স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৩৪
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্মরণীয় অভিষেক
দুলাল মাহমুদ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করাটাই ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় এক মাইলফলক। আর বিশ্বকাপ অভিষেকেই স্কটল্যান্ড ও সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ চমকে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ সেই গৌরবগাথা।
বিশ্বকাপ বললে চোখের সামনে ভেসে উঠত বিশাল এক জগত। যে জগতের কোনো সীমা নেই। পরিসীমা নেই। যেন তেপান্তরের মাঠ। সেখানে কোথায় বাংলাদেশের অবস্থান? আর এমনটি মনে হতো কোনো খেলার বিশ্ব আসর বসলে। বাংলাদেশ কখনো কোনো বিশ্ব আসরের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে, এমনটা কল্পনায় ছবি আঁকলেও বাস্তব যে বহু দূর, সেটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আমাদের স্বপ্নকে সত্যি করে দেয় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। যদিও ক্রিকেট বিশ্বকাপের সীমানা খুব বেশি বিস্তৃত নয়। তারপরও বিশ্বকাপ বলে কথা! ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে জয়ী হলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। সেই থেকে চলতে থাকে বিশ্বকাপ নিয়ে ক্ষণগণনা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে, এটা ক্রীড়ানুরাগীদের কাছে ছিল পরম এক বিস্ময়। সেই বিস্ময়টা যখন সত্যি হয়ে যায়, তা নিয়ে চলে অন্তহীন জল্পনা-কল্পনা।
তার বছর দুয়েক আগেও ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের কুলমর্যাদা ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন রীতিমতো অপাংক্তেয়। এলিট ঘরানার সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব। অনেকটা বুর্জোয়া আর সর্বহারা শ্রেণির মধ্যকার বিভাজনের মতো। মাঝে-মধ্যে অভিজাত ঘরানার কোনো ক্রিকেটারের দেখা পেলে বা দেশের সঙ্গে খেলা হলে বর্তে যায় এ দেশের ক্রিকেটানুরাগীরা। তখন স্বপ্নের সীমানা খুব একটা বিস্তৃত ছিল না। ক্রিকেটের মাতৃভূমি ইংল্যান্ড ছাড়া এশিয়ার বাইরে যাওয়া বা বিশ্ব পরিসরের কোনো টুর্নামেন্টে খেলার কথা কজনই বা ভাবতে পারতেন?
আর বিশ্বকাপ তো অনেক দূরের পথ। অনেকটা চন্দ্র বিজয়ের মতো মনে হতো। সে তো কেবল টেলিভিশনের পর্দায় ঝলমলে করত। ভিন দেশ ও তাদের ক্রিকেটাররা হয়ে উঠতো মাতামাতির উপলক্ষ। আর বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দিত একরাশ দীর্ঘশ্বাস। বাংলাদেশ কি কখনও বিশ্বকাপ খেলতে পারবে? এমন ভাবনা রীতিমতো পাগলের প্রলাপ বলে মনে হতো। মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। তবে এটাও তো জানা কথা, ইচ্ছা, আন্তরিকতা ও উৎসর্গীকৃত মনোভাব থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা কঠিন হয় না।
আইসিসি ট্রফি নামক ক্রিকেটীয় এক বিপ্লবের মাধ্যমে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। উম্মুক্ত হয়ে যায় ক্রিকেট দুনিয়া। পূরণ হয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন। এই দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এটা এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বকাপ শব্দটার মধ্যে ছড়িয়ে থাকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সারা শরীরে শিহরণের ঢেউ তোলে। সেই ঢেউয়ে দোল খায় ক্রিকেটানুরাগীরা। অবশ্য শুধু ক্রিকেটানুরাগীরা লেখা ঠিক হলো না। এর আগে তো বাংলাদেশ কোনো খেলার বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায়নি। এমন এক অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বেলিত হয় দেশের তাবৎ ক্রীড়া অনুরক্তরা। রুদ্ধশ্বাসে গুনতে থাকেন অপেক্ষার প্রহর। একটা সময় অপেক্ষার উত্তেজনার অবসান ঘটে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অভিষেকে বাংলাদেশ চমকপ্রদ কিছু করবে, এমনটা কেউ প্রত্যাশা করেনি। ক্রিকেট বিশ্বে তো বটেই পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ নামটি উদ্ভাসিত হবে, এটাই ছিল অনেক বড় পাওয়া।
দুই বছরের অপেক্ষার পর ঘনিয়ে আসে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৪ মে ২০ জুন পর্যন্ত সপ্তম এই বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস আর ওয়েলস। স্বপ্নের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে কারা খেলবেন, তা নিয়ে কৌতূহল সঞ্চার হয়। বিশ্বকাপে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে ক্রিকেট ইতিহাসের অংশীদার হওয়া। জীবনব্যাপী গৌরব করার উপলক্ষ। দল ঘোষণার পর বিতর্ক ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর বাদ পড়াটা ক্রিকেটানুরাগীরা মেনে নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে দলভুক্ত করা হয় নান্নুকে।
আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে দলে ছিলেন আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, ফারুক আহমেদ, এনামুল হক মণি, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, মােহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হােসেন শান্ত, মঞ্জুরুল ইসলাম, শফিউদ্দিন বাবু, নিয়ামুল রশিদ রাহুল, নাইমুর রহমান দুর্জয়, শাহরিয়ার হােসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হােসেন অপি।
'বি' গ্রুপে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানের সঙ্গী হয় বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ড ছাড়া শক্তির দিক দিয়ে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ছিল দুস্তর ব্যবধান। সেক্ষেত্রে অভিষেক বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল, এমনটা ভাবার কারণ ছিল না। বাংলাদেশ নামটি অন্তত ক্রিকেট বিশ্বে আলোচিত হবে, বিশ্ব মঞ্চে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, সেটাই ছিল অনেক বড় পাওয়া। সাধারণত নেতিবাচক কারণে শিরোনাম হওয়া দেশটির ক্রিকেটের মাধ্যমে সম্মানজনক উত্তরণ ঘটবে, সেটা তো কম গৌরবের নয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ শূন্য হাতে ফিরে আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। অন্তত স্কটল্যান্ডকে হারানোর পাশাপাশি প্রতিটি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ লড়াকু মেজাজে খেলে নিজেদের টাইগার পরিচয়কে তুলে ধরবে, কার্যত এমনটাই ছিল চাওয়া। সত্যি বলতে এর বেশি চাওয়ার সাহস ছিল না।
কখনো কখনো প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায় বাস্তবতা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের 'মুখভাত' করেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে উদ্বোধনী এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযাত্রা। তাতে 'বিদ্যুৎস্পৃষ্ট' হয় সমগ্র বাঙালি সমাজ। তারপর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল রোমাঞ্চকর। একমাত্র স্কটল্যান্ডকে হারানোর সংকল্প ছিল বাংলাদেশের। আইসিসি ট্রফিতে ইউরোপীয় এই দলটিকে হারিয়েই বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়।
আইসিসি ট্রফি পরবর্তী সময়ে শক্তি বৃদ্ধি করে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া এই দলটি সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না। তার ওপর বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলেছিল তারা এডিনবরায় নিজেদের মাঠে। ব্যাটিং করতে নেমে ২৬ রানেই ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। এই চাপ সইতে না পারায় ঢাকায় একজন টিভি দর্শকের দম চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর দৃঢ়তায় সম্মান রক্ষা পেয়েছিল। প্রতিপক্ষকে ২২ রানে হারিয়ে ২৪ মে বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যে কোনো প্রথমই ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে। এই জয়ও দীপ্তিমান হয়ে আছে।
বলা যায়, স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশের জয়ের 'কোটা' পূরণ হয়ে যায়। তবে সামনে পরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের জন্য। ৩১ মে নর্দাম্পটনে বিশ্বকাপকে কাঁপিয়ে দেয় টাইগাররা। এক বিশ্বকাপ আগেই শিরোপা জেতা পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। অথচ এই ম্যাচের দিন বরখাস্ত করা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার নায়ক কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ডন গ্রিনিজকে। তাতে করে দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেবে, এর পক্ষে বাজি ধরার মতো নিশ্চিত করে বলা যায়, কেউ অন্তত ছিলেন না। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে কোনো কিছু নিশ্চিত নয়। তাই বলে ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বে সাঈদ আনোয়ার, শহীদ আফ্রিদি, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম-উল-হক, সেলিম মালিক, আজহার মাহমুদ, মঈন খান, সাকলায়েন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার সমৃদ্ধ সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে সেবারই বিশ্বকাপে অভিষিক্ত বাংলাদেশ!
এটাকে কী বলা যায়? গৌরবময় অনিশ্চয়তা? নাকি অনিশ্চয়তার গৌরবময়তা। তাও ২২৪ রানের টার্গেট দিয়ে ৬২ রানে হারানো! এ যেন ক্রিকেটীয় এক রূপকথা। খেলার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। তবে পাকিস্তানের এক একটা উইকেটের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্পন্দিত হয়েছে পুরো দেশ। সেই উল্লাসের প্রতিধ্বনি হয়েছে বহু দূর পর্যন্ত। প্রায় মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে এই জয় নিশ্চিত হওয়ার পর আনন্দ-উল্লাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ।
রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে কোলাহলমুখর হয়ে উঠে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সেই মধ্যরাতে উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য স্বতস্ফূর্তভাবে মানুষ ঘরের বাইরে নেমে আসেন। যে যেভাবে ছিলেন, সেই অবস্থায় বের হয়েছেন। অনেকের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। ঢাক-ঢোলক, তবলা, থালা-বাসন হয়ে উঠে আনন্দ প্রকাশের উপকরণ। রাজপথ থেকে গলিপথ মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়। পটকা আর আতশবাজিতে কম্পিত হয় পুরো দেশ। হাজার হাজার মানুষের কোরাসকণ্ঠে ধ্বনিত হয় 'বাংলাদেশ' 'বাংলাদেশ'।
এর আগে এমন আবেগময় আর আনন্দময় রাত আর কখনও আসেনি। শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারানো অবশ্যই বড় একটা ঘটনা। তবে রাজনৈতিক কারণে এই বিজয়ের মহিমা ও মাহাত্ম্য ছিল অনেক বেশি। এই বিজয়কে উদযাপন করার অংশ হিসেবে পরের দিন দেশে অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করা হয়। দেশে ফেরার পর ক্রিকেটারদের দেওয়া হয় রাজকীয় সংবর্ধনা।
পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছিল বাংলাদেশ। আর সেই পাকিস্তানকে ক্রিকেট মাঠে হারিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট মানচিত্রে পায় গৌরবের ঠিকানা। বোধ করি সেদিনই বাংলাদেশের ক্রিকেটের গৌরবময় ভবিষ্যৎ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। আর এই সাফল্যের পথ বেয়ে টেস্ট স্টাটাসের পথে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।