স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৩৬

লাল হরফে লেখা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সেই দিন

দুলাল মাহমুদ

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

লাল হরফে লেখা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সেই দিন

স্বাধীনতার পর ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জনের তালিকা করতে গেলে ক্রিকেটে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া সম্ভবত সবার ওপরেই থাকবে। ২০০০ সালের ২৬ জুন তাই বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে লাল হরফে লিখে রাখার মতোই একটি দিন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ সেই স্বপ্ন পূরণের কথা।

সেই পাকিস্তান আমল থেকে ক্রিকেট নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত একটি অংশের মধ্যে এক রকম রোমান্টিকতা ছিল। এর প্রধান কারণ, সেই পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান টেস্ট ক্রিকেট দলের অভাবনীয় সাফল্য। লক্ষ্ণৌয় নিজেদের দ্বিতীয় টেস্টেই ভারতকে হারিয়ে প্রথম জয় পাওয়া এবং এর কিছুদিন পরই ওভালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ায় ব্যাপক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। এরপর একে একে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারালে পাকিস্তান খুব দ্রুতই ক্রিকেটের শক্তিমান দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। শুরুতে ফজল মাহমুদ, হানিফ মোহাম্মদ, নজর মোহাম্মদ, খান মোহাম্মদ, ওয়াকার হাসান, ইমতিয়াজ আহমেদ, সাইদ আহমেদরা তরুণ প্রজন্মের আইকনে পরিণত হন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটাররাও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। 

ঢাকার মাঠে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের সাতটি টেস্ট ম্যাচ খেলা হলে দারুণ ক্রেজ তৈরি হয়। বিদেশি দলের অনেক ক্রিকেটারও মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেন। এই ধারাটা পরবর্তীকালে অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও অনেকেই এই হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কেউ কেউ কানের কাছে ছোট একটা ট্রানজিস্টর নিয়ে দেশ-বিদেশের ক্রিকেটের কমেন্ট্রি শুনতেন। ক্রিকেটটা তাঁদের কাছে ছিল প্যাশন। তাঁরা ছিলেন মূলত টেস্ট ক্রিকেটের সমঝদার। এই রোমান্টিকদের কারণেই মূলত ক্রিকেটের চর্চা বাড়তে থাকে। তা এই ভূখণ্ডজুড়ে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়। কিন্তু এই ক্রিকেট অনুরাগীরা কি ভাবতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ কখনও টেস্ট ক্রিকেট খেলবে?

কেউ কেউ কল্পনার ক্যানভাসে তেমন ছবি আঁকলেও বাস্তবটা কিন্তু তেমন ছিল না। ক্রিকেট সীমিত ছিল নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে। তা গণমানুষের খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। দীর্ঘ সময় আইসিসির সহযোগী সদস্য হয়ে থাকার মধ্যেই আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। এই মোহাচ্ছন্নতা থেকে বোধোদয় হতে প্রায় দুই দশক লেগে যায়। শুরু হয় নতুন ভাবনাচিন্তা। সেই ভাবনাটা স্ফুলিঙ্গ হয়ে প্রজ্বলিত করতে সময় লাগেনি৷ শুরু হয় দিনবদলের গান। 'মিশন ইম্পসিবল ওয়ান' হয়ে উঠে আইসিসি ট্রফি। রোমাঞ্চকর এই মিশনে সফল হওয়ার পর নতুন নতুন মিশন টার্গেট করা হয়। ক্রিকেটে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে যে মোটেও পিছিয়ে নেই, সেটা বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিতে পেরেছে। নিজেদের সাধ্য ও সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছে। 

একটু একটু করে টেস্ট স্টাটাসের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে বাংলাদেশ। এর আগে এমন মিশনের কথা কেউ ভাবতেই পারেননি। এটা তো অজানা ছিল না, টেস্ট স্টাটাস ছেলের হাতে মোয়া নয়। কিন্তু স্বপ্ন থাকলে, সদিচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব হয়ে উঠে না। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের পরবর্তী মিশনগুলোতে সাফল্য পেতে সুবিধা হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাসের মিশনটা হালে পানি পায়। 

বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায় সাবের হোসেন চৌধুরী ও সৈয়দ আশরাফুল হকের ক্রিকেট কূটনীতিরও বড় ভূমিকা ছিলশুধু স্বপ্ন দেখানো নয়, টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করতে উদ্যোগের কোনো কমতি ছিল না। আর এ ক্ষেত্রে মাঠের ক্রিকেটের চেয়ে মাঠের বাইরের ক্রিকেট হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ। 'ক্রিকেট কূটনীতি' ছিল প্রধান ফ্যাক্টর। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই মহারথী সাবের হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল হকদের কর্মকুশলতা, মেধা ও দক্ষতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তাঁরা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে পেয়ে যান আইসিসির তদানীন্তন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়াকে। ক্রিকেট বিশ্বায়নের যে কর্মসূচি তিনি ঘোষণা করেন, তার সঙ্গে দুইয়ে দুইয়ে চার হিসেবে সংযুক্ত হয় বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাস প্রসঙ্গটি। 

বিশ্বময় ক্রিকেটের বাজার সৃষ্টি করে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে ক্রিকেটের সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে সবার আগে বাংলাদেশ নজর কাড়তে সক্ষম হয়। সে কারণে আইসিসির ক্রিকেটের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রমে বাংলাদেশকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০০০ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী যে 'ক্রিকেট সপ্তাহ' আয়োজন করা হয়, তাতে মূল ফোকাসটা ছিল বাংলাদেশে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকায় বসে তারার মেলা। অনুষ্ঠিত হয় 'এশিয়া একাদশ' এবং 'অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ'-এর মধ্যে দিবা-রাত্রির ম্যাচ। ৩৭টি চ্যানেলের মাধ্যমে খেলাটি বিশ্বের ১১৮টি দেশে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। 

কূটনীতিতে সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সময়কে অস্বীকার করা যায় না। তার একটা প্রভাব গভীরভাবে থাকে। সেই সময়ে ডালমিয়া আইসিসির সভাপতি পদে সমাসীন থাকায় বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠে সোনায় সোহাগা। তাঁর কর্মপন্থার সঙ্গে মিলে যায় বাংলাদেশের চাওয়া। সব মিলিয়ে সময়টা ছিল স্রোতের অনুকূল। ১৯৯৭ সালের জুনে লন্ডনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-র সভায় ১২ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। এটাও ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যময়।

বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে অভিনন্দন জানানোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে টেস্ট পরিবারে স্বাগত জানাচ্ছেন আইসিসি সভাপতি ম্যালকম গ্রে। ২০০০ সালের ২৬ জুন লর্ডসে আইসিসির সভায়। ছবি: শা. হ. টেংকু

আগেই জানা যায়, ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাসের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। ক্রিকেট-তীর্থ লন্ডনের লর্ডসের লং রুমের সভায় বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা জানার জন্য সকাল থেকেই প্রতীক্ষায় থাকেন ক্রিকেট অনুরাগীরা। ক্রিকেটমুগ্ধ জাতি হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের জানান দিয়েছে। এই খেলাটির প্রতি নিবেদন, আয়োজক হিসেবে অাতিথেয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার সবটাই চমৎকারভাবে মেলে ধরে। ক্রিকেটের মান, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক নানান বিষয় অবলোকন করে আইসিসির বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেন। 

সব মিলিয়ে আইসিসির সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণ ছিল না। মোটামুটিভাবে বিকেল বেলাই সন্তুষ্টির কথা জানা যায়। তবে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় লর্ডসের নার্সারির বারান্দায় আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলন। জগমোহন ডালমিয়ার স্থলাভিষিক্ত আইসিসির নতুন সভাপতি অস্ট্রেলিয়ার ম্যালকম গ্রে ঘোষণা করেন, 'আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর সহযোগী ও পূর্ণ সদস্য সব মিলিয়ে ৩৫টি দেশই বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাসের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সে হিসেবে দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশের সার্টিফিকেট পেলো বাংলাদেশ।' এই ঘোষণা একুশে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় তা দেশের মানুষ জানতে পারেন। সোনার হরফে লেখা হয়ে যায় বাংলাদেশের নাম। আসলে ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে টেস্ট মর্যাদার মহিমা কোনও বিশেষণ দিয়ে বোঝানো যাবে না।

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খবর পেয়ে ঢাকায় আনন্দ মিছিল

১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন বাংলাদেশ অর্জন করে ওয়ানডে স্টাটাস। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্টাটাসের জন্য আবেদন করেছিল। সে সময়ে পাঁচটি দেশ বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিলেও চারটি দেশ আরো পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দেয়। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে হারালে বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাস অর্জনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর পাশাপাশি বিভিন্নভাবে লবিং অব্যাহত থাকে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কোনো কার্পণ্য ছিল না। যে কারণে টেস্ট স্টাটাসের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে প্রেক্ষাপট, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে টেস্ট স্টাটাস পাওয়াটা অনেক বড় ঘটনা। আর এই ক্ষেত্রে মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়ে সাংগঠনিক দক্ষতার ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।

টেস্ট স্টাটাস পাওয়ার ঘোষণার পর আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়োজন করা হয় আনন্দ সমাবেশ। ক্রিকেটীয় সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×