টেন্ডুলকার-ওয়াকারের অভিষেক: উদযাপনের উপলক্ষ, আফসোসেরও!
উৎপল শুভ্র
১৫ নভেম্বর ২০২১
১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর ভারত-পাকিস্তান করাচি টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় আছে একটা কারণেই। আধুনিক ক্রিকেটের দুই গ্রেটের একই সঙ্গে অভিষেক হয়েছিল এই টেস্টে। শচীন টেন্ডুলকার ও ওয়াকার ইউনিসের দ্বৈরথ যে টেস্ট ক্রিকেট সেভাবে দেখতেই পায়নি, এই আফসোসও তাই জেগে ওঠে এ দিনটাতে।
বিশেষ কোনো উপলক্ষের দশক পূর্তির উদযাপন করাই যায় বা বিভিন্ন জয়ন্তীর-রজত, সুবর্ণ...। কিন্তু ৩২ বছর পূর্তি মোটেই স্মৃতিচারণা করার মতো উপলক্ষ নয়। তবে সেই বিশেষ উপলক্ষটা বিশেষ কারও হলে এই নিয়ম আর খাটে না। এই যেমন শচীন টেন্ডুলকার।
প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর দিনটি এলেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম অবধারিতভাবে মনে করিয়ে দেবে, এত বছর আগে এই দিনে শচীন টেন্ডুকারের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। ‘এত’ শব্দটার জায়গায় যে শুধু সংখ্যাটা বদল হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন। শুধু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমই বা বলছি কেন, আজ বিশ্বের যেকোনো ক্রিকেট পোর্টালে গেলেই দেখবেন, নিয়মকে প্রমাণ করা দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে ১৫ নভেম্বর দিনটির এই আলাদা মহিমার কথা বলা আছে। সঙ্গে পাদটীকার মতো করে আরেকটা তথ্যও, একই দিনে টেস্ট অভিষেক আধুনিক ক্রিকেটের আরেক ‘গ্রেট’ ওয়াকার ইউনিসের।
শুধুই দিনটিকে হিসাবে নিলে অনেক গ্রেটের টেস্ট অভিষেকই মিলে যাবে। শচীন টেন্ডুলকার আর ওয়াকার ইউনিসের ব্যাপারটা সম্ভবত অনন্যতাই দাবি করে। এই দুজনের টেস্ট অভিষেক তো শুধু একই দিনে নয়, একই টেস্টে। আজ থেকে ৩১ বছর আগে করাচিতে একই সঙ্গে অমরত্বের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এক ব্যাটসম্যান আর এক ফাস্ট বোলারের।
দুজনই তখন টিন এজার। করাচি টেস্ট শুরুর দিন টেন্ডুলকারের বয়স ১৬ বছর ২০৫ দিন। ওয়াকারের ১৭ বছর ৩৬৪ দিন। ব্যাটসম্যান-বোলার বলে অভিষেকে দুজন সরাসরি প্রতিপক্ষও। সেই লড়াইয়ে জয়ীর নাম ওয়াকার ইউনিস। টেস্টে প্রথম ব্যাটিং করতে নেমে চোখেমুখে কেমন আঁধার দেখেছিলেন, তা টেন্ডুকার নিজেই অনেকবার বলেছেন। ২৪ বছর পর যাঁর ক্যারিয়ার শেষ হবে টেস্ট খেলার ডাবল সেঞ্চুরি করার অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়ে, তাঁর নাকি মনে হয়েছিল, জীবনের প্রথম টেস্টটাই না শেষ টেস্ট হয়ে যায়! সেই ‘যন্ত্রণা’ থেকে টেন্ডুলকারকে মুক্তি দিয়েছিলেন ওয়াকার। খুব দ্রুতই ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠা ইনসুইঙ্গারে টেন্ডুলকারকে বোল্ড করে। ২৪ বলে ১৫ রানের ইনিংসেও অবশ্য টেন্ডুলকারীয় অন ড্রাইভে দুটি চার ছিল।
টেস্ট অভিষেক একই সঙ্গে, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় ধরলে ওয়াকার মাসখানেকের সিনিয়র। বাবার কর্মসূত্রে যে শারজায় কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে তাঁর, সেখানেই ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে। এমনই গতির ঝড় তুলে যে, আম্পায়ার ডিকি বার্ড তাঁকে দিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের দ্রুততম বোলারের স্বীকৃতি। দাবানলের মতো যা ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। সবচেয়ে বড় কারণ, সেই টুর্নামেন্টেরই এক দল ওয়েস্ট ইন্ডিজে তখন খেলছেন ম্যালকম মার্শাল, ইয়ান বিশপ, কার্টলি অ্যামব্রোস ও কোর্টনি ওয়ালশ।
টেস্ট অভিষেকের আগে ওয়াকারের ৮টি ওয়ানডে খেলা হয়ে গেছে। শারজার ওই টুর্নামেন্টের পর নেহরু কাপ খেলতে ঘুরে এসেছেন ভারতও। এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলারদের ছায়াসঙ্গী ইনজুরিও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। যে কারণে টেস্ট অভিষেকের পর সেই সিরিজের পরের দুই টেস্টে দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছে। টেন্ডুলকার সেই দুটি টেস্টেই খেলেছেন এবং দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম হাফ সেঞ্চুরিও করে ফেলেছেন। টেন্ডুলকারের সঙ্গে ওয়াকারের আবার দেখা শিয়ালকোটে সিরিজের শেষ টেস্টে। প্রথম তিন টেস্ট ড্র হয়েছে বলে নিজেদের পেস আক্রমণকে লেলিয়ে দিতে পাকিস্তান যেখানে তৈরি করেছে ঘাসে ঢাকা সবুজ উইকেট। শচীন টেন্ডুলকার নামের অত্যাশ্চর্য গল্পের প্রথম অধ্যায়টাও সেখানেই লেখা। যাতে আছেন ওয়াকার ইউনিসও। যাঁর বাউন্সার টেন্ডুলকারের নাকে ছোবল দিয়ে রীতিমতো রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। সেই রক্ত মুছে ব্যাটিং চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন টেন্ডুলকার এবং পরের বলটিতেই মেরেছেন বাউন্ডারি!
ওয়াকারও বুঝে গেছেন, প্রথম দর্শনে যাঁকে মোটেই 'বিশেষ কিছু' মনে হয়নি, মুখে বেবি ফ্যাটের চিহ্ন বয়ে বেড়ানো সেই ব্যাটসম্যান অন্য ধাতুতে গড়া। ভবিষ্যতে আরও অনেকবারই এর সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হবে। কেই-বা তখন ভেবেছিল, টেস্ট ম্যাচে দুজনের আবার দেখা হবে দশ বছর পর!
আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে আফসোসটার কথা বলার সময় হলো এখন। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় শচীন টেন্ডুলকার বনাম দুই ডব্লিউ, ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনিস। যে লড়াইয়ের কথা ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। ওই সিরিজের পরই আরও অনেকবারের মতো দুই দেশের সম্পর্ক ভেঙে পড়ায় যা আসলে কখনো আমাদের দেখাই হয়নি। শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটে যখন রানের ফল্গুধারা বইছে, একই সময়ে রিভার্স সুইংয়ে ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন তুলছেন দুই ডব্লিউ; কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে তাঁদের দেখাই হচ্ছে না। আবার যখন তা হলো, টেন্ডুলকার তখনো দেদীপ্যমান, কিন্তু ওয়াকারের ক্যারিয়ার-সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে দিনের পর দিন গতির ঝড় তোলার ধকল নিতে নিতে ক্লান্ত শরীর, যেটির ছাপ পড়ছে বোলিংয়েও। এমনই যে, ১৯৯৯ সালের সেই ভারত সফরে প্রথম দুই টেস্টে মাত্র ২ উইকেট নেওয়ার পর তৃতীয় টেস্টে (এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ) দল থেকেই বাদ পড়ে গেছেন ওয়াকার।
ওয়াকারের বাউন্সারে টেন্ডুলকারের রক্তাপ্লুত নাকের সেই শিয়ালকোটের পর চেন্নাইয়ে আবার যখন দুজনের দেখা হয়েছে টেস্টে, আরও ৫৩টি টেস্ট খেলে ফেলেছেন ওয়াকার, টেন্ডুলকার খেলেছেন ৬৪টি। ৫৫ টেস্টে ২১.৫৭ গড়ে ২৭৫ উইকেট ওয়াকারকে সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের দলে ঢোকার ছাড়পত্র একরকম দিয়েই দিয়েছে। ৬৪ টেস্টে ৫৪.৭৭ গড়ে ৪৮২০ রান শচীন টেন্ডুলকারকেও তুলে দিয়েছে অমরত্বের হাইওয়েতে।
কিন্তু ওই যে আফসোসটা, একই সঙ্গে শুরুর পর সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলা দুই গ্রেটের টেস্ট ক্যারিয়ার পরস্পরকে ছেদ করেছে কিনা আর মাত্রই একবার! ১৯৮৯ সালে দুই টেস্টের পর ১৯৯৯ সালেও দুই টেস্ট, মাত্র এই চার টেস্টেই শেষ টেন্ডুলকার-ওয়াকারের টেস্ট লড়াইয়ের গল্প। এত সব অর্জনের পরও টেন্ডুলকারেরও তাই হয়তো আফসোস হয়, সেরা ফর্মের দুই ডব্লিউকে তাঁর জয় করা হয়নি। গত শতকের নয়ের দশকে টেন্ডুলকার-লারা দ্বৈরথে ক্রিকেট বিশ্ব যখন দ্বিধাবিভক্ত, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের যে তখন ব্রায়ান লারাকেই এগিয়ে রাখতে দেখেছি, এর কারণও হয়তো এটাই। সঙ্গে আরেকটি নাম এসেছে, সেটিও রিভার্স সুইং সামলানোর দক্ষতাকে মানদণ্ড ধরেই। নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো। যে পরীক্ষা টেন্ডুলকারকে দিতেই হয়নি, সেটিতে তাঁকে 'ফেল' বলে দেওয়াটা অন্যায়, আবার পাসই বা করাবেন কিভাবে!
ওয়ানডেতে অবশ্য সেরা ফর্মের দুই ডব্লুর সঙ্গে টেন্ডুলকারের মাঝে মধ্যেই দেখা হয়েছে। তাতে আফসোসটা বরং আরও বেড়েছে। ওয়ানডে কি আর ব্যাটসম্যান-বোলারের ক্ল্যাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ হতে পারে! টেস্ট ক্রিকেট, একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটই যেটি ধারণ করার মতো কলোসিয়াম। তারপরও নিছক কৌতুহল মেটানোর জন্য হলেও পরিসংখ্যানের আয়নায় ওয়ানডেতে টেন্ডুলকার-ওয়াকার লড়াইটা দেখে নেওয়া যেতেই পারে। টেস্টের মতো ওয়ানডেতেও দুজনের প্রথম লড়াইয়েও জিতেছিলেন ওয়াকার। টেস্ট ক্রিকেটে টেন্ডুলকারকে প্রথম আউট করেছিলেন, ওয়ানডেতেও তা-ই। ১৯৮৯ সালের সেই সিরিজেই ওয়ানডে অভিষেকে শূন্য রানে আউট হওয়ার যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিলেন টেন্ডুলকারকে। প্রায় সাত বছর পর ওয়াকারকে দ্বিতীয়বারের মতো উইকেট দেওয়ার পর অবশ্য টেন্ডুলকার খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ ১৯৯৬ সালে শারজায় পেপসি কাপের ওই ম্যাচে এর আগেই ১১৪ রান করা হয়ে গেছে তাঁর।
২৩টি ওয়ানডে ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলে টেন্ডুলকারকে পেয়েছেন ওয়াকার। আউট করেছেন চারবার। এই হিসাবটা সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু ওয়াকারের বলে টেন্ডুলকার কত রান নিয়েছেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে ওই ২৩ ম্যাচে দুজনের পারফরম্যান্স তো জানাই যায়। ২টি সেঞ্চুরি ও ৪টি হাফ সেঞ্চুরিসহ টেন্ডুলকারের রান ৭৮০। ওই ২৩ ম্যাচের স্ট্রাইক রেট আর ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট প্রায় সমান (৮৬.৩৭/৮৬.২৩), তবে অ্যাভারেজ প্রায় সাড়ে সাত কম (৩৭.১৪/৪৪.৮৩)।
প্রতিপক্ষ দলে টেন্ডুলকার, এমন ম্যাচের একটিতে ৫ উইকেট নিয়েছেন ওয়াকার, একটিতে ৪ উইকেট, মোট উইকেট ৩৬। ওই ২৩ ম্যাচের অ্যাভারেজ-স্ট্রাইক রেট-ইকোনমি রেটের সঙ্গে ক্যারিয়ার রেকর্ডের আশ্চর্য সমতা (২৩.৯১/২৩.৮৪, ৩০.৫/৩০.৫ ও ৪.৭০/৪.৬৮)। নিছক তথ্য হিসাবেই সংখ্যার এই কচকচানি। প্রতিপক্ষ দলে ওয়াকার থাকলে টেন্ডুলকারের পারফরম্যান্স একটু খারাপ হয়েছে আর ওয়াকারের একই থেকেছে-এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যতই প্ররোচনা থাকুক এতে, তা হবে অতি সরলীকরণ।
এ সবের দরকারই কি! ৩২ বছর আগে আজকের এই দিনে টেস্ট ক্রিকেটে একই সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন দুই ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার-আমরা বরং সেটিরই উদযাপন করি।
লাইনটা লিখতে লিখতে ওই আফসোসটা আবারও হচ্ছে।
* লেখাটা সামান্য পরিবর্তিত আকারে গত বছর নিউজ বাংলা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল।