স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৩৭
গৌরবের অভিষেক টেস্ট
দুলাল মাহমুদ
৬ অক্টোবর ২০২১
২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক দিন। সেদিনই টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত আঙ্গিনায় পা পড়েছিল বাংলাদেশের। `স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০` ধারাবাহিকের এবারের পর্বে ভারতের বিপক্ষে সেই অভিষেক টেস্ট।
কবে খেলবে বাংলাদেশ অভিষেক টেস্ট ম্যাচ?
টেস্ট স্টাটাস পাওয়ার পর অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে টগবগিয়ে ফুটতে থাকেন ক্রিকেটানুরাগীরা। তখনও যেন অনেকেই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দোল খেতে থাকেন। সত্যিই কি বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ খেলবে? সত্যি জেনেও তা নিয়ে সংশয়, টেস্ট ক্রিকেটটা এ দেশের মানুষের কাছে ছিল স্বপ্নময় একটা ব্যাপার। আর স্বপ্ন যখন হঠাৎ সত্য হয়ে যায়, তাতে হতভম্ব হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলবে, এই সত্যটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কারও কারও পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। তাদের অভিমত ছিল, এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাস পাওয়া ঠিক হয়নি। মনোভাবটা ছিল এমন, যেন তাড়াতাড়ি টেস্ট স্টাটাস পাওয়ায় ক্রিকেটের অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। আসলে টেস্ট ঘরানার যে মোহময় জগতে তাঁদের বিচরণ ছিল, তা এতটা সুলভ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা হয়তো ঠিক হজম করতে পারছিলেন না। আর কিছু দুঃখবিলাসী মানুষ আছেন, পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াটাই তাদের কাছে পরম আনন্দের মনে হয়। যে কারণে সব কিছু সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাতে তো আর ঘটনাপ্রবাহ থেমে থাকে না। যা ঘটার তা ঘটে যায়।
টেস্ট স্টাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচ নিয়ে এক রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কবে মাঠে গড়াবে স্বপ্নের সেই ম্যাচ? বাংলাদেশ কার সঙ্গে খেলবে? সবার কাছে এটি ছিল মস্ত কৌতূহলের। ক্রিকেটের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের সঙ্গেই ম্যাচ খেলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল বাংলাদেশ। এর আগে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলঙ্কার অভিষেক টেস্টের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। আমন্ত্রণ পেয়ে ব্রিটিশরাও খুব খুশি হয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের ব্যস্ত সূচির কারণে খুব তাড়াতাড়ি ম্যাচ খেলা সম্ভব ছিল না। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হতো।
কিন্তু বাংলাদেশের অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না। তখন প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এটাও ঠিক, এই ম্যাচ খেলা যে কোনো দেশের জন্যই গৌরবের। শুধু তো ম্যাচ খেলা নয়, ইতিহাসের অংশীদার হওয়া। এমন প্রস্তাব পেয়ে লুফে নেয় ভারত। এর আগে পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ের অভিষেক টেস্টের প্রতিপক্ষ ছিল দেশটি। ২০০০ সালের ২৫ আগস্ট এই ম্যাচ খেলার বিষয়ে ভারতের সম্মতির কথা জানতে পারা যায়।
ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি এ সি মুথিয়া আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বলেন, "It's an honour to take part in a historic moment for Bangladesh's cricket"। ঐতিহাসিক সেই মুহূর্ত আসতে বেশি সময় লাগেনি। দুই ক্রিকেট বোর্ডের সম্মতিক্রমে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর থেকে টেস্ট ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকেই ক্রিকেট অঙ্গনে উৎসবের মেজাজ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সাড়ে চার মাসের মাথায় বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচ খেলতে পারাটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার আরেকটি দৃষ্টান্ত।
অভিষেক টেস্টের গৌরবময় মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রায় সপ্তাহব্যাপী উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পোলিও নির্মূল কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ফটো প্রদর্শনী, জাতীয় ক্রিকেট দলের নয় অধিনায়ককে ক্রিকেট দূতের স্বীকৃতি, আতশবাজি উৎসব। সব মিলিয়ে দেশব্যাপী একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় অভিষেক টেস্টে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন নাঈমুর রহমান দুর্জয় (অধিনায়ক), খালেদ মাসুদ পাইলট (সহ-অধিনায়ক), শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, মেহরাব হোসেন অপি, হাবিবুল বাশার সুমন, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, আল শাহরিয়ার রোকন, মোহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হোসেন শান্ত, বিকাশ রঞ্জন দাস। দ্বাদশ খেলোয়াড়: রাজিন সালেহ আলম। কোচ: ইমরান সারোয়ার। ম্যানেজার: আজিজ আল কায়সার টিটু।
এর আগে ঢাকা স্টেডিয়ামে আটটি টেস্ট ম্যাচ আয়োজিত হলেও তাতে ছিল না দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনা। এর কারণ, তাতে পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না সে সময়ের স্বাগতিক পাকিস্তান দলে। নিজের দেশের প্রতি মোটামুটিভাবে সবারই একটা আকর্ষণ থাকে। এ কারণে অভিষেক টেস্ট ম্যাচের সাক্ষী হওয়ার জন্য উদ্বোধনী দিন সকাল থেকে জাতীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন, ক্রিকেটারদের ছবি নিয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামমুখী যাত্রা শুরু হয় দর্শকদের। খুব দ্রুতই পরিপূর্ণ হয়ে যায় স্টেডিয়াম। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী আর বাংলাদেশের অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় নবান্ন উৎসবের মাস কার্তিকের সকালে টস করার মাধ্যমে সূচনা করেন নতুন এক ইতিহাসের। দুই দেশের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে একই সঙ্গে অভিষেক হয় দুই বাঙালির। অবশ্য প্রথম বাঙালি হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করার গৌরব ভারতের পঙ্কজ রায়ের। তিনি ছিলেন ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল প্যারাট্রুপারদের টেস্ট খেলুড়ে দশটি দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠে নামা।
টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন দুর্জয়। ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্টিভ বাকনার এবং ইংল্যান্ডের ডেভিড শেফার্ড। টিভি আম্পায়ার ছিলেন বাংলাদেশের মাহবুবুর রহমান আর ম্যাচ রেফারি ইংল্যান্ডের রমন সুব্বা রাও। সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাট হাতে ওপেন করতে নামেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হোসেন অপি। পল্টন ময়দানের প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ভারতের মিডিয়াম পেসার জাভাগাল শ্রীনাথের বলের মুখোমুখি হয়ে ইতিহাসের শিখা জ্বালানোর গৌরব বিদ্যুতের। যার মাধ্যমে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত শ্রেণিতে লেখা হয়ে যায় বাংলাদেশের নাম।
টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় ১২৪ বছরের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ের পর দশম দেশ হিসেবে অভিষিক্ত হয় বাংলাদেশ। এটি ছিল ১৫১২তম টেস্ট। প্রথম রান আসে অপির ব্যাট থেকে। প্রথম ফিফটি হাবিবুল বাশারের।
অভিষেক টেস্টকে দারুণভাবে রাঙিয়ে দেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করার তৃতীয় দৃষ্টান্ত তাঁর। এর আগে এই গৌরব ছিল অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান ও জিম্বাবুয়ের ডেভ হটনের। বুলবুলের ব্যাট থেকে আসে ১৪৫ রান। প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে বাংলাদেশ চমকে দেয় সবাইকে। প্রথম তিন দিন ছিল যেন এক স্বপ্নযাত্রা। দুর্জয়ের ৬ উইকেট একটা সময় দারুণ চাপে ফেলে দিয়েছিল ভারতকে। অভিষেক টেস্ট অবশ্য শেষ পর্যন্ত আনন্দ-বেদনার দুই রকম অভিজ্ঞতার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। ভারত ৯ উইকেটে জয়ী হয়। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন সুনীল যোশী। সঙ্গত কারণেই লংগার ভার্সনের ক্রিকেটে অনভ্যস্ত বাংলাদেশ দলের এমন অভিজ্ঞতা হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না। তারপরও দর্শক এই টেস্টের প্রতিটি মুহূর্ত হৃদয়ের ক্যানভাসে ছবি এঁকে ইতিহাসের অংশীদার হন। এমন ঘটনা তো আর সবার জীবনে আসার সুযোগ নেই।
এরপর থেকে তো নিয়মিতভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। তাতে কত রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে। কিন্তু অভিষেক টেস্টের গৌরবের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না। এই গৌরব হয়ে উঠেছে একটি জাতির ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করার সোপান।