স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৫০
অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখান আর্চার রোমান সানা
দুলাল মাহমুদ
১৫ ডিসেম্বর ২০২১
অলিম্পিকে পদক জয় বাংলাদেশের জন্য এখনো স্বপ্নই। তবে স্বপ্নটা বাস্তব হয়ে যেতে পারে অচিরেই, তিরন্দাজ রোমান সানার পারফরম্যান্স সেই ভরসাই যোগাচ্ছে। ’স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০’ ধারাবাহিকের শেষ পর্বে আজ রোমান সানার গল্প।
স্বপ্নটা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের স্বপ্নের নাগাল পাওয়া কি এত সহজ? এভারেস্টে পা রাখার চেয়েও তা যেন কঠিন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য, ধরাছোঁয়ার একদম বাইরে।
কবে পূরণ হবে সেই স্বপ্ন? সেটা বলতে পারে কেবল ভবিতব্য। তবে এতটা উচ্চতায় পৌঁছানোর স্বপ্নই যেন কারও নেই। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বান্দরবানের তাজিংডং কিংবা সাকা হাফং জয় করাই সবার স্বপ্ন। যে কারণে অলিম্পিক গেমস নামক উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
তবে অদূর ভবিষ্যতে এই স্বপ্ন যে পূরণ করা যাবে না, এখন আর তা বলার উপায় নেই। সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন আর্চার রোমান সানা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে তাঁকে নিয়েই প্রথম এমন স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এর আগে আর কাউকে নিয়ে এমনভাবে প্রত্যাশা করা হয়নি। আর কিছু না হোক, অলিম্পিক গেমসে পদক জয় করা সম্ভব, এই বিশ্বাসটুকু তিনি স্থাপন করতে পেরেছেন। অলিম্পিকে বাংলাদেশের পদক জয়ের অধরা স্বপ্ন জয়ের জন্য তাঁকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ তাঁর পারফরম্যান্স। আশা জাগিয়ে টোকিও অলিম্পিক গেমসে পদক জিততে না পারলেও বিশ্বাসটুকু তো ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।
খুলনার সন্তান রোমান সানা কৈশোরে ক্রিকেট, ফুটবল দুটোই ভালো খেলতেন। লেখাপড়ার পরিবর্তে তাঁর সময় কাটত খেলার মাঠে। খেলাধুলায় পারদর্শিতার কারণে স্কুল থেকে আর্চারির জন্য বাছাই করে ২০০৮ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় তাঁকে ট্যালেন্ট হান্ট ক্যাম্পে পাঠানো হয়। অথচ অপ্রচলিত এই খেলায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাঁকে টেনে নিয়ে যায় নিয়তি। ছোটবেলা থেকে গুলতি খেলার অভ্যাস থাকায় টার্গেটটা ভালোই চিনতেন। কত যে পাখি মেরেছেন, তার কোনো হিসেব নেই। বাঁশের তৈরি তির-ধনুক দিয়েও হাত পাকিয়েছেন। নিশানা নিখুঁত হওয়ার কারণে আর্চারি ক্যাম্পে তিনি সহজেই নজর কাড়তে সক্ষম হন।
খুলনা থেকে বিকেএসপিতে দেড় মাসের ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর প্রতিভার সন্ধান পেতে বিলম্ব হয়নি। শুরুতে অর্থনৈতিক কারণে খেলাটা চালিয়ে যেতে সমস্যা হতো। নিজের ওপর আস্থা থাকার কারণে কখনো হতোদ্যম হননি। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় খুলনায় ফিরে যেতে হয়। বছর দুয়েক আর্চারি থেকে দূরে সরে থাকেন। আর কখনো আর্চারিতে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয়নি। কিন্তু তাহলে বাংলাদেশের মুখ গৌরবোজ্জ্বল করবে কে? অদৃষ্ট আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনে।
২০১১ সালে ঢাকায় প্রথম এশিয়ান ইয়ুথ আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে দলগত ইভেন্টে রৌপ্যপদক লাভ করেন রোমান সানা। সেটাই ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর প্রথম পদক। ২০১২ সালে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার কারণে তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তখন। আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। দীর্ঘ দিন ঘরের বাইরে যেতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে নিজের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। ততদিনে লক্ষ্যভেদ করাটা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে নেশার মতো। স্রেফ মনের জোরে ফের উঠে দাঁড়ান।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে একক ও দলগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করার মাধ্যমে ফর্মে ফিরে আসেন। ফিরে পান হারানো আত্মবিশ্বাস। তারপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রিতে স্বর্ণপদক জয় করেন। অলিম্পিক গেমসে রূপা জয়ী জাপানি আর্চার তাকাহারু ফুরুখাওয়াকে হারানো মোটেও সহজ ছিল না। এরপর থেকে এগিয়ে যান সাফল্যের ধারায়।
২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ-২ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং টুর্নামেন্টে রিকার্ভ এককে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন। কাঁধের ইনজুরির কারণে ২০১৬ সালের এসএ গেমসে অংশ নিতে পারেননি। ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রথম আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ইলিমিনেশন রাউন্ডের রিকার্ভ ডিভিশনের পুরুষ দলগত ইভেন্টে সানোয়ার হোসেন ও তামিমুল ইসলামকে নিয়ে এবং মিশ্র দলগত ইভেন্টে বিউটি রায়কে নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। আগস্টে কিরগিজস্তানের বিশকেকে রিকার্ভ ইন্টারন্যাশনাল আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষ এককে স্বর্ণপদক জয় করেন।
আন্তর্জাতিক আর্চারি মানেই রোমান সানার জয়জয়কার। বাংলাদেশের সম্মান রক্ষার দায়িত্বটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন। কখনো এককভভাবে, কখনো দলীয়ভাবে। কোনো পদক জিততে না পারলে তিনি যেন স্বস্তি পান না। ২০১৮ সালের মার্চে ঢাকায় তৃতীয় দক্ষিণ এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে নাসরিন আক্তারকে নিয়ে, রিকার্ভ পুরুষ দলগত ইভেন্টে ইব্রাহিম শেখ রেজোয়ান ও তামিমুল ইসলামকে নিয়ে স্বর্ণপদক এবং রিকার্ভ পুরুষ এককে রৌপ্যপদক জয় করেন। মে মাসে ঢাকায় দ্বিতীয় ইসলামিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ পুরুষ একক, রিকার্ভ পুরুষ দলগত ইভেন্টে মোহাম্মদ তামিমুল ইসলাম ও ইব্রাহিম শেখ রেজোয়ানকে নিয়ে এবং রিকার্ভ মিক্সড ইভেন্টে নাসরীন আক্তারকে নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। জার্মানিতে আর্চারি ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেজ-৪এ এককে ১৭তম হন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় তৃতীয় আইএসএসএফ ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রোমান সানা রিকার্ভ একক, তামিমুল ইসলাম ও হাকিম আহমেদ রুবেলকে নিয়ে রিকার্ভ দলগত ইভেন্টে রৌপ্যপদক এবং দিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। এপ্রিলে ব্যাংককে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ পুরুষ এককে রৌপ্যপদক এবং রিকার্ভ দলগত ইভেন্টে ইমদাদুল হক মিলন ও হাকিম আহমেদ রুবেলকে নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন।
শুধু পদক জয় নয়, একটির পর একটি মাইলফলক গড়েন তিনি। জুনে নেদারল্যান্ডসে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জয়ের গৌরব অর্জন করেন। এরফলে টোকিও অলিম্পিক গেমসে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় এশিয়া কাপ স্টেজ থ্রি ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং আর্চারি টুর্নামেন্ট স্টেজ-৩ পুরুষদের রিকার্ভ ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন। এশিয়ান পর্যায়ে বাংলাদেশের কোনও ক্রীড়াবিদের এটি ব্যক্তিগত প্রথম স্বর্ণপদক। রিকার্ভ দলগত ইভেন্টে তামিমুল ইসলাম ও হাকিম আহমেদ রুবেলকে নিয়ে রৌপ্যপদক এবং মিক্সড ডাবলসে বিউটি রায়কে নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। বিশ্বের সেরা পাঁচে উঠে আসেন তিনি।
নেপালে ১৩তম এসএ গেমসে রিকার্ভ একক, রিকার্ভ দলগত ইভেন্টে তামিমুল ইসলাম ও হাকিম আহমেদ রুবেলকে নিয়ে এবং রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে ইতি খাতুনকে নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। ২০১৯ সালের বর্ষসেরা বিশ্বের উদীয়মান তিরন্দাজের পুরষ্কার পেয়েছেন রোমান সানা। ২০২০ সালে ঘোষিত বিশ্ব আর্চারির বিশ্বসেরা ব্রেক থ্রু অ্যাথলেট নির্বাচিত হন। ৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে বিশ্ব ইনডোর আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল শেষে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ২৩ মে সুইজারল্যান্ডের লুজানে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের স্টেজ-২ এর রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে রৌপ্যপদক জয় করেন দিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে। এর আগে আর কোনো ক্রীড়াবিদ বিশ্ব পর্যায়ে পদক জয় করতে পারেননি। এটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক বড় ঘটনা। এই সাফল্যের কারণে টোকিও অলিম্পিক গেমসে তাঁকে ঘিরে পদক জয়ের আশা করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাঁকে নিয়ে অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখা হয়। সব মিলিয়ে এমনটা আশা করা অতিরঞ্জিত ছিল না। যদিও সেই আশা পূরণ হয়নি। প্রথম রাউন্ডে গ্রেট ব্রিটেনের টম হলের বিপক্ষে রোমান সানা জয়ী হলে জ্বলে উঠেছিল আশার আলো। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে কানাডার ক্রিস্পিন দুয়েনাসের বিপক্ষে পেরে ওঠেননি তিনি। না পারলেও স্বপ্নটা চারিয়ে দিতে পেরেছেন। একই বছর ঢাকায় ২২তম এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ পুরুষ দলগত ইভেন্টে হাকিম আহমেদ রুবেল ও রামকৃষ্ণ সাহাকে নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে যত পদক জিতেছেন রোমান সানা, এমন কৃতিত্ব দেখানো সহজ নয়। তাছাড়া তিনি যে মানের ও যে মাপের প্রতিযোগিতায় পদক জয় করেন, তার কাছাকাছি আর কেউ নেই। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যে মাইলফলক স্থাপন করেন, তা বুনে দিয়েছে নতুন এক স্বপ্ন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অলিম্পিক গেমসে পদক জয় করা ছাড়াই বাংলাদেশকে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটা অপূর্ণতা তো রয়েই গেছে। তবে পদক জয় করতে না পারলেও অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন রোমান সানা, সেই স্বপ্ন নিশ্চয়ই একদিন সত্য হবে। সেই দিন বো ধকরি খুব বেশি দূরে নয়।