ক্রিকেটের কাজে না লাগলে টাকা দিয়ে কী হবে?
উৎপল শুভ্র
১১ অক্টোবর ২০২১
রেকর্ড তিনি এবার নির্বাচিত হওয়ার আগেই করে ফেলেছেন। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি থাকার রেকর্ড। কিন্তু নয় বছরে কতটা কী করতে পেরেছেন? করা উচিত ছিল, কিন্তু করেননি, এমন কাজগুলো কি করবেন এবার? বোর্ড সভাপতি হিসেবে নাজমুল হাসান পাপন আরেক মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর কাছে চাওয়ার কথা জানাতে গিয়ে একটা খোলা চিঠিই লিখে ফেলেছেন উৎপল শুভ্র। সেই চিঠির দ্বিতীয় পর্ব।
...বলছিলাম ঢাকার তৃতীয় বিভাগের ক্লাব থেকেও একজন বিসিবি সদস্য হয়ে যাচ্ছেন, আবার রাজশাহী জেলার মতো বড় ক্রিকেট কেন্দ্র থেকেও একজনই...এটা কেমন কথা? এখানে 'বিসিবি সদস্য’ বলতে কী বুঝিয়েছি, আপনার তা বুঝতে পারার কথা। তারপরও সাধারণ্যে এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই দেখে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব, সারা দেশের জেলা ও বিভাগ এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে মনোনীত প্রতিনিধি, যাদের ভোটে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত হয়, এঁরা সবাই যে বোর্ডের সদস্য, এটা অনেক সময় আমাদের অনেকের মনেই থাকে না। ‘কাউন্সিলর’ বলে অদ্ভুত এক পরিচয়ের আড়ালে তা ঢাকা পড়ে যায়।
এই যে ১৭১ জন বোর্ড সদস্য, তাঁদের কতজন আসলে ক্রিকেটের জন্য কাজ করেন? তার চেয়েও জরুরি এবং মৌলিক প্রশ্ন, এঁদের সবাই কি আদৌ ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত? নির্বাচিত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে আপনিও দেখলাম এই প্রশ্নটা তুলেছেন। তবে সেটিও ক্লাবের দৃষ্টিকোণ থেকেই। কারণটা তো অনুমেয়ই, আপনিও তো একটা ক্লাবের প্রতিনিধি হিসেবেই বিসিবিতে এসেছেন। আপনার প্রশ্নটাকে অবশ্য যৌক্তিক বলে মানতেই হচ্ছে, যাঁরা ক্লাবের সঙ্গে আছেন, তাঁদের ক্রিকেট সম্পৃক্তির একটা প্রমাণ তো তা-ও পাওয়া যায়; কিন্তু বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধি হয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের সবাই কি ক্রিকেটের মানুষ? নির্বাচনের সময় ছাড়া বেশির ভাগেরই তো ক্রিকেটের সঙ্গে কোনো সংশ্রব থাকে না। কথাবার্তায় চির জীবন ক্রিকেটবিরোধিতার পরিচয় রেখে আসা কাউকে কাউকেও তো দেখি কাউন্সিলর হিসেবে বুক ফুলিয়ে বিসিবিতে ঢুকছেন। কারণটাও নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। এই মনোনয়ন দেন জেলা প্রশাসক, এবং রাজনৈতিক বিবেচনা ও লবিং-ই যাতে বেশি প্রাধান্য পায়।
আপনি এভাবে ভেবেছেন কি না জানি না, এই সমস্যা সমাধানের পথও কিন্তু আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাই। সেটিকে শুধু বিভাগীয় ক্রিকেট সংস্থায় সীমাবদ্ধ না রেখে আরও একটু ছড়িয়ে দিতে হবে। ফিফার চাপে বাফুফে যে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফএ) করতে বাধ্য হয়েছে এবং অবকাঠামোগত সমর্থন না থাকায় যাতে হিতে বিপরীত হয়েছে, বিসিবিকে নিজের উদ্যোগে সেটাই করে ফেলতে হবে। ধারণাটা ডিএফএ'র মতোই। প্রতিটি জেলায় শুধু ক্রিকেটের জন্যই নিবেদিত সংস্থা থাকবে, যেটির নাম হবে ডিসিএ, মানে ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। সেই জেলা ক্রিকেট সংস্থায় শুধু ক্রিকেট সংগঠকরাই থাকবেন, তাঁদের ভোটেই নির্বাচিত হবে বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। সেই বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কোন জেলায় ক্রিকেট হয়, আর কোন জেলায় হয় না, তার নজরদারি করবে। সেই বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন হবে একেকটা ‘মিনি বিসিবি’, যাদের আলাদা সিলেকশন প্যানেল থাকবে, আলাদা বয়সভিত্তিক দল, আলাদা কোচিং স্টাফ, পেশাদার কর্মী। মাঠ থাকবে, ইনডোর থাকবে, থাকবে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারদের সঙ্গে চুক্তি, যেটি ঠিক করবেন বিভাগীয় নির্বাচকেরা। জেলা ক্রিকেট সংস্থাগুলোর বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের কাছে জবাবদিহিতা থাকবে, বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের মূল বোর্ডের কাছে। যা বলছি, তা এমন কোনো মহাকাশ বিজ্ঞান তো নয়ই, বৈপ্লবিক কোনো ধারণাও নয়, বিশ্ব জুড়ে ক্রিকেট এভাবেই চলে। আপনি আইসিসির সভায় যান, বিভিন্ন দেশে ট্যুরে যান, আপনার এসব অজানা থাকার কথা নয়।
এখন কথা হলো, প্রস্তাবিত এই ডিসিএ খেলা চালাবে কোথায়? জেলা স্টেডিয়াম তো জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পত্তি। ডিএফএ'র সমস্যা আর কি! যে সমস্যার সমাধান খুব সহজ। বাফুফের না হয় টাকা নেই, যে কারণে মাঠের জন্য তাদের জেলা ক্রীড়া সংস্থার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। ক্রিকেটের তো আর টাকার অভাব নেই। বরং বিসিবি বিশ্বের চতুর্থ না ধনী বোর্ড, এ নিয়ে অনেককে তর্ক করতে শুনি। কিছুদিন আগে আপনি নিজেই তো জানিয়েছেন, বিসিবির স্থায়ী আমানতের পরিমাণ নয় শ কোটি টাকা। এখন আমাকে বলুন, টাকা দিয়ে কী হবে, যদি তা ক্রিকেটের কাজে না লাগে! আপনার কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, এমন টাকার পাহাড়ে বসে থেকেও কেন এখনো বিসিবির নিজস্ব একটা মাঠ নেই? কেন মিরপুর একাডেমি মাঠ নিয়েই আমরা আহা-উহু করতে হয়, যেখানে বেশির ভাগ ক্রিকেটিং দেশে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেই এমন ফ্যাসিলিটিস খুব কমন ব্যাপার। ক্লাবগুলোতে তো বটেই।
কেন দেশের প্রতিটি বিভাগে ক্রিকেটের জন্য পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন সুবিধা নেই? কেন পটুয়াখালীর একজন কিশোর বা তরুণ নিবিড় অনুশীলন করতে চাইলে তাঁকে ঢাকাতেই আসতে হবে? জেলায় জেলায় পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট স্টেডিয়াম না হোক, শুধুই ক্রিকেটের জন্য নিবেদিত একটা মাঠ কেন থাকবে না? সেটি কীভাবে হবে, একদিন কথায় কথায় আপনাকে তা বলেও ছিলাম। বিসিবি নিজেদের টাকায় জমি কিনে জেলায় জেলায় ক্রিকেট মাঠ বানিয়ে নিক্ না! সেখানে কিউরেটর থাকবেন, মাঠকর্মী থাকবেন। শিশু-কিশোর-তরুণেরা মনের আনন্দে খেলবে, খেলতে খেলতেই ক্রিকেটার বেরিয়ে আসবে। জেলার লিগ হবে সেই মাঠে, আরও কোনো টুর্নামেন্ট করতে চাইলে তা-ও।
আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা করার সমস্যা হিসাবে বিসিবির গঠনতন্ত্রে কিছু সাংঘর্ষিক দিকের কথা প্রায়ই শুনি আপনার মুখে। জেলা ক্রিকেট সংস্থা করতে গেলেও হয়তো এমন কিছু সমস্যায় পড়তে হতে পারে। কিন্তু আপনি চাইলে এর সমাধান কোনো ব্যাপারই হওয়ার কথা নয়। আপনি তো শুধু বিসিবির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সভাপতিই নন, সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষমতাবানও। ক্লাব স্বার্থ আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মন্ত্রণাদাতাদের প্রভাব কাটিয়ে যদি আপনি সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগান, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস আপনাকে চিরদিন আলাদা করে মনে রাখবে। তা না হলে সেই ক্ষমতাকে সবাই মনে রাখবে বিসিবি সভাপতির চেয়ার ধরে রাখার বাহন হিসেবে। আপনি নিশ্চয়ই তা চাইবেন না।
আপনার সঙ্গে সামনাসামনি বা ফোনে যতটুকু কথা হয়েছে, তাতে বুঝতে কোনো সমস্যাই হয়নি যে, ক্রিকেট আপনি খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, আপনার ভালোবাসাটা অনেকটাই জাতীয় দলকেন্দ্রিক। যা প্রায় অবসেশনের রূপ নিয়েছে বলেও মনে হয়েছে কখনো কখনো। টস, উইকেট, ব্যাটিং অর্ডার, ক্রিকেটারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা...এসব নিয়ে আপনি যে প্রায়ই বোর্ড সভাপতির প্রকাশ্যে বলা উচিত নয়, এমন সব মন্তব্য করে বসেন, শুধু খবরে থাকতে চাওয়াকেই এর একমাত্র কারণ বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশ দলের প্রতি তীব্র ভালোবাসারও হয়তো ভূমিকা থেকে থাকবে এতে। এ কারণেই কখনো কখনো মনে হয়, আপনার মনোযোগটা বোধ হয় আরেকটু ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় দলকে ঘিরেই যত গ্ল্যামার, জাতীয় দলকে ঘিরেই সব আলোচনা, এটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু জাতীয় দল তো স্বতন্ত্র সত্তা হয়েও তা স্বতন্ত্র কিছু নয়। সারা দেশের ক্রিকেটই আসলে প্রতিফলিত হয় জাতীয় দলে। ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নতি হলে জাতীয় দল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। বিশেষজ্ঞ না হয়েও এটাও আপনার অজানা থাকার কথা নয় যে, ক্রিকেটের সামগ্রিক সেই উন্নতি নির্ভর করে মূলত লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটের ওপর। যা ক্রিকেটারদের স্কিলের সত্যিকার পরিচর্যা ও পরীক্ষার জায়গা। অন্য দুই ফরম্যাটে ভালো খেলোয়াড় হতেও যা কাজে লাগে। অথচ আবার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আপনি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে পাঁচ নম্বরে যাওয়ার লক্ষ্যের কথা ঠিকই বললেন, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সুনির্দিষ্ট এমন কোনো কিছু নয়। যা শোনার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম। এটাও কি সেই ক্লাব ক্রিকেটের প্রভাব, যেখানে ক্রিকেট মানেই সীমিত ওভারের ম্যাচ?
টেস্ট ক্রিকেটের কথা ওঠায় আবারও সেই বহুলচর্বিত বিভাগীয় ক্রিকেট সংস্থাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করাও যে এর সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভাগে বিভাগে প্রতিযোগিতার জাতীয় লিগে যতদিন না সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফুলকি ছুটছে, ততদিন টেস্ট ক্রিকেটে এমন ধুঁকতে থাকাই বাংলাদেশের নিয়তি। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফুলকি ছোটাতে কী করা উচিত, এ নিয়েও এই অভাজনের কিছু পরামর্শ ছিল। কিন্তু চিঠিটা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন মনে হয় শেষ করা দরকার। জাতীয় লিগ নিয়ে কথাগুলো অন্য কোনোদিন বলা যাবে। সামনাসামনি বলার সুযোগ না হলে না হয় আরেকটা খোলা চিঠিতেই।
বোর্ড সভাপতি হিসেবে আপনার নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সত্যিকার পরিবর্তনের সূচনা হবে, এই আশা নিয়ে শেষ করি। কামনা করি সাফল্যও। কারণ বারবার এমন সুযোগ আসার পরও আপানি সেটি কাজে লাগাতে না পারলে তা বড়ই দুঃখের ব্যাপার হবে।
ইতি,
উৎপল শুভ্র