স্লিপ ফিল্ডিংয়ে অস্ট্রেলিয়া কেন সেরা, কীভাবে সেরা
উৎপলশুভ্রডটকম
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
ক্রিকেটে ফিল্ডিং পজিশন তো কতই আছে, তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সম্ভবত স্লিপই। সেই স্লিপ ক্যাচিংয়ে যুগের পর যুগ শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। জন্ম দিয়েছে অসাধারণ সব স্লিপ ফিল্ডারের। আধুনিক যুগের মার্ক ওয়াহ, মার্ক টেলর, শেন ওয়ার্নের আগে ইয়ান চ্যাপেল, এরও আগে ববি সিম্পসন..আরও কম নাম। স্লিপ ফিল্ডিংয়ের অস্ট্রেলিয়ান মেথড নিয়ে এই লেখা। যাতে জানা যাবে ইয়ান চ্যাপেলের চোখে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সেরা স্লিপ ফিল্ডারের নামও।
'আপনি ক্যাচ ধরার চেষ্টা করবেন না, বরং বলকে আপনাকে খুঁজে নিতে দিন।'
কথাটি বলেছিলেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার মার্ক ওয়াহ। চোখের প্রশান্তি ব্যাটিংয়ের জন্য দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন, তবে মার্ক ওয়াহ সবার মনে আছেন স্লিপে দাঁড়িয়ে ধরা তাঁর অসাধারণ সব ক্যাচের জন্যও। আদতে ক্রিকেট মাঠের নানা ফিল্ডিং পজিশনের মধ্যে স্লিপই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হালের ধুমধাড়াক্কা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে স্লিপের গুরুত্ব অনেকটাই কম, তবে টেস্ট ক্রিকেটে এখনো সাফল্যের পূর্বশর্ত দারুণ সব স্লিপ ফিল্ডার। দলের সবচেয়ে দুর্দান্ত, সজাগ দৃষ্টি সম্পন্ন ফিল্ডারের জায়গা হয় উইকেটরক্ষকের পাশে; এক,দুই, তিন… করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ব্যূহদ্বারে। ক্রিকেট ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়া দলের সেরা ক’জন ফিল্ডারের কাছে স্লিপে ফিল্ডিং করা কিংবা ক্যাচ ধরার দর্শনটা একবারেই আলাদা, বিশ্বের বাকি ফিল্ডারদের মতো হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল ধরার চেষ্টা করেননি তাঁদের কেউই। প্রশ্নটা হচ্ছে, স্লিপে দুর্দান্ত হয়ে ওঠা এই সব ফিল্ডারদের দর্শনটা আসলে কী?
ক্রিকেটে ব্যাটের কানায় লেগে হুট করে আসা বলটা যেকোনো এক পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ নেওয়াটা আসলে একটা শিল্প। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক এবং পরে কোচিংয়ে আসা ড্যারেন বেরির শরণাপন্ন হওয়া যাক। মার্ক ওয়াহ সম্পর্কে যিনি বলছেন, 'যখন ব্যাটের প্রান্ত বা নিচের অংশ ছুঁয়ে বল স্লিপের দিকে আসত, মার্ক নিজেকে বলের লাইনের পেছনে নিয়ে যেত। এমনভাবে হাত দুটোকে স্থির রাখত, যেন সে তীব্র গতি থেকে উৎসারিত বলের সব শক্তি শুষে নিচ্ছে। এতটাই অনায়াসে মার্ক এ কাজটি করত যেন কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কোনো আতঙ্ক নেই।'
বেরির মতে, 'কোনো সন্দেহ নেই যে, স্লিপের ফিল্ডারকে তার দিকে ছুটে আসা ১৫৬ গ্রামের চামড়ার বলকে ধরতে হলে মনোসংযোগ সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ হলো টেকনিক, যেটা মার্ক ওয়াহকে বাকিদের চেয়ে অনেক আলাদা করে দিত।'
হাত ও চোখের অসাধারণ সমন্বয়, হাতকে নরম রেখে বলকে ভেতরের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করা এবং দুই পায়ে চমৎকার ভারসাম্য বজায় রেখে শরীরের দুই পাশে প্রয়োজন মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষিপ্রতা...এসব গুণাবলিই মার্ক ওয়াহর স্লিপ ফিল্ডিংকে নিখুঁত করেছে। বেরির কাছ থেকেই জানা যাচ্ছে, স্লিপে ফিল্ডিং করার জন্য মার্কের সবচেয়ে কৌশলী পরামর্শ ছিল, বলের দিকে হাত এগিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বলকে নিজের কাছে আসতে দেওয়া। সম্ভবত এই দর্শনই স্লিপের মতো জায়গায় ধীরস্থির ফিল্ডিংয়ে এগিয়ে রাখত তাঁকে।
স্লিপে দাঁড়ানো অধিকাংশ ফিল্ডার কান পেতে থাকেন, কখন বোলারের হাত থেকে বেরোনো বলটা ব্যাটের পাশ ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই শব্দের দিকে। প্রায়শই এতে হাত ও চোখের সমন্বয় ঠিকঠাক করতে না পেরে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ফেলে দেন ফিল্ডাররা। তবে মার্ক ওয়াহ ছিলেন ব্যতিক্রম; শান্তভাবে বলের লাইনে গিয়ে নরম তালুতে বল ধরার অনন্য কৌশলেই অনেক চ্যালেঞ্জিং ক্যাচ বা হাফ চান্সকে রুটিন ক্যাচে পরিণত করেছেন তিনি।
স্লিপে উবু হয়ে দাঁড়াতে হয়। এভাবে শরীর নিচু করে ফিল্ডিং করার সময় শরীরের নিচের অংশে ভূমির সাপেক্ষে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কেন্দ্রবিন্দু (সেন্টার অব গ্র্যাভিটি) রয়েছে, সেই বাধা দূর করে আড়াআড়ি আসা দ্রুতগতির বলের ওপর লক্ষ রেখে সেই দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে মার্ক ওয়াহর মতো দক্ষ স্লিপ ফিল্ডাররা সেই ‘লোয়ার সেন্টার অব গ্র্যাভিটির’ চ্যালেঞ্জকে কমিয়ে আনতে শরীরকে সংকুচিত করে দাঁড়াতেন। এর পেছনে যুক্তি ছিল, যেহেতু পুরো শরীরের ভার থাকে দুই পায়ের ওপর এবং পা দুটি মাধ্যাকর্ষণ বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশের উপর দাঁড়িয়ে থাকে; তাই সেই বলয়-প্রভাব কাটিয়ে পা-সহ পুরো শরীরকে বলের লাইনে নিয়ে ক্যাচ ধরার জন্য শরীরকে স্প্রিংয়ের মত সংকুচিত করে দ্রুত দুই পাশে লাফ দেওয়ার জন্য এই শরীর সংকোচন করে দাঁড়ানোটা খুব কাজে আসে। তবে এক্ষেত্রে নিজের ফিল্ডিংয়ের জায়গা তুলনামূলক সংকুচিত হয়ে পড়ে, এ জন্যে ফিল্ডারের ঠিক সামনেই আসা কিংবা হুট করে মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বলগুলো ধরতে ফিল্ডারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেই হবে।
শুধু মার্ক ওয়াহই নন, অস্ট্রেলিয়া দলে স্লিপে ফিল্ডিং করা অনেকেই এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মার্ক ওয়াহর পূর্বসুরি ববি সিম্পসন ও ইয়ান চ্যাপেল বা সমসাময়িক মার্ক টেলর, শেন ওয়ার্নেরাও এভাবেই মধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাটাতে শরীর সংকোচনে জোর দিতেন। তবে এটা অনুসরণ করা সহজ নয় সবার জন্য। সহজ হোক বা চ্যালেঞ্জিং ক্যাচ, হাতের তালুকে মাখনের মতো নরম রেখে দারুণ সব ক্যাচ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট রিফ্লেক্স এবং মনোযোগ ধরে রাখার জন্য একাগ্রতা থাকা জরুরি। ঠিক এই জায়গায় বাকিদের চেয়ে আলাদা ছিলেন মার্ক ওয়াহ। শুধুমাত্র স্লিপ ক্যাচিংয়ের পেছনে প্র্যাকটিস সেশনে অনেক সময় ব্যয় করতেন তিনি। তাই তো ব্যাটের প্রান্ত ছুঁয়ে মার্কের দিকে বল যাওয়া মানেই দলের বাকিরা ধরে নিতেন যে, বোলার তাঁর কাঙ্ক্ষিত উইকেট পেতে যাচ্ছেন।
ইয়ান চ্যাপেল অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলের স্লিপ ফিল্ডারদের (মার্ক ওয়াহ, মার্ক টেলর, শেন ওয়ার্ন) ক্যাচগুলো অসাধারণ মনে করলেও তিনি গুণমুগ্ধ ছিলেন বব সিম্পসনের স্লিপ ফিল্ডিংয়ের। পুরো ক্যারিয়ারে মাত্র একটি ক্যাচ হাতছাড়া করা এই অধিনায়ককে নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন ইয়ান চ্যাপেল। স্লিপে ক্যাচ ধরার জন্য নিজের বুক পেতে দিতেন সিম্পসন। তাঁর ক্যাচ ধরায় দক্ষতা অস্ট্রেলীয় নির্বাচকদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, ১৯৫৭-৫৮ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে সিম্পসনকে দলে অন্তভুর্ক্ত করা হয় শুধুমাত্র তাঁর ক্যাচিং দক্ষতার জন্য। তখনকার অস্ট্রেলিয়া দলের মূল দুই বোলার ছিলেন অ্যালান ডেভিডসন ও রিচি বেনো। ডেভিডসন বাঁহাতি পেসার, বেনো লেগ স্পিনার। দুজনই তাই বল ডান হাতি ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে বল বের করে নিয়ে যেতেন। তাঁদের সাফল্যের জন্য ভালো স্লিপ ফিল্ডার তাই লাগতই। ম্যাচে উইকেটরক্ষকের পাশে প্রথম স্লিপে সিম্পসন ছিলেন তাই অপরিহার্য।
ফাস্ট বোলারদের বোলিংয়ের সময় বর্তমানে প্রথম স্লিপের ফিল্ডাররা যেমন একটু সামনের দিকে দাঁড়ান, সিম্পসন সেটা করতেন না। উইকেটরক্ষকের চেয়ে বেশ একটু দূরেই দাঁড়াতেন তিনি। অবশ্য এক্ষেত্রে উইকেটরক্ষক ওয়ালি গ্রাউটের সাথে চমৎকার বোঝাপড়া বড় ভূমিকা রাখত। ইয়ান চ্যাপেল সিম্পসনের ক্যাচিং বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, সিম্পসনের ফুটওয়ার্ক ছিল অনবদ্য। নিজের শরীরের ভারসাম্যের চেয়ে পায়ের ক্ষিপ্রতার প্রতি জোর দিতেন তিনি। নিজের ক্ষিপ্রতার প্রতি আত্মবিশ্বাসের কারণেই হয়তো একটু প্রশস্ত জায়গা নিয়ে দাঁড়াতেন। চ্যাপেল দেখতেন, সিম্পসন যেন বলকে নিজের কাছে আসতে দিচ্ছেন, যদিও তা ব্যাটের প্রান্ত ছুঁয়ে সিম্পসনের বেশ দূর দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাঁকে দেখে মনে হতো, যেন পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার মতো করে যেন বলের লাইনে ডুব দিয়ে চমৎকার সব ক্যাচ তুলে আনছেন।
উইকেটরক্ষকের থেকে দূরে দাঁড়ানোর কারণে কোনগুলো তাঁর ক্যাচ, এ নিয়ে সিম্পসনের মনে কোনো দ্বিধা তৈরি হতো না। শুধু বেরিয়ে যাওয়া বলেই না, অফ স্পিন বলেও স্লিপে দুর্দান্ত ছিলেন সিম্পসন। স্লিপ ফিল্ডিংয়ে সেরার ভোটটাও ইয়ান চ্যাপেল তাই ববি সিম্পসনকেই দিচ্ছেন।
* ক্রিকইনফো অবলম্বনে পিনাক রায়।