স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৪২
হকির রাজকুমার জিমি
দুলাল মাহমুদ
৬ নভেম্বর ২০২১
প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের হকির সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে আছেন রাসেল মাহমুদ জিমি। হকি যাঁর রক্তে। ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০’ ধারাবাহিকে আজ জিমির জীবন ও ক্যারিয়ারের গল্প।
হকি মাঠে প্রায়শই নানান ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসেন রাসেল মাহমুদ জিমি। কখনও খেলার মাঠে মাথা গরম করে। কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। কখনও বেফাঁস মন্তব্য করে। যে কারণে কখনও তাঁকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়। কখনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কখনও খেলার মাঠ থেকে তাঁকে দূরে রাখা হয়। কিন্তু তাঁকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এমনকি তিনি খেলা থেকে অবসর নিতে চাইলেও তাঁকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনা হয়। কারণ তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কথা ভাবাই যায় না।
তাঁর পজিশনে খেলার মতো ওই মানের বিকল্প খেলোয়াড় চাইলেই কি আর পাওয়া যায়? যে কারণে গত দেড় যুগ ধরে তিনি জাতীয় দলে অপরিহার্য হয়ে আছেন। এমনটা কজন পেরেছেন? এমনকি তাঁর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জাতীয় দলের প্রয়োজনে তাঁকে খেলানো হয়েছে৷ তাঁর মেজাজ-মর্জি যেমন খানদানি, তেমনিভাবে খেলোয়াড় হিসেবেও অন্য সবার থেকে তাঁর ঘরানা অনেকটা আলাদা। তিনি দীর্ঘ দিন যেভাবে হকি মাঠে দাপট দেখিয়ে আসছেন, তেমনটা সাধারণত দেখা যায় না।
পুরান ঢাকার যে এলাকা থেকে তিনি উঠে এসেছেন, সেখানকার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হকির ঐতিহ্য। সর্বোপরি তাঁর রক্তেই আছে হকির বীজ। তাঁর পিতা আবদুর রাজ্জাক সোনা মিঞা বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তাঁর সুখ্যাতি ছিল 'টাইগার' নামে। শিশু বয়সে বাবার হাত ধরেই হকি স্টেডিয়ামের সঙ্গে গড়ে উঠে তাঁর যোগাযোগ। দিনে দিনে তা ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। কখনো ছিন্ন হয় নি।
সহজাতভাবেই হকি খেলায় জিমির হাতেখড়ি হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর একটু একটু করে পরিপূর্ণতা পেতে থাকেন। অল্প বয়সেই বিকেএসপির পাশাপাশি ক্লাব পর্যায়ে খেলেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০২ সালে প্রথম বিভাগ হকি লিগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে অভিষেক হয়। পরের বছর ক্লাবটি চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে উন্নীত হয়। তখনই তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে।
সেই সময় ক্লাব কাপ হকির ফাইনালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে খেলার জন্য অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে দলভুক্ত করে আবাহনী লিমিটেড। সেই ম্যাচে ০-১ গোলে আকাশি-নীলরা হারলেও জিমির খেলা সবার নজর কাড়ে। পরের বছর থেকে তাঁর ঠিকানা হয় আবাহনী। সে বছর তিনি ছিলেন আবাহনীর সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত খেলোয়াড়দের একজন। তখনকার প্রেক্ষাপটে তিন লক্ষাধিক টাকা সম্মানী পাওয়া ছিল অনেক বড় ঘটনা। তাঁর বয়সও খুব বেশি ছিল না। সে বছর আবাহনী ক্লাব কাপ হকিতে প্রথম চ্যাম্পিয়ন এবং লিগে রানার্সআপ হয়। ১০ গোল দিয়ে লিগে দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হন তিনি।
২০০৬ সালে তিনি ছিলেন সর্বাধিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত খেলোয়াড়। পেয়েছিলেন সাড়ে চার লাখ টাকা। খেলার মাঠে পাওনা টাকা উসুল করে দিতে বরারবরই তিনি সচেষ্ট থাকেন। ক্লাব কাপে রানার্সআপ এবং লিগে যুগ্মভাবে শিরোপা জয় করে আবাহনী এবং উষা ক্রীড়াচক্র। ২০০৭ সালে ক্লাব কাপে শিরোপা জয় করে আবাহনী। ২০০৮ সালে আবাহনী ক্লাব কাপে চ্যাম্পিয়ন এবং লিগে রানার্সআপ হয়। ১৪ গোল দিয়ে লিগে তৃতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হন তিনি।
২০০৯ সাল পর্যন্ত আবাহনীর হয়ে খেলার পর ২০১০ সাল থেকে তাঁর ঠিকানা মোহামেডান। সে বছর ক্লাব কাপ হকিতে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে ৬ গোল তাঁর। লিগে আবাহনীর সঙ্গে যুগ্ম-চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ২০১২ সালে স্বাধীনতা দিবস হকিতে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে ১৪ গোল করেন এবং লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে ১৯ গোল তাঁর। ২০১৬ সালের তিনি ছিলেন সাদা-কালো দলের অধিনায়ক। লিগে তাঁর দল তৃতীয় হলেও তিনি ৫টি হ্যাটট্রিকসহ ৩৭ গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হন। ২০১৮ সালের লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
বিকেএসপির হয়েও জিমির অনেক অর্জন। ২০০৩ সালে অফিস হকি লিগে ফাইনালে এবং পরের বছর সেমিফাইনালে খেলে বিকেএসপি। প্রথমবার সর্বাধিক সেরা দুই গোলদাতা এবং পরেরবার তিন গোলদাতার একজন ছিলেন তিনি। দুই বছরই গোল করেন ৬টি করে। ২০০৪ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে গোল করেন ৩টি। জাতীয় যুব হকিতে চ্যাম্পিয়ন বিকেএসপির হয়ে খেলেন।
খেলেছেন ঢাকা জেলা দলের হয়েও। ২০০৭ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হয় তাঁর দল। ২০১৫ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ নৌবাহিনীর হয়ে খেলেন।
খুব দ্রুতই আন্তর্জাতিক হকিতে অভিষেক হয় জিমির। প্রথম বিভাগ হকি লিগে খেলার সময় নজর কাড়তে সক্ষম হন। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ষষ্ঠ এশিয়া কাপে জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেন। সেই দলের কোচ ছিলেন তাঁর বাবা। পিতা-পুত্রের এমন সম্মিলন সচরাচর দেখা যায় না। ২০০৪ সালে ঢাকায় অনূর্ধ্ব-২১ এএইচএফ কাপে তৃতীয় হয়ে এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ করে নেয় বাংলাদেশ। তাঁর স্টিক থেকে আসে ৪ গোল। পাকিস্তানের করাচিতে খেলেন জুনিয়র এশিয়া কাপ। তাতে ষষ্ঠ হয় বাংলাদেশ।
ঢাকায় পাঁচ জাতির অনূর্ধ্ব-২১ চ্যালেঞ্জ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক হকিতে এটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা জয়। ফাইনালে ভারতকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারানো ম্যাচে জিমি অসাধারণ খেলেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে হ্যাটট্টিকসহ প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক ১১টি গোল করেন। ২০০৬ সালে ঢাকায় সাত জাতির এশিয়ান কাপ হকির কোয়ালিফাইং রাউন্ডের বাছাই পর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এটি ছিল জাতীয় দলের প্রথম শিরোপা। চমৎকার স্টিক ওয়ার্কের প্রদর্শনী দিয়ে মাঠ মাতিয়ে রাখেন জিমি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনি ছিলেন সেরা খেলোয়াড়।
অংশ নেন কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস এবং শ্রীলঙ্কার দশম এস এ গেমসে। ২০০৭ সালে ভারতের চেন্নাইয়ে সপ্তম এশিয়া কাপে সপ্তম হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে গিয়ে তা পূরণ করে বাংলাদেশ। থাইল্যান্ডকে ১৩-০ গোলে হারিয়ে সবচেয়ে বড় জয় পায়। তারমধ্যে ৪ গোল করেন জিমি। থাইল্যান্ড ছাড়াও শ্রীলঙ্কা এবং হংকংয়ের বিপক্ষে জয়ী হয় বাংলাদেশ। তিনটি ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড় হন তিনি। দেশের পক্ষে সর্বাধিক ৭ গোল তাঁর।
২০০৮ সালে সিঙ্গাপুরে নয় জাতির তৃতীয় এএইচএফ কাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি। গোল করেন ৬টি। একই বছর ভারতের হায়দরাবাদে যুব এশিয়া কাপ এবং ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় এশিয়া কাপে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। অংশ নেন রাশিয়ার চার জাতির আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে। ২০১০ সালে ঢাকায় এস এ গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী বাংলাদেশ দলে খেলেন।
২০১২ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে তাঁর নেতৃত্বে নয় জাতির এএইচএফে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। ফাইনালে ওমানের বিপক্ষে সেরা খেলোয়াড় হন। টুর্নামেন্টে গোল করেন ৬টি। বিশ্ব হকি লিগের প্রথম রাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের দলের হয়ে সর্বাধিক ৫ গোল করেন। ভারতের নয়াদিল্লিতে নেহেরু কাপে অংশ নেন। ২০১৩ সালে ভারতের দিল্লিতে ৬ জাতির ওয়ার্ল্ড হকি লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে চীনের বিপক্ষে সেরা খেলোয়াড় হন। টুর্নামেন্টের সেরা মিডফিল্ডার ছিলেন তিনি।
মালয়েশিয়ার ইপোতে অংশ নেন এশিয়া কাপ হকিতে। এরপর শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সাজা দেওয়া হয়েছিল জিমিসহ চারজন খেলোয়াড়কে। এ কারণে প্রায় বছরখানেক তাঁরা ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেনে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার পর তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরে খেলেন ওয়ার্ল্ড হকির দ্বিতীয় রাউন্ডে। ২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটি ও শিলংয়ে এস এ গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী বাংলাদেশ দলে খেলেন।
হংকংয়ে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। তবে এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ঢাকায় ওয়ার্ল্ড হকি লিগের রাউন্ড টুতে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। দলের পারফরম্যান্স ভালো না হলেও তিনি চমৎকার খেলেন। ঢাকায় দশম এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। পূরণ হয় ষষ্ঠ হওয়ার লক্ষ্য। ২০১৮ সালে ওমানে এশিয়ান গেমস হকির বাছাইপর্বে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা এশিয়ান গেমসে পদক জিততে না পারলেও পরবর্তী এশিয়ান গেমস এবং এশিয়া কাপে সরাসরি খেলা নিশ্চিত করেন জিমিরা। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে ইনডোর হকির এশিয়া কাপে প্রথম অংশ নেয় বাংলাদেশ।
দীর্ঘ দিন জিমির বাংলাদেশ জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় থাকা অনেক বড় ঘটনা। জাতীয় দলের হয়ে ইতোমধ্যে শতাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেন তিনি। তাঁর বুকের মধ্যে থাকে স্বদেশ। বাংলাদেশের হয়ে খেলতে নামলে দেশাত্মবোধের চেতনায় তিনি উজ্জীবিত হয়ে খেলেন। কোনো ম্যাচ বা টুর্নামেন্ট খেলবেন, তাঁর কোনো ভূমিকা থাকবে না, এমনটা সাধারণত দেখা যায় নি। দলের সাফল্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, এমনকি দল ব্যর্থ হলেও তিনি তাঁর কুশলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। স্টিকের ঝলকানি দিয়ে অনায়াসেই দর্শকদের মন জয় করে নিতে পারেন। ২০১২ ও ২০১৩ সালে জার্মানির দ্বিতীয় বিভাগ হকি লিগেও খেলেছেন।
জিমি প্রধানত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে খেলেন। কার্যত তিনি প্লেমেকারের ভূমিকা পালন করেন। নিজের খেলার পাশাপাশি আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর অবদান রাখেন। আবার দলের প্রয়োজনে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলতে দ্বিধা করেন না। যে পজিশনে তিনি খেলেন না কেন গোল করার ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতা অতুলনীয়। পেনাল্টি শুটআউটে তাঁর দক্ষতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, চাপের মধ্যে তাঁর সেরা খেলাটা বের হয়ে আসে। এ কারণে তাঁকে নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলেও হকির অঙ্গনে তিনি হয়ে আছেন দেদীপ্যমান।