স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৪৪

গলফার সিদ্দিকুর যেন রূপকথার এক গল্প

দুলাল মাহমুদ

১৭ নভেম্বর ২০২১

গলফার সিদ্দিকুর যেন রূপকথার এক গল্প

অভিজাতদের খেলা হিসেবে পরিচিত গলফের সঙ্গে বাংলাদেশের আমজনতাকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব সিদ্দিকুর রহমানের। যাঁর উত্থানের গল্প রূপকথাকেও যেন হার মানায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ এই গলফারের কথা।

সিদ্দিকুর রহমানগলফ খেলাটাকে আমাদের চিনতে বাধ্য করেন দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি খেলতেন বলেই টেলিভিশনে তা দেখানো ছিল বাধ্যতামূলক। এ কারণে কখনও কখনও নিরুপায় হয়ে দেখতে হয়েছে৷ তখন তো বিটিভি ছাড়া আর কোনো চ্যানেল ছিল না। এমনিতে অভিজাত ঘরানার এই খেলাটাকে নিয়ে আমজনতার কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। ছিলও না। যে কারণেই হোক, বরং এক ধরনের বিবমিষাই ছিল। গলফ কোর্সে তো সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। যা সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তা নিয়ে ভাবতে কার কী দায় পড়েছে? 

নিয়তির কি পরিহাস, একটা সময় সেই গলফের প্রতি আগ্রহ দেখা দেয়। একজন ক্যাডিবয় মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান যখন গলফের মাধ্যমে উজ্জ্বল করেন দেশের মুখ, তখন কি আর মুখ ফিরিয়ে রাখা যায়? সেই সময় থেকে খেলাটিকে খুব কাছের মনে হতে থাকে। তিনি তো আর অন্য গলফারদের মতো নিজের ক্যারিশমা দেখানোর জন্য খেলতেন না। সে সুযোগ তাঁর ছিল না। পেটের দায়ে খেলাটার সঙ্গে তাঁর সংযোগ গড়ে ওঠে। তারপর তা হয়ে যায় তাঁর নেশা ও পেশা। তিনি তাঁর মধ্যে সুপ্ত থাকা প্রতিভা ও মেধা দিয়ে একজন গলফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যে সামাজিক অবস্থান থেকে গলফের অভিজাত ঘরানায় স্থান করে নিয়েছেন, তা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। হাল আমলে গলফ দুনিয়ায় তিনি অপরিচিত কেউ নন।

দরিদ্র বেবি ট্যাক্সি চালক পিতার সন্তান হয়েও তিনি এমন একটা খেলাকে বেছে নেন, যা ছিল তাঁর সামাজিক অবস্থান ও সামর্থ্যের বাইরে। বস্তিতে বসবাস করে ব্যয়বহুল এই খেলায় স্বপ্ন দেখা অনেকটা বামন হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়ানোর মতো। কিন্তু নিয়তির খেলা বোঝা বড় দায়। কাকে যে কোথায় নিয়ে যায়, বোঝা মুশকিল। যদি তাই না হবে, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্দিকুর গলফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন কী করে? 

সেটা ছিল রীতিমতো কল্পনাকে হার মানানোর মতো। তাঁর তো ক্লাব কেনার সক্ষমতাও ছিল না। তবে গলফের সংস্পর্শে আসায় খেলাটি তাঁকে দারুণভাবে আগ্রহী করে তোলে। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে যাতায়াতের সুবাদে খেলাটা তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এতটাই যে, প্রথম জীবনে লোহার রড বাঁকিয়ে ক্লাবের মতো বানিয়ে গলফ খেলতেন। এরপর তাঁকে আর দমিয়ে রাখা যায়নি। সিদ্দিকুর এতদূর আসবেন ছোটবেলায় স্বপ্নেও ভাবেননি। ভাবার কথাও নয়। যথার্থ কারণেই অভাব-অনটনের সংসারে তাঁর শুরুটা ছিল খুবই কঠিন। 

সিদ্দিকুরের গলফ অভিযাত্রা যেন রূপকথার এক গল্প। ছবি: মো. মানিক

১৯৯৪ সালে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে বলবয় হিসেবে যখন কাজের সংস্থান হয়, তখন সিদ্দিকুরের বয়স ১০ বছর। অর্থনৈতিক দৈন্য ঘুচাতে এত অল্প বয়সে কাজে ঢুকতে বাধ্য হন। মূলত স্কুলের ফি সংগ্রহ করার জন্য গলফ কোর্টের বলবয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাজ ছিল ক্লাবের সদস্যদের ব্যাগ বহন করা। তারপর হয়েছেন ক্যাডিবয়। এরচেয়ে বেশি দূর যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে খেলায় হাতেখড়ি হয়। খেলাটা ভালোই রপ্ত করেন৷ শুরুর দিকে খেলার মাধ্যমে আয় করে অর্থনৈতিক সংকট দূর করাটাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। 

১৯৯৯ সাল থেকে জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচনের জন্য জুনিয়রদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলে তিনি তাতে কোয়ালিফাই করেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাইমলাইটে আসেন। অ্যামেচার গলফ খেলোয়াড় হিসেবে শুরু হয় তাঁর ক্যারিয়ার। ধীরে ধীরে আয়-রোজগার হতে থাকে। তারপর দেশসেরা গলফার হওয়ার দিকে মনোযোগ দেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। পর্যায়ক্রমে জাতীয় দলে। এক সময় দেখা গেল, নিজে ক্যাডিবয় হয়েও বিদেশে খেলছেন ভিনদেশি ক্যাডি নিয়ে।

মূলত ২০০৩ সাল থেকে সিদ্দিকুর নিয়মিত আন্তর্জাতিক গলফ টুর্নামেন্টে অংশ নেন। ২০০৪ সালে ভারতের দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া অ্যামেচার চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করাটা ছিল তাঁর জন্য বেশ বড় সাফল্য। আট রাউন্ডের সবগুলোতে তিনি জয়ী হন। অ্যামেচার হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশে ১২টি শিরোপা জয় করেন। জাতীয় দলের হয়ে চমৎকার পারফরম্যান্সের পর ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম গলফার হিসেবে পেশাদার জগতে পা রাখেন। 

২০০৬ সাল থেকে ভারতীয় পেশাদার গলফে অংশ নেন। এরপর আর পেছনে তাকাননি। সাফল্যের পাশাপাশি আসতে থাকে বিপুল অর্থ। ভারতীয় সার্কিটে সে সময় চারটি ট্রফি জেতা ছাড়াও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে খেলেন এশিয়ান ট্যুরে। ২০০৭ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অ্যামেচার গলফে তিনি ধাপে ধাপে এগিয়ে যান। তিনিই একমাত্র গলফার হিসেবে অ্যামেচার গলফে শিরোপা জিতেছেন সার্কের সাত দেশেই। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের পুনেতে প্রফেশনাল প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপে ট্রফি জিতেছেন। একই সঙ্গে পিজিটিআইয়ের ২৬তম স্থান থেকে উঠে আসেন ১২তম স্থানে। মাস দুয়েক পর হুদা-জিটিপিএল ইউনিটেক হরিয়ানা ওপেনে জয়ী হন। তখন থেকে একটার পর একটা টুর্নামেন্টে খেলেন।

পুনেতে ট্রফি জয়ের দু মাস পর ভারতেই আরেকটি ট্রফি জয় করেন। ২০০৯ সালে তৃতীয় ট্রফি জয় করেন গ্লোবাল গ্রিন ব্যাঙ্গালুরু ওপেনে। একই বছর ট্যুর কার্ড নিয়ে কোয়ালিফাইং স্কুল পেরিয়ে তিনি পা রাখেন এশিয়ান ট্যুরে। ২০১০ সালে ঢাকায় জেতেন আমেরিকান এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ওপেন৷ কোয়ালিফাইং স্কুলে সেরা ৪০-এর মধ্যে থাকায় এশিয়ান ট্যুরে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। তাঁর অগ্রযাত্রার পথ ঊর্ধ্বগামী হয় থাইল্যান্ডের কুইন্স কাপ গলফ টুর্নামেন্ট থেকে। ওই টুর্নামেন্টে তিনি প্রথমবার এশিয়ান ট্যুরে সেরা দশে জায়গা করে নেন। যা এই অঞ্চলের পেশাদার গলফের অন্যতম সেরা টুর্নামেন্ট। 

২০১০ সালে এশিয়ান ট্যুর জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন মাদারীপুরের সন্তান সিদ্দিকুর। এই সাফল্য দিয়ে গলফ দুনিয়ায় বাংলাদেশকে পরিচিত করে তোলেন তিনি। মূলত তখন থেকেই এ দেশের ক্রীড়ানুরাগী সর্বসাধারণ এই খেলার প্রতি আগ্রহী হন। ব্রুনাই ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে জয় করেন এশিয়ান ট্যুর প্রফেশনাল গলফ টুর্নামেন্ট। গড়েন নতুন এক ইতিহাস। খেলা শুরুর আগে তিনি ভাবতেই পারেন নি এই শিরোপা জিতবেন। এশিয়ান ট্যুরে তাঁর এমন সাফল্যে ব্রুনেই ওপেন আয়োজকরাও অবাক হয়ে যান। এই টুর্নামেন্টে ২৫টি দেশের শতাধিক গলফার অংশ নিয়েছিলেন। খ্যাতিমান সব খেলোয়াড়দের হারিয়ে তিনি চমকে দেন। পুরস্কার হিসেবে পান ৫৪ হাজার ডলার।

এশিয়া পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় যে কোনও খেলায় এটি ছিল কোনো বাংলাদেশির প্রথম শিরোপা। এক কথায়, এই সাফল্য অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি এশিয়ান ট্যুর খেলেন। দুই বছরের চেষ্টার সাফল্য পেয়েছেন। ব্রুনেই ওপেনে সাফল্য আসায় সম্ভাবনার দ্বারও খুলে যায়। পরবর্তী দুই বছরের জন্য সরাসরি ইউরোপ ট্যুরে খেলার সুযোগ পান। 

গলফ কোর্সে স্ত্রীর সঙ্গে। ছবি: শা. হ. টেংকু

২০১০ ও ২০১১ সালে তিনি এশিয়ার শীর্ষ ১০-এ ছিলেন। ২০১৩ সালে ভারতের দিল্লিতে হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন জেতেন। পুরস্কার পেয়েছেন দুই লাখ ২৫ হাজার ডলার। এটাও কম গৌরবের ছিল না। ব্রুনাইয়ের পর এটি ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য। এশিয়ান অর্ডারস অব মেরিটে তিন-এ উঠে আসেন। ২০১৩ সালে গলফ বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। এশিয়া প্যাসিফিক প্যানাসনিক ওপেনে ভালো করায় এই সুযোগ হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সুবিধা করতে পারেন নি। 

২০১৪ সালে ইউরেশিয়া কাপে অংশ নেওয়ার জন্য সিদ্দিকুরের এশিয়া দলে স্থান করে নেওয়াটা অসম্ভব কৃতিত্বপূর্ণ। এটাও ছিল তাঁর কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। এই দলে স্থান করে নেন এশিয়ার সেরা ১০ জন। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইউরেশিয়া টুর্নামেন্টে এশিয়া দলের হয়ে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চমৎকার খেলেন। লড়াইয়ে সমতা হওয়ায় দুই দলই শিরোপা ভাগাভাগি করে নেয়। এশিয়ার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের কুইন্স কাপে যুগ্মভাবে তৃতীয় হন। বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ২০১৬ সালে ব্রাজিল অলিম্পিক গেমসে সরাসরি অংশ নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। বিশ্ব গলফ র‍্যাংকিংয়ে ৫৬তম স্থানে থাকায় তিনি এমন সুযোগ লাভ করেন। অলিম্পিকে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বহন করেন। একই বছর আফ্রো-এশিয়া ব্যাংক মরিশাস ওপেনে রানারআপ হন। ২০১৭ সালে রানারআপ হন বাংলাদেশ ওপেন-এ।

অনেক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। স্বপ্নের নায়ক টাইগার উডসসহ বিশ্বসেরা গলফারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, এদেশের গলফে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন তিনি। বিশ্ব পরিসরের অভিজাত একটা খেলায় বাংলাদেশের নাম তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা যেন অনেকটা রূপকথার মতো।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×