১৯৯৯ সাফ গেমসে ফুটবলের সোনা
যে শিরোপার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ
দুলাল মাহমুদ
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসার কথা অজানা নয় কারোরই। কিন্তু সে তুলনায় সাফল্য বেশ নগণ্যই। বিশেষ করে সাফ গেমস ফুটবলে সোনার জন্য ছিল তীব্র হাহাকার। যেটির অবসান হয়েছিল ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকের আজকের পর্বে ওই টুর্নামেন্টের গল্প।
আন্তর্জাতিক ফুটবলের শিরোপা জয়ের সারণীতে নাম লিপিবদ্ধ করতে বাংলাদেশকে প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। ফুটবলপ্রিয় একটা জাতির জন্য এই অপেক্ষা কি অনেক দীর্ঘ নয়? অথচ ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যে দেশগুলো গৌরব করতে পারে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। ইংল্যান্ডের বাইরে বৃটিশ সৈন্যদের পায়ে পায়ে ঔপনিবেশিক যে সব এলাকায় সবার আগে ফুটবলের চর্চা ও প্রসার ঘটে, এই পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের নামটি সেই সারিতে প্রথমদিকেই রয়েছে। অন্তত এই একটা বিষয়ে ফুটবলের অনেক প্রভাবশালী দেশের তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও এই অঞ্চলের ফুটবল কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। জনপ্রিয়তার সেই উপচে পড়া ঢেউ প্লাবিত করেছে বিপুল জনগোষ্ঠীকে। সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে যুগের পর যুগ। ফুটবল খেলাকে নিয়ে রয়েছে কত আখ্যান, কত উপাখ্যান। কত ঘটনা, কত রটনা। কত সৃষ্টি, কত অনাসৃষ্টি। এই দেশের মানুষের ফুটবলের মাধ্যমে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও জাতীয়তাবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু সাফল্যের ক্ষেত্রে সেই ধারাটা অনুসৃত হতে পারেনি। কখনো কখনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিলেও কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ।
১৯৯৪ সালে মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমারে চার জাতির ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলেও তাতে অপূর্ণতা রয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ফুটবলের মানদণ্ড অনুযায়ী এই টুর্নামেন্টকে আন্তর্জাতিক বলার ক্ষেত্রে কিছুটা খামতি থেকে যায়। কালো দাগ যেমন চাঁদের কলঙ্ক, অনুরূপভাবে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় দল না হওয়ায় এই শিরোপা জয়টা নিষ্কলুষ হতে পারেনি।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা ১৯৯৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অষ্টম সাফ গেমসে। এটা নিয়ে আর কোনো খুতখুতানি ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার এই টুর্নামেন্ট আন্তর্জাতিক মাপে খুব বড় কিছু নয়। তারপরও এই শিরোপার জন্য ফুটবল প্রিয় একটি জাতির ছিল কত না অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার শেষ পর্যন্ত অবসান ঘটায় স্বস্তি পাওয়া যায়। অথচ এই টুর্নামেন্টে শুরুটা হয়েছিল দুঃস্বপ্ন দিয়ে। সকালটা দেখে দিনটা কেমন যাবে, সব সময় সেটা বোঝা যায় না। তার অন্যতম দৃষ্টান্ত সেবারের সাফ গেমসে বাংলাদেশের অভিযাত্রা।
মালদ্বীপের কাছে হার দিয়ে শুরু হয় পথ চলা। এর আগে বাংলাদেশ কখনো মালদ্বীপের কাছে হারেনি। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জ্বালিয়ে রাখে আশার আলো। তবে এই ম্যাচে জয় পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। খেলায় গোলের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছেন অধিনায়ক জুয়েল রানা। পেনাল্টি থেকে তাঁর দেওয়া একমাত্র গোলে নির্ধারিত হয় খেলার ভাগ্য। অথচ ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে ভারতের গোয়ায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পর জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দেশের প্রয়োজনে দলের হাল ধরতে রাজি হন।
সেমিফাইনালে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে দিয়ে দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে বাংলাদেশ। বদলি ফুটবলার হিসেবে নেমে গোল করায় বিখ্যাত হয়ে ওঠা শাহাজউদ্দীন টিপু এদিনও দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নামেন। দূরপাল্লার শটে তাঁর দেওয়া গোলে ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। তখনই শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দানা বেঁধে ওঠে। অবশ্য এর আগে চারবার ফাইনালে খেললেও সোনার পদক হয়ে ছিল অধরা 'সোনার হরিণ'। বার বার ফাইনালে যেন কী একটা আড়কাঠ এসে আটকে দিত। এই 'কুফা' থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মন্ত্রটা ভালোই জানতেন বাংলাদেশের কোচ সামির শাকির।
তিনি ছিলেন ইরাকের জাতীয় দল এবং বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা ফুটবলার। বাংলাদেশে খেলার সুবাদে 'কুফা' শব্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও ছিল । সে কারণে হয়তো রপ্ত ছিল 'ঝাড়-ফুঁক'ও। তাছাড়া পাঁচ মাস আগে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের কাছে ০-২ গোলে হেরে যাওয়ার টাটকা স্মৃতি বোধকরি তাঁকে খোঁচাতে থাকে। এরপর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১২ দলের দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে নিজের দলটাকে ঝালিয়ে দেখার ভালো সুযোগ পান। এই টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলে বাংলাদেশ। তারই পরিপ্রক্ষিতে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের সমন্বয়ে তিনি দলটি গড়ে তোলেন। ভারতকে হারিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার পর ফাইনালে তিনি আটঘাট বেঁধে নামেন।
একটি জনগোষ্ঠীর অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাগিদ অনুভব করতে থাকেন। যদিও নানান কারণে বাংলাদেশের শিরোপা জয় নিয়ে একটা সংশয় ছিল। সামির শাকিরের ওপরও অনেকের খুব একটা আস্থা ছিল না। জার্মানির গেরহার্ড স্মিথ, ইরানের নাসের হেজাজী, সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াব, দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যান ইয়াং ক্যাং ছাড়াও জার্মানির অটো ফিস্টারের মতো বিশ্বমানের কোচ যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে আন্ডাররেটেড সামির শাকির কতটা সফল হবেন, সে নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অবাক করে দেন।
৪ অক্টোবর কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ফাইনালে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক নেপাল ছিল শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। রেফারিংসহ সব কিছুই ছিল তাদের অনুকূলে। এই প্রতিকূল অবস্থায় অদম্য বাংলাদেশ সেদিন শিরোপা নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়ে। জয়ের নায়ক ছিলেন পুরো টুর্নামেন্টে জ্বলে উঠতে না পারা আলফাজ আহমেদ। সময়মতোই তিনি বাজিমাত করেন। খেলার প্রথমার্ধে তিনি জয়সূচক গোলটি করেন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সেরা তারকারা যা পারেননি, তা করিয়ে দেখিয়েছেন সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই ঔজ্জ্বল্যহীন ফুটবলাররা।
ফুটবল তো এমনই, কাকে নায়ক আর কাকে খলনায়ক বানাবে, সেটা তো আগেই নির্ধারিত হয় না। এটা নির্ধারিত হয় খেলার মাঠে। তা না হলে এই গেমসেই গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য কিভাবে জিরো থেকে হিরো হয়ে যান? এই দলে তো তাঁর স্থানই ছিল না। আমিনুলের আঙুল ভেঙে যাওয়ায় ফর্মহীন বিপ্লবকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দলে নেওয়া হয়। আর সুযোগ পেয়ে শিরোপা জয়ের অন্যতম নায়ক হয়ে উঠেন তরুণ এই গোলরক্ষক। সেমিফাইনাল আর ফাইনালে তিনি ক্যারিয়ারের সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন।
স্বর্ণজয়ী বাংলাদেশ দলে ছিলেন: মো. পনির, মো. হাসান আল মামুন, জুয়েল রানা (অধিনায়ক), রজনী কান্ত বর্মন, মাসুদ রানা, মতিউর রহমান মুন্না, ইকবাল হোসেন, মনোয়ার হোসেন, সৌরভ মজুমদার রাজু, আলফাজ আহমেদ, মিজানুর রহমান ডন, শাহাজউদ্দিন টিপু, আবুল ফয়সাল আহমেদ, মনোয়ার হোসেন মুন্না, আনোয়ার হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম নজরুল, বিপ্লব ভট্টাচার্য, রেজাউল করিম লিটন, জুলফিকার মাহমুদ মিন্টু, রকিব মেহবুব আপেল।
বাংলাদেশ দলের এই সাফল্যে দেশব্যাপী উৎসবের ঢল নামে। এলাকায় এলাকায় মিছিল করা হয়। উল্লাস প্রকাশ করা হয়। এই সাফল্য ফুটবলের মরা গাঙে খানিকটা যেন জোয়ার নিয়ে আসে। কিন্তু সেই জোয়ার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফুটবলপ্রেম এই জাতির জন্য এটাও বড় বেদনাদায়ক। যদিও নিজের মাঠে ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ২০১০ সালে সাফ গেমসে দ্বিতীয়বার শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রথমবার শিরোপা জয় করে যেভাবে সাড়া জাগিয়েছিল, তেমনটা আর কখনো দৃশ্যমান হয়নি। আর যা হোক, 'প্রথম'-এর সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। আর যে প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে একটি জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা,আবেগ-উচ্ছ্বাস, চাওয়া-পাওয়ার মেলবন্ধন।
একনজরে সাফ গেমস ফুটবলে বাংলাদেশ
প্রথম রাউন্ড
বাংলাদেশ ১ (জুয়েল রানা) : মালদ্বীপ ২ (শাহিন, নিজাম)
বাংলাদেশ ১ (জুয়েল রানা) : শ্রীলংকা ০
সেমিফাইনাল
বাংলাদেশ ১ (শাহাজউদ্দিন টিপু) : ভারত ০
ফাইনাল
বাংলাদেশ ১ (আলফাজ আহমেদ) : নেপাল ০