স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৪১

কাবাডির বিশ্ব কাঁপানো রেইডার জিয়াউর

দুলাল মাহমুদ

১ নভেম্বর ২০২১

কাবাডির বিশ্ব কাঁপানো রেইডার জিয়াউর

জাতীয় খেলা কাবাডির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি পদক মনে হয় এই খেলাতেই এসেছে। সেই খেলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা জিয়াউর রহমান। একসময় বিশ্বের সেরা রেইডার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই জিয়াউর রহমানকে নিয়েই `স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০` ধারাবাহিকের আজকের পর্ব।

জিয়াউর রহমানবাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডির এখন তেমন গ্ল্যামার নেই বললেই চলে। অথচ একটা সময় লোকায়ত এই খেলাটির তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ জনপদে এই খেলা দেখার জন্য বিপুল দর্শক সমাগম হতো। বিনোদনের অন্যতম খোরাক ছিল কাবাডি বা হাডুডু। বিজয়ী দল ও সেরা খেলোয়াড়কে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করার পাশাপাশি করা হতো আনন্দমিছিল। কাবাডির সেই সুদিন আর নেই। তারপরও গ্রামীণ এই খেলা আন্তর্জাতিক পরিসরে স্থান করে নেওয়ার পর হয়ে উঠে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম মাধ্যম। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক জয়ের অন্যতম ক্ষেত্র এখনও কাবাডি। 

বিশেষ করে এশিয়ান গেমসে সর্বাধিক পদক এসেছে এই খেলাটির মাধ্যমে। এটা নিঃসন্দেহে গৌরবের। আর এই গৌরবের অন্যতম একজন কারিগর জিয়াউর রহমান। কাবাডির দুনিয়ায় নিজস্ব স্বকীয়তা দিয়ে দেশকে সম্মানিত করেছেন তিনি। তিনি দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুখ্যাতি অর্জন করেন।

দিনাজপুরের সন্তান জিয়াউরের রক্তেই রয়েছে কাবাডি। বাবা-চাচা ও ভাইয়েরা ছিলেন খ্যাতিমান কাবাডি খেলোয়াড়। বড় ভাই আবদুল জলিল দেশসেরা খেলোয়াড় এবং জাতীয় দলের প্রশিক্ষক হিসেবে সুখ্যাত। তারই ধারাবাহিকতায় কাবাডির প্রতি জিয়াউর আকৃষ্ট হন। দীক্ষিত হন ভাইয়ের মাধ্যমে। নিজেদের দল মহিষকোটা গ্রামের হয়ে খুব দ্রুতই নজর কাড়তে সক্ষম হন। এই দলের সঙ্গে কেউ কুলিয়ে উঠতে পারত না। ১৯৯২ সালে দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত যুব কাবাডির মাধ্যমে তিনি আলোচনায় উঠে আসেন। সেই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁর দল দিনাজপুর। সেই যে তাঁর সাফল্যের শুরু, এরপর শুধুই এগিয়ে চলার গল্প। 

জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে কোনো প্রতিযোগিতায় জিয়াউর অংশ নিয়েছেন আর তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়নি, এমন খুব কমই ঘটেছে। ১৯৯৬ সালে তিনি বিডিআর অর্থাৎ বিজিবিতে যোগ দেন। এরপর থেকে উন্মোচিত হয় তাঁর দিগন্ত। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, প্রিমিয়ার লিগ, স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাঁর দল বিডিআর বা বিজিবি হয়ে উঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এতে সব সময়ই বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। ২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত কতবার যে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচত হয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। তিনি খেলতে নামলে প্রতিপক্ষের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হতো। তাঁকে সামাল দেওয়া ছিল কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। 

জিয়াউর ১৯৯৫ সাল থেকে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ভারতের মাদ্রাজ সাফ গেমস দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় শুরু হয় তাঁর অভিযাত্রা। সেবার রৌপ্যপদক জয়ের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৯৮ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে এশিয়ান গেমসে আগের দুবারের রৌপ্যপদক ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের বিপক্ষে এক পর্যায়ে ১০-২ পয়েন্টে এগিয়ে থেকেও দুর্ভাগ্যক্রমে ১৬-১৬ পয়েন্টে ড্র করায় শেষ পর্যন্ত ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ১৯৯৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে অনাকাঙ্খিত ঘটনায় কোনো পদক জিততে না পারাটা ছিল সবচেয়ে হতাশাজনক। 

২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে এশিয়ান গেমসে রৌপ্যপদক পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। চমকপ্রদ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন জিয়াউর। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি দুর্দান্ত খেলেন। ২০০৩ সালে ভারতের হরিয়ানায় ফ্রেন্ডশিপ গোল্ডকাপ কাবাডিতে রানার্সআপ বাংলাদেশ দলে খেলেছেন। ২০০৪ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে প্রথম বিশ্বকাপে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী দলের খেলোয়াড় ছিলেন। এই বিশ্বকাপে রেইডার হিসেবে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে নেন জিয়াউর। একই বছর ভারতের ৬টি রাজ্যে বাংলাদেশ দলের হয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলেন। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বো সাফ গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী বাংলাদেশ দলেও ছিলেন জিয়াউর। 

জিয়াউরকে ঠেকানো ছিল প্রতিপক্ষের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ

২০০৭ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে বাংলাদেশ। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের মুখোমুখি হওয়ায় ফাইনালে খেলা হয়নি। তবে বিশ্বকাপের সেরা রেইডারের স্বীকৃতি পান জিয়াউর। তাঁর এই কৃতিত্ব বাংলাদেশের কাবাডির ইতিহাসে অনন্য এক নজির হয়ে আছে। ২০০৮ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণজয়ী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। একই বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে প্রথম এশিয়ান বিচ গেমসের কাবাডিতে ব্রোঞ্জ জয়ী বাংলাদেশ দলে খেলেন। ইনজুরির কারণে ২০১০ সালে ঢাকার সাফ গেমস এবং চীনের গোয়াংজুতে এশিয়ান গেমসে খেলা হয়নি। সর্বশেষ জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেন ২০১৪ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেন এশিয়ান গেমসে। তাতে অবশ্য পদক পায়নি বাংলাদেশ। 

২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। দুই দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এশিয়ান গেমসে একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ, বিশ্বকাপ কাবাডিতে দুটি ব্রোঞ্জ, সাফ গেমসে একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ, এশিয়ান বিচ গেমসে একটি ব্রোঞ্জের অংশীদার হওয়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেহাত মন্দ নয়। অবশ্য আরও বেশি সাফল্য অর্জনের সুযোগ ছিল। কিন্তু দলীয় খেলায় একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব হয় না। তারপরও পদক জয়ের ক্ষেত্রে তাঁর জোরালো ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। এছাড়াও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে আন্তর্জাতিক কাবাডি অঙ্গনে তিনি আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন। 

প্রো কাবাডিতে জিয়াউর রহমান২০১৪ সালে ভারতের প্রথম প্রো কাবাডি লিগে ইউ মুম্বাই টিমের হয়ে খেলার গৌরব অর্জন করেন জিয়াউর। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলীর কারণে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই লিগে রানার্সআপ হয় মুম্বাই। তিনি ছিলেন অলরাউন্ডার। তবে রেইডার হিসেবেই বেশি সুখ্যাতি অর্জন করেন। হ্যান্ড টাচ, কিকিংয়ে ছিলেন অসাধারণ। বিশেষ করে হ্যান্ড টাচে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এর কারণ, তাঁর উচ্চতা ও লম্বা হাত। উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। দুই হাত মেলে ধরলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। এত লম্বা হাত সচরাচর দেখা যায় না। মজার ব্যাপার, অনুশীলন করতে করতে তাঁর বাঁ হাত থেকে ডান হাত দুই ইঞ্চি বেশি লম্বা হয়ে যায়। এই কারণে তিনি বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে পারতেন। 

খেলা ছাড়ার পর কোচ হিসেবে অভিষেক হয় জিয়াউরের। ২০১৪ সালে তাঁর কোচিংয়ে জাতীয় কাবাডিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বিজিবি। ২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটিতে এস এ গেমসে রৌপ্যপদক জয়ী বাংলাদেশ নারী দলের সহকারী কোচ, একই বছর ভারতের আহমেদাবাদে তৃতীয় বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পুরুষ দলের সহকারী কোচ এবং ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পুরুষ দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ২০১৭ সালে স্বাধীনতা কাপ কাবাডিতে চ্যাম্পিয়ন বিডিআর দলের কোচ ছিলেন।

জিয়াউর ২০০৫ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা কাবাডি খেলোয়াড় হয়েছেন। বাংলাদেশের কাবাডি বললে সবার আগে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর নাম।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×