স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৪০
দুঃসময়ে প্রথম টেস্ট জয়
দুলাল মাহমুদ
২৫ অক্টোবর ২০২১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয় যেকোনো দেশের জন্যই চির স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো। বাংলাদেশ সেই জয় পেয়েছিল ৩৫তম টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই ঐতিহাসিক জয় নিয়েই `স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০` ধারাবাহিকের এই পর্ব।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য তা যেন কঠিন এক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। একের পর এক শোচনীয়ভাবে হারতে থাকায় নানান রকম বিরূপ সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়। সমালোচকদের মূল বক্তব্য, অপাত্রে দান করা হয়েছে টেস্ট মর্যাদা। এমন সমালোচনার যথেষ্ট কারণ ছিল। ৩৪টি টেস্ট খেলেও জয়ের দেখা পাওয়া হয় না বাংলাদেশের। ৩১টিতে হার আর তিনটিতে ড্র। এরমধ্যে ২০টিতে ইনিংস পরাজয়। এতগুলো টেস্ট খেলে জিততে না পারার এমন রেকর্ড একমাত্র নিউজিল্যান্ড ছাড়া আর কারও নেই। নামের পাশে একটার পর একটা যুক্ত হতে থাকে কলঙ্কিত সব রেকর্ড।
টানা ২১ ম্যাচ হারার রেকর্ডও গড়ে বাংলাদেশ। সেই রেকর্ড আজও কাঁটা হয়ে আছে। যে টেস্ট ম্যাচগুলো বাংলাদেশের খেলা টেস্টগুলোর মধ্যে মাত্র ৯টি টেস্ট পঞ্চম দিনে গড়ায়। ১৬টি টেস্ট চতুর্থ দিনে এবং ৯টি টেস্ট তৃতীয় দিনে নিষ্পত্তি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডেভিড হুকস দম্ভভরে ঘোষণা দেন, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে একদিনেই হারানো সম্ভব। কত জনের কত কথাই না শুনতে হয়৷ সার্বিক অবস্থায় ক্রমান্বয়ে হেঁটমুণ্ড হয়ে যায় বাংলাদেশের। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এমন দুঃসময়ে জয় ছাড়া বাংলাদেশের জবাব দেওয়ার মতো আর কোনো উত্তর ছিল না। কিন্তু জয়টা কীভাবে পাওয়া যাবে?
বলতে গেলে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ জিততে না পারার ব্যর্থতা ঘুচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষভাবেই ভূমিকা রাখে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইউনিয়ন। এই দলের সঙ্গে চতুর্থ সিরিজে বাংলাদেশ জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে। অথচ এর আগে এই দলের সঙ্গে তিনটি সিরিজে ৬টি টেস্ট খেলে চারটিতে বড় ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ। বৃষ্টির কারণে অমীমাংসিত থাকে দুটি। তাহলে কেন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা? অনাকাঙ্খিত এক ঘটনায় হঠাৎ করে দলটি খুইয়ে ফেলে তার শৌর্যবীর্য। সেই সময় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে যে অন্ধকার নেমে আসে, তাতেই আলোর রেখা দেখতে পায় বাংলাদেশ। কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।
২০০৪ সালের এপ্রিলে অধিনায়ক হিথ স্ট্রিককে বরখাস্ত এবং ক্রিকেট বোর্ডে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান দলের নির্ভরযোগ্য ১৩ জন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার। বিদ্রোহী ক্রিকেটারদের বাদ দেওয়ায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে দল। ২১ বছরের তরুণ টাটেন্ডা টাইবুর নেতৃত্বে মোটামুটিভাবে অপেক্ষাকৃত নবীনদের নিয়ে গড়া হয় দল। তিনি ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়েসী অধিনায়ক। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। সে পরীক্ষায় শোচনীয়ভাবে হার মানতে হয়। সেই টেস্ট সিরিজে জিম্বাবুয়ের ছয় জন ক্রিকেটারের অভিষেক হয়। এ থেকে দলটির শক্তি অনেকটাই আঁচ করা যায়।
এরপর সফরকারী অস্ট্রেলিয়া ভঙ্গুর জিম্বাবুয়ের সঙ্গে খেলতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে টেস্ট আঙ্গিনায় কিছু দিনের জন্য অচ্ছুৎ হয়ে পড়ে দলটি। একসময়ের সাড়া জাগানো দলটি যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে থাকে। এরপর বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে পুনরায় ফিরে পায় টেস্ট মর্যাদা। মূলত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অংশ নেওয়া দলটি ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে আসে বাংলাদেশ সফরে। ভালো একটা মওকা পেয়ে যায় বাংলাদেশ। প্রথম টেস্ট জয়ের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সঙ্গত কারণেই জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠে বাংলাদেশ। এর ঠিক আগে আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারতকে হারিয়ে দেশের মাটিতে প্রথম জয় পাওয়ায় উজ্জীবিত ছিল স্বাগতিকরা। সব মিলিয়ে জিম্বাবুয়েকে হারানোর ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠে বাংলাদেশ।
শক্তি, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতায় প্রতিপক্ষের চেয়ে স্বাগতিকরাই ছিল শ্রেয়তর দল। জিততে না পারার কোনো অজুহাত অন্তত ছিল না। যে কারণে শোনা যেতে থাকে ইতিহাস গড়ার প্রতিধ্বনি। অবশ্য এই টেস্ট জয়ের জন্য বাংলাদেশের ওপর দারুণ চাপও সৃষ্টি হয়। তার কারণ, দুর্বল প্রতিপক্ষ পেয়েও হারাতে না পারলে তা হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের লজ্জাজনক এক অধ্যায়। আর চাপ সৃষ্টি হলে সহজ সমীকরণও কঠিন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দুর্বল প্রতিপক্ষকেও সবল মনে হতে থাকে। তখন 'বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়'।
এই মনের বাঘের কারণে এর আগে সম্ভাবনা জাগিয়েও টেস্টে জিততে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে পাকিস্তানের মুলতানে টেস্ট জিততে না পারার আক্ষেপ কখনই ঘুচবে না। জিততে না পারার যে ট্রেডমার্ক বাংলাদেশের কাঁধে এঁটে বসে, তা থেকে বের হওয়ার একটা সংশয় তো ছিলই।
শেষ পর্যন্ত সেই সংশয় কাটিয়ে উঠা যায়। অনেক প্রতীক্ষার পর বীর প্রসবিনী চট্টলার মাটিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। যদিও দুর্বল হয়ে পড়া জিম্বাবুয়েকে বাগে পেয়ে বাংলাদেশ দলের মনোবাসনা পূরণ হয়। তখন তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। ক্ষুধার্ত পেটে শিকার ধরা নিয়ে বাঘের কি আর হুঁশজ্ঞান থাকে? তেমনিভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জয়ের দেখা পাওয়াটাই হয়ে উঠে বাংলাদেশ দলের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। সেটা যেভাবেই হোক না কেন। অন্তত গ্লানিকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এর বিকল্প আর কিছু ছিল না।
এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে যেন ঐকিক নিয়মে সব কিছু বাংলাদেশের অনুকূলে চলে আসে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে ইতিহাস গড়ার পথে। ব্যাট আর বলে আধিপত্য বিস্তার করে স্বাগতিকরা। ব্যাটিংয়ে হাবিবুল বাশার ছাড়াও রাজিন সালেহ, মোহাম্মদ রফিক, নাফিস ইকবাল, খালেদ মাসুদ পাইলট, মাশরাফি বিন মুর্তজা, জাভেদ ওমর আর বল হাতে এনামুল হক জুনিয়র, মোহাম্মদ রফিক, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তাপস বৈশ্যরা অসাধারণ খেলেন। প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
অবশ্য জিম্বাবুয়ে দলকে একেবারে অসহায় মনে হয়নি। মূলত তরুণদের নিয়ে গড়া দলটি দেখিয়েছে তারুণ্যের ঝিলিক৷ সামর্থ্য অনুযায়ী গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট অমীমাংসিত রেখে দেখিয়েছে তাদের সক্ষমতাও। যাহোক, প্রত্যাশা অনুসারে সাফল্য লাভ করে স্বাগতিকরা। দুই টেস্টের সিরিজে প্রথম ম্যাচে ২২৬ রানে জয়ী হয় বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার চার বছর দুই মাস পর বাংলাদেশের অপেক্ষার অবসান ঘটে। কেটে যায় টেস্ট ম্যাচ জিততে না পারার বন্ধ্যাত্ব৷
ইতিহাস গড়ার সেই দিনটি ছিল ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি। দুপুর ১২টা ৫৩ মিনিটে স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রের বল ক্রিস্টোফার পোফুর ব্যাটে আলতো করে চুমু খেয়ে সিলি মিড অনে মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে ধরা পড়লে সৃষ্টি হয় ইতিহাস। নিজেদের ৩৫তম টেস্টে জয় পায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে ৬ উইকেট নিয়ে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হন এনামুল হক জুনিয়র। জীবনের চতুর্থ টেস্ট খেলতে নেমে ইতিহাসের অংশীদার হয়ে উঠেন বাঁহাতি এই স্পিনার।
বাংলাদেশের এই জয়টা কাঙ্ক্ষিতই ছিল। ছিল মানসিক প্রস্তুতিও। বেশ দুর্বল হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জিততে না পারলে তা হতো অসম্মানজনক। যেভাবেই হোক, প্রথম জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। এই জয়ে বীরত্ব না থাকলেও গৌরব তো অবশ্যই আছে। প্রথম টেস্ট জয়ের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। এই জয়ের কথা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ তাছাড়া সেই সময় হারতে হারতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এই জয় নিয়ে আসে আনন্দ ও স্বস্তি। এ কারণে তা উদযাপনে উৎসবের কমতি ছিল না। জাতীয় পতাকাকে সম্মানিত করার এমন উপলক্ষ জীবনে তো বার বার আসে না।