স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৩৯

টেবিল টেনিসের এক রাজকন্যা

দুলাল মাহমুদ

১৯ অক্টোবর ২০২১

টেবিল টেনিসের এক রাজকন্যা

বাংলাদেশের একজন ক্রীড়াবিদের নাম উঠেছে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে, এ থেকেই বুঝে নেওয়া যায় জোবেরা রহমান লিনুকে। বাংলাদেশের টেবিল টেনিসের এক কিংবদন্তি তিনি, জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন সাইক্লিংয়েও। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ তাঁর কথা।

বাংলাদেশে টেবিল টেনিস খেলার প্রচলন বেশ আগে থেকেই। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিককালে বেশ ভাটা পড়েছে। এই খেলার নিয়মিত চর্চা হলেও কোথায় যেন একটা অন্তরায় রয়ে গেছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে টেবিল টেনিসের অবস্থান মোটেও সুবিধাজনক নয়। এসএ গেমসেও ব্রোঞ্জ পদকের উপরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও যখন এ খেলাটির কথা আলোচিত হয়, তখন সহজাতভাবেই জোবেরা রহমান লিনুর কথা মনে পড়ে যায়। এ খেলাটির সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। সেটা তো আর এমনি এমনি হয়নি। 

এই খেলাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর শৈশব, তাঁর কৈশোর, তাঁর যৌবন। জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এলেও টেবিল টেনিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। এ খেলাটি তাঁকে যেভাবে ভালোবাসা ও মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছে, তা থেকে মুক্তি মেলেনি। তিনিও বোধকরি তেমনটা চাননি। খেলাটি তাঁর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। গড়ে উঠে আত্মার বন্ধন। 
 
বালিকা বয়সে টেবিল টেনিসে যখন লিনুর হাতেখড়ি হয়, তখন টেবিলের উচ্চতা ছিল তাঁর মাথা ছুঁই ছুঁই। আরেকটু বড় হয়ে খেলতে বলা হলেও বাবা ও বড় বোনের দেখাদেখি অনেকটা জেদ করে তিনি খেলাটি আয়ত্তে আনেন। সেই জেদ যে বরাবরই অটুট থাকবে, এটা পরিবারের কেউ নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি।

কিশোরী লিনু১৯৭৪ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তখনো তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি। সেবার ফাইনালে বড় বোন মুনিরা রহমান হেলেনের কাছে হেরে রানারআপ হন। একই বছর প্রথম জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে মহিলা এককে আবারও বড় বোনের কাছে হার মানতে হয়। বয়সে কয়েক বছরের বড় বোনের কাছে এ হার মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না। মাত্র ৯/১০ বছর জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হওয়া ছিল অনেক বড় ঘটনা। তাঁর মাঝে যে অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেটা তিনি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দেন। তাছাড়া জাতীয় টেবিল টেনিসের প্রথম আসরে দুই বোন ফাইনালে খেলেছেন, এই মাইলফলক আর কারও পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। সেবার বড় বোনের সঙ্গে জুটি গড়ে মহিলা দ্বৈত ইভেন্ট এবং সৈয়দ মাহবুব আলীর সঙ্গে জুটি বেঁধে মিশ্র দ্বৈতে শিরোপা জয় করেন। পরের বছর মহিলা এককে কিছু করতে না পারলেও মহিলা দ্বৈতে বোনের সঙ্গে শিরোপা অক্ষুণ্ন রাখেন। 

১৯৭৭ সালে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে প্রথমবার জয় করেন মহিলা এককের মুকুট। আগের বছরের চ্যাম্পিয়ন কাজী জেবুন্নেসা দীলাকে হারিয়ে এই গৌরব অর্জন করেন। মহিলা দ্বৈতেও শিরোপা জয় করেন। পরের বছর মহিলা এককের ফাইনালে দীলার কাছে হেরে যান। মহিলা দ্বৈতে জয়ী হন দীলার সঙ্গী হয়ে। ১৯৭৯ সালে দীলাকে হারিয়ে শিরোপা জিতলেও পরের বছর ফাইনালে তাঁর কাছে হারেন। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয় লিনুর একচ্ছত্র আধিপত্য। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও তিনি বজায় রেখেছেন তাঁর কর্তৃত্ব। 

২০০১ সালে সর্বশেষ মহিলা এককে যখন ১৬তম শিরোপা জয় করেন, তখন তাঁর বয়স ৩৬ অতিক্রম করেছে। একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও জয়ের অদম্য স্পৃহাই তাঁকে বারবার শিরোপা এনে দেয়। খেলায় তাঁর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত। সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ২০০২ সালে তাঁর নাম উঠে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ। এ এক অনন্য অর্জন।এককের পাশাপাশি দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈতেও অসংখ্যবার সাফল্য পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ গেমস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ স্মৃতি, আমন্ত্রণমূলক টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। 

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। তাঁকে ছাড়া জাতীয় দল যেন অপূর্ণ রয়ে যেত। বিশ্ব টেবিল টেনিস, এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ, সাফ গেমসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বছরের পর বছর খেলেছেন। সাফল্য না এলেও তিনি আলাদাভাবে নজর কেড়ে নিতে পারতেন। সেটা তাঁর খেলা দিয়ে, স্টাইল দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে। 

গিনেস বুকে ওঠার স্বীকৃতি হাতে জোবেরা রহমান লিনু

টেবিল টেনিসের পাশাপাশি সাইক্লিস্ট হিসেবেও অনেক সাফল্য আছে লিনুর। সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। পাকিস্তান আমলে শুরু হলেও তখনও সাইক্লিংয়ে নারীদের তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। মেয়েরা সাইকেল চালাবে, এটা উদার দৃষ্টিতে দেখা হতো না।  এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার তাগিদ থেকেই হয়তো তাঁর সাইক্লিংয়ে আবির্ভাব। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ গেমসে ২০০০ মিটার স্ক্র্যাচ রেসে স্বর্ণ ও ১০০০ মিটার স্ক্র্যাচ রেসে রৌপ্যপদক জয় করে চমকে দেন। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে অবশ্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছিলেন। প্রতিদিন ১৬ মাইল সাইকেল চালিয়ে অনুশীলন করেন। এটা মোটেও সহজ ছিল না। তাঁর কোনো প্রশিক্ষক ছিল না। সাইক্লিংয়ের কলাকৌশল সম্পর্কে জানা ছিল না। কিন্তু মনের জোরে এগিয়ে গিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। আগের বছরের দুই ইভেন্টে ১৯৭৯ সালে তিনি জয় করেন স্বর্ণপদক। ১৯৮০ সালেও একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করেন। ১৯৮১ সালে ১০০০ মিটারে স্বর্ণ জিতলেও ২০০০ মিটারে লাভ করেন ব্রোঞ্জ পদক। ১৯৮৩ সালে ৮০০ মিটার টাইম ট্রায়াল, ২০০০ মিটার স্ক্র্যাচ ও ৩০০০ মিটার স্ক্র্যাচ রেসে রৌপ্যপদক অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে ৮০০ মিটার টাইম ট্রায়াল ও ৩০০০ মিটার স্ক্র্যাচ রেসে পান ব্রোঞ্জ পদক। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর মতো স্মার্ট ও শিক্ষিত একজন মেয়ে কোনো কিছুর পরোয়া না করে, রাজপথে দিব্যি সাইকেল চালান, এটা নারী প্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। 

লিনু ব্যাডমিন্টনও মন্দ খেলতেন না। স্পুটনিক ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রতিভার ঝিলিক দেখা যায়। 
খেলা ছাড়ার পর সংগঠক হিসেবে টেবিল টেনিস ও সাইক্লিংয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সাইক্লিং যে পরিবেশের অনুকূল, এই ধারণা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াটাকেও তিনি মিশন হিসেবে নিয়েছেন। তিনি হৃদয়ে যে আবেগ আর সংবেদনশীলতা লালন করেন, সেই অনুভূতি প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প আর কবিতায়। তাঁর রয়েছে একাধিক গ্রন্থ। 

লিনু টেবিল টেনিসে ১৯৮০ ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা খেলোয়াড়, ১৯৯৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনে জোবেরা রহমান লিনু একটা প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁর সাফল্য, তাঁর সৌন্দর্য, তাঁর ব্যক্তিত্ব আলাদা একটা মাত্রা যোগ করেছে। সেই সত্তর দশকে তো বটেই, এখনও নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যে কারণে টেবিল টেনিস বললে চট করে তাঁর নামটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং অনেক নবীন ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের কাছে তিনি হয়ে আছেন অনুপ্রেরণার উৎস।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×