে মাহমুদউল্লাহ বললেন, ‘‘দাদা, আজ আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন প্লিজ৷ নামাজ পড়তে যেতে হবে৷ দেরি হয়ে গেছে৷’’
আমি বললাম, ‘‘আপনার তো ১টায় আসার কথা৷ দেরি করলেন কেন?’’
মাহমুদউল্লাহ বললেন, ‘‘কোচ হঠাৎ কথা বলতে চাইলেন৷’’
আমি বাকি সাংবাদিকদের বললাম, ‘‘রিয়াদের তাড়া আছে৷ আজ বেশি প্রশ্ন করার দরকার নেই৷’’ সংবাদ সম্মেলন শেষ ভেবে মাহমুদউল্লাহ উঠতে যাবেন, আমি হঠাৎ কী মনে করে প্রশ্ন করলাম, ‘‘এই যে দেশের বাইরে কঠিন কন্ডিশনে দুটি টেস্টে অধিনায়কত্ব করলেন, এ থেকে কী শিখলেন?’’ প্রশ্নটা না করলেই হয়তো খুশি হতেন, তারপরও মাহমুদউল্লাহ গুছিয়ে বেশ বড় একটা উত্তরই দিলেন৷ দিয়েই দৌড় লাগালেন ড্রেসিংরুমের দিকে৷
ঘণ্টা-মিনিট উল্লেখ করে এমন বিস্তারিত বলার কারণ আছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই যে এসব মহা তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেবে৷ কোচ যদি হঠাৎ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে না চাইতেন, আমি যদি শেষ প্রশ্নটা না করতাম, মসজিদে যাওয়ার জন্য বাসে ওঠার আগে ড্রেসিংরুমে শখের ফুটবল ম্যাচে যদি আরও কয়েক মিনিট দেরি না হতো...যতই এসব ভাবি, ততই মনে হয়, এর সবই ভাগ্যের লিখন৷ কিছুক্ষণ পরেই তো তামিম ইকবাল বলবেন, ‘‘আমরা আর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছালেই মসজিদে ঢুকে যেতাম৷ হয়তো সবাই শেষও হয়ে যেতাম৷’’ মেহেদী হাসান মিরাজ আমার হাত ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানাবেন, ‘‘ভাই, আপনাদের জন্য আজ আমরা বেঁচে গেছি৷ রিয়াদ ভাইয়ের প্রেস কনফারেন্সের কারণেই আমাদের মসজিদে যেতে একটু দেরি হয়েছে৷ দেড়টার মধ্যে আমাদের ওখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল৷’’
আমরা তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হাঁটছি৷ বিশাল হ্যাগলি পার্কের এক কোনে হ্যাগলি ওভাল মাঠের উদ্দেশে হাঁটতে হাঁটতে তামিম ইকবাল বলছেন, ‘‘টেস্ট ম্যাচ হলে হোক, আমি কালই দেশে ফিরে যাব৷ যা দেখেছি, কল্পনাও করতে পারবেন না৷ বাসের সামনে তিন-চারটা লাশ পড়ে আছে৷’’
তখন তো আমরা কেউই জানি না, মসজিদের ভেতরে গুলিতে ছিন্নভিন্ন আরও কত লাশ৷ যেমন জানতাম না, যে নিউজিল্যান্ডে রাত-বিরেতে রাস্তায় একা ঘুরে বেড়াতেও কখনো বিন্দুমাত্র ভয় লাগেনি, সেই নিউজিল্যান্ডই কেমন চিরতরে বদলে যাচ্ছে! কী ভেবে আমরা তিন সাংবাদিক আল নূর মসজিদের উদ্দেশে ছুটে গিয়েছিলাম, সেটিই কি জানি নাকি!
বাংলাদেশের বাস চলে যাওয়ার পর আমরা তখন হ্যাগলি ওভালের সামনে দাঁড়িয়ে৷ বৃষ্টি ততক্ষণে একটু ধরে এসেছে৷ ক্রিকেটাররা মাঠে ফিরে ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করতে পারেন৷ সেটি দেখতে অপেক্ষা করব নাকি মোটেলে ফিরে যাব—এই দোটানায় ভুগে একই মোটেলে ওঠা আমি আর ইসাম যখন ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তখনই তামিমের কলটা এসেছিল৷ দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে৷ মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে ইসাম বললেন, ‘‘তামিম ফোন করেছে৷ বাংলাদেশ দলের বাস মসজিদের সামনে আটকা পড়েছে৷ মসজিদে নাকি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে৷’’
কথাটা শোনার পর আমার প্রথম যে অনুভূতিটা হলো, সেটি অবিশ্বাস৷ হানাহানিময় এই উন্মত্ত পৃথিবীতে নিউজিল্যান্ড তো এক শান্তিরাজ্য৷ তা হয়ে থাকার জন্যই অস্ট্রেলিয়ার প্রবল চাপ উপেক্ষা করে কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি৷ এখানে কখনো সন্ত্রাসী হামলা হয় নাকি! তিনজনই বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ তখনই আবারও ফোন বাজল৷ এবার ইসামের পাশে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম তামিমের আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠও, ‘‘পুলিশকে খবর দেন প্লিজ৷’’
ইসাম হঠাৎই সোজা মেইন রোডের দিকে হাঁটতে শুরু করল৷ পেছন পেছন মাজহারও৷ আমিও ওদের পিছু নিলাম৷ মসজিদটা কোথায়, কেউই জানি না৷ শুধু জানি, মাঠের কাছেই৷ আমাদের হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে দেখে মাঠ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোতে থাকা এক মেয়ে গন্তব্য জানতে চাইলেন, দিতে চাইলেন লিফটও৷
মিনিট তিনেকের মধ্যেই মসজিদে যাওয়ার রাস্তার সামনে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে গেল গাড়ি৷ আমরা নেমে হাঁটতে শুরু করেছি৷ রাস্তায় শুধু পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স৷ সামনে এগোচ্ছি আর দেখছি ভীতিকর সব দৃশ্য৷ রাস্তার পাশে রক্তাক্ত একজন মানুষ শুয়ে৷ দুই–তিনজন প্যারামেডিক তাঁর পাশে৷ দেহে প্রাণ আছে বলে মনে হচ্ছে না৷ রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসছেন রক্তাক্ত এক তরুণ৷ কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ রাস্তার পাশে লাইটপোস্টে ভর দিয়ে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন৷
হঠাৎই একটু দূরে বাংলাদেশ দলের বাসটা দেখতে পেলাম৷ পাশের ফুটপাতে ক্রিকেটারদেরও৷ রাস্তাটা পেরিয়ে তাঁদের কাছে যেতে যেতে শুনলাম, কে যেন বলছেন, ‘‘কেউ দৌড় দিয়ো না৷ জোরে হাঁটো, কিন্তু দৌড় দিয়ো না৷’’ হাঁটুসমান উচ্চতার রেলিং টপকে হ্যাগলি পার্কে ঢুকে আমরা সবাই হ্যাগলি ওভাল মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম৷
হাঁটতে হাঁটতেই ক্রিকেটাররা যে যার মতো করে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন৷ বাংলাদেশ দলের বাসটা যখন মসজিদ থেকে সামান্য দূরে, পাশের এক গাড়ি থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে এক নারী বলেন, ‘‘তোমরা সামনে যেও না৷ গোলাগুলি হচ্ছে৷ আমার গাড়িতেও গুলি লেগেছে৷’’
বাসের মধ্যে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মাথা নিচু করে বসে থাকা আতঙ্কে অস্থির ক্রিকেটারদের কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করেন৷ একসময় তামিম ইকবালই বলেন, ‘‘চলো, আমরা সবাই নেমে মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করি৷’’
হ্যাগলি পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসা ওই পথটুকু আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ার্ত যাত্রা৷ সবারই তা-ই৷ কারোরই তো জানা নেই, কতজন সন্ত্রাসী, এখন তারা কোথায়৷ খোলা মাঠে সবাই তো সহজ টার্গেট৷ হ্যাগলি ওভালের ড্রেসিংরুমে ঢুকে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে৷ কিছুক্ষণ পর আমাদের তিন সাংবাদিককে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল এক হলরুমে৷ মাঠকর্মী, টিভি ক্রু, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ও নিরাপত্তাকর্মী মিলিয়ে সেখানে গিজগিজে ভিড়৷ সেখানেই বন্দী সারা দিন৷ দোতলার সেই রুম থেকে নিচে নামার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিরাপত্তাকর্মী সিঁড়িতে পা রাখতে গেলেই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন৷ নিরাপত্তা সংস্থার এক কর্মকর্তা কিছুক্ষণ পরপর শহরের পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছেন আর ঘরবন্দী থাকার সময়টা বাড়িয়ে নিচ্ছেন৷ লকডাউন৷ পুরো ক্রাইস্টচার্চই তখন এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লকড্ ডাউনের সমষ্টি৷
বাংলাদেশ দল কিছুক্ষণ পরই হোটেলে ফিরে গেছে৷ আমরা সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ওই ঘরেই বন্দী৷ বাংলাদেশের সাত সাংবাদিক ছাড়া সবাই নিউজিল্যান্ডার৷ সবার চোখেমুখে অবিশ্বাস—নিউজিল্যান্ডে এমন কিছু কীভাবে হয়! মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়েছে মসজিদের ভেতরে হত্যাযজ্ঞের ছবি৷ ব্রেনটন টারান্টের ফেসবুক লাইভ করা ভিডিওটাও৷ লকড্ ডাউন থেকে মুক্তি পেতে পেতে মানসিকভাবে একেবারেই বিধ্বস্ত৷ তারপরও টিম হোটেলে না গিয়ে উপায় নেই৷ পেশাগত দায় তো আছেই, মোটেলে ফিরতে ভয়ও করছে৷ রাস্তাঘাটও বেশির ভাগই বন্ধ৷ গাড়িতে টিম হোটেলে পৌঁছে দিলেন কেটলিন গডফ্রে নামের এক তরুণী৷ একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করেন৷ যে কোম্পানির দায়িত্ব ছিল টেস্ট ম্যাচের জন্য হ্যাগলি ওভালকে সাজিয়ে তোলার৷ গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘‘এই শহরেই আমার জন্ম, এখানেই বড় হয়েছি৷ এক মুহূর্তের জন্যও কখনো অনিরাপদ বোধ করিনি৷ আর এখানেই কিনা…৷’’ বলতে বলতে তাঁর দুচোখে জলের ধারা৷
এমনিতে নিউজিল্যান্ডে টিম হোটেলে বাড়তি নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না৷ আজ সেখানে পুলিশের গাড়ি৷ কালো পোশাক পরা নিরাপত্তাকর্মীদের ভিড়৷ বোর্ডার ছাড়া কারও হোটেলে ঢোকা নিষেধ৷ আমরা ঢুকতে পারলাম বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদের সৌজন্যে৷ সবাইকে টিম রুমে নিয়ে গিয়ে পুরো ঘটনার আনুষ্ঠানিক একটা বর্ণনাও দিলেন তিনি৷ পাইলটের রুমে গিয়ে দেখি, টেবিলে এক তাড়া টিকেট। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের টিকেট। যে টেস্ট কখনো শুরুই হবে না।
ক্রিকেটারদের সঙ্গেও দেখা হলো৷ ততক্ষণে একটু স্বাভাবিক সবাই৷ কিন্তু আমার রীতিমতো অস্থির লাগছে৷ অন্যের ল্যাপটপ ধার করে অনলাইনে কোনোমতে দুটি লেখা পাঠিয়েছি৷ এবার পত্রিকার জন্য লিখতে হবে৷ মোটেলে ফেরা দরকার৷ কিন্তু ফিরব কীভাবে? রাস্তা যে এখনো বন্ধ৷ অগত্যা সেবারই নিউজিল্যান্ডে গিয়ে পরিচয় হওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ মাহফুজুর রহমান তন্ময়ের পাঠানো ট্যাক্সিতে তাঁর বাড়িতে৷ সেখানে ঘণ্টা দুয়েক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা৷ তন্ময় একের পর একজনকে ফোন করছেন আর একটার পর একটা দুঃসংবাদ পাচ্ছেন৷ ৩৫টির মতো পরিবার, সব মিলিয়ে শ দেড়েক বাঙালির বাস ক্রাইস্টচার্চে৷ সবাই সবাইকে চেনেন৷ তন্ময়ের পরিচিত দুজন মারা গেছেন৷ মাথায়–পিঠে গুলি খেয়ে একজন আছেন আইসিইউতে৷ তন্ময় কথা বলছেন আর হাউমাউ করে কাঁদছেন৷ বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর সেই কান্না মিলিয়ে দুঃস্বপ্নের এক দিন যেন আরও বেশি ভয়াল হয়ে উঠছে৷
রাত সাড়ে নয়টার দিকে তন্ময়ের গাড়িতেই আমি আর ইসাম মোটেলে ফিরলাম৷ শূন্য রুমে পা রাখতেই সারা দিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয় বেরিয়ে এলো অঝোর কান্না হয়ে৷ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে লিখতে বসলাম৷ শরীর ভেঙে আসছে, মন অবসন্ন৷ কী যে কষ্ট হয়েছিল লিখতে! এই লেখাটা লিখতেও তো একই রকম অভিজ্ঞতাই হলো৷
* লেখাটা সামান্য পরিবর্তিতভাবে ডয়চে বাংলার ওয়েবসাইটে ছাপা হয়েছিল।