এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে ফিক্সিংয়ের কথা বলছিলে, যেন...
উৎপল শুভ্র
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
তোমার সাজানো-গোছানো রুমের বিছানায় বসে `তাহলে শুরু করি` বলে তুমি যখন প্রথম কথাটাই বললে, `আমি প্রথম স্পট ফিক্সিং করি ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে`, প্রথমে মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় ভুল শুনেছি। তুমি বলছিলেও এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে, যেন দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ, এমন কিছু জানাচ্ছ।
অ্যাশ, তোমার মনে আছে, ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের আগে তোমাকে কী বলেছিলাম। তুমি তখন এয়ারপোর্টের পথে। সেই সিরিজের দলে তুমি ছিলে না। যাওয়ার কথা ছিল অঙ্কুর একাডেমিতে তোমার সতীর্থ শাহরিয়ার নাফীসের। ধারালো কী একটা দিয়ে ব্যাট পরিষ্কার করার সময় বাঁ হাতের তালু কেটে যাওয়ায় শাহরিয়ারের বদলে তুমি। ফোনে তোমাকে বলেছিলাম, 'এমন ঘটনাচক্রে পাওয়া সুযোগে ক্যারিয়ার বদলে যাওয়ার অনেক ঘটনা আছে ক্রিকেট ইতিহাসে। তুমিও সুযোগটা কাজে লাগাও।'
সেটি তুমি লাগিয়েও ছিলে। টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা যে তোমার হয়নি, সেটি তোমারই দোষে। শুনে মন খারাপ করতে পারো, কখনো কখনো এমন সন্দেহও জাগে, এর মধ্যেও কি অন্য কিছু ছিল! নইলে আগের দিন এমন গোছানো ব্যাটিং করে পরদিন প্রথম বলেই কেন রিভার্স সুইপ করতে যাবে! সেদিন খেলা শেষে মাঠে তোমাকে ধরতে পারিনি। ফোনে যখন ধরলাম, টিম বাসে করে তোমরা হোটেলে ফিরছ। এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করেছ, কিন্তু তোমার কণ্ঠে সেই দুঃখটা ঠিক খুঁজে পাইনি।হয়তো অমূলক সন্দেহই। কিন্তু একবার বিশ্বাস ভেঙে গেলে যে সন্দেহ পিছু তাড়া করতে থাকে। ২০০৭ বিশ্বকাপে গায়ানায় ওই ইনিংস খেলার পর আগের আশরাফুলের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে বলেছিলে, 'আমি আর আগের মতো উইকেট দিয়ে আসি না।' দুই বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাহলে কী করলে? আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে স্টিয়ার করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যাওয়ার পরও কয়েক বল পরে যেন অ্যাকশন রিপ্লে! তুমি পরপর একই 'ভুল' করতে পারো, ফিল্ডার কি তা করবে! যত দূর জানি, নন স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান প্রথমবার বেঁচে যাওয়ার পরই তোমাকে বলেছিল, 'কী করছেন আপনি! স্লিপ আছে, দেখছেন না!! না দেখার কোনোই কারণ ছিল না। তারপরও অমন আত্মহত্যার কী কারণ থাকতে পারে? দর্শক হিসেবে দেখলে তুমি কী মনে করতে, বলো তো?
২০১৩ শ্রীলঙ্কা সফরেই কলম্বোর তাজ সমুদ্র হোটেলে বিলিয়ার্ড রুমের ওই ঘটনাটা তোমার মনে না থাকার কোনো কারণই নেই । তামিম আমাকে দুষ্টুমির সুরেই বলেছিল, 'আচ্ছা, আপনি বিপিএল পছন্দ করেন না কেন? ক্রিকেটাররা টাকা পাক, এটা আপনার ভালো লাগে না?' বিপিএল জাতীয় টুর্নামেন্ট নিয়ে আমার ভয়ের জায়গাটা তামিমকে বুঝিয়ে বলছিলাম। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে বেশির ভাগ দলের মালিকই ব্যবসায়ী। তা ছাড়া এই জাতীয় টুর্নামেন্টে নানা ধরনের লোক যুক্ত হয়। সবাই যে ক্রিকেট ভালো বেসে, তা নয়। খেলার নৈতিকতাবোধ আর ব্যবসার নৈতিকতাবোধের পার্থক্য বোঝাতে একটা উদাহরণও দিয়েছিলাম, 'যদি শুনি, কোনো ব্যবসায়ী ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ১০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে, খুব অবাক হব না। কিন্তু যদি কোনো দিন শুনি, বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে, এমন অবস্থায়ও আশরাফুল এক লাখ টাকা নিয়ে ইচ্ছা করে মিস ফিল্ডিং করে রান দিয়েছে, আমি তো ওর মুখে থুথু দেব।'
তুমি সামনে ছিলে বলেই কিছু না ভেবেই তোমার নামটা বলে ফেলা। কথাটা শুনে তোমার মুখটা একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছিল। ‘থু থু’ দেওয়ার কথাটা একটু অরুচিকরই হয়ে গেছে ভেবে একটু বিব্রতও হয়েছিলাম। পরে তুমি আমাকে বলেছিলে, 'আপনি আমাকে এ নিয়ে আরও কিছু বললে আমি সেদিনই আপনাকে সব বলে দিতাম।' কথাটা একদমই বিশ্বাস করিনি। বললে তো সেই কবেই বলতে! ফিক্সিংয়ের অন্ধকার জগতের সঙ্গে তোমার পরিচয় তো সেই কত বছর আগে থেকে। মাঝখানে কত সময় কেটেছে তোমার সঙ্গে, কত কথা হয়েছে। কই, বলোনি তো! বললে কখন, যখন বিপিএলে ধরা পড়ার পর শাস্তি কমানোর জন্যই হোক কিংবা অন্তর্দহন...আকসুর কাছে জবানবন্দিতে সব স্বীকার করে এসেছ। যখন জানো, আজ হোক, কাল হোক, তা প্রকাশ পাবেই। হয়তো আমার একটু সাহায্যও আশা করেছিলে বলে ‘সব’ খুলে বলেছিলে।
তোমার বনশ্রীর বাসায় সেই প্রথম যাওয়া। আকসুর কাছে তুমি বিপিএলে ফিক্সিংয়ের কথা স্বীকার করেছ—ঘুম থেকে উঠেই একটি পত্রিকায় খবরটা পড়ে তোমাকে ফোন দিয়েছি, ‘ঘটনা কি সত্যি?’ তুমি বললে, ‘ফোনে কিছু বলব না। আপনি আমার বাসায় আসেন। সব বলব।'
সেই রাতেই যখন তোমার বাসায় যাচ্ছি, কল্পনাও করিনি, কী বিষম চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেবারের বিপিএল যে ফিক্সিংয়ের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেটি তো সাধারণ দর্শকেরও মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ চলে মালিকের খেয়ালখুশিমতো। তুমিও নিশ্চয়ই ফাঁদে পড়ে একটা কিছুতে জড়িয়ে গেছ। আমার সর্বোচ্চ কল্পনা ছিল এ পর্যন্তই। তোমার সাজানো-গোছানো রুমের বিছানায় বসে 'তাহলে শুরু করি' বলে তুমি যখন প্রথম কথাটাই বললে, 'আমি প্রথম স্পট ফিক্সিং করি ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে', প্রথমে মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় ভুল শুনেছি। তুমি বলছিলেও এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে, যেন দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ, এমন কিছু জানাচ্ছ।
তোমার ওয়ানডে-টেস্ট অভিষেক দুটিই দেখেছি মাঠে বসে। অন্ধকার জগতেও তোমার ‘অভিষেকের' ঘটনাটা শুনলাম এত দিনে। আশ্চর্য নির্বিকার ভঙ্গিতে তুমি বলে যাচ্ছিলে, আর আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম। সেই ম্যাচের আগের দিন টিম হোটেলে খালেদ মাহমুদ, মোহাম্মদ রফিক আর খালেদ মাসুদ তোমাকে জাভেদ নামে এক বুকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তোমাকে বলা হয়, পরদিনের ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সময় প্রথম ১৫ ওভারে ৬০ রান করতে পারলে সাড়ে চার লাখ দেওয়া হবে। এটি বলার সময়ও তোমাকে আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক লাগছিল। ওই তিনটি নাম শোনার পর আমাকে চমকে উঠতে দেখে যেন একটু মজাই পেলে।
বিপিএলে কী হয়েছে, সেটির বিস্তারিত পরে বলেছিলে। শ্রীলঙ্কান প্রিমিয়ার লিগেও (এসএলপিএল) করে আসা কুকর্মের কথাও। বিপিএল নিয়ে দেওয়া তোমার জবানবন্দির টুকটাক তত দিনে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অংশটুকু তখন শুধু তুমি আর আকসুর লোকজনই জানে। দ্বিতীয় দিন গভীর রাতে র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিক্সিং নিয়ে দেওয়া জবানবন্দির সময় যে সেখানে বাইরের কেউ ছিল না।
আকসুকে দেওয়া জবানবন্দিটাই তুমি আমাকে হুবহু বলেছিলে। তোমার দাবি সত্যি হলে তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও দুটি স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি ছিল। কীভাবে কী হয়েছিল, সেসবের বিস্তারিতও। ২০০৯ সালের শেষ দিকে খালেদ মাহমুদ তাঁর নিজের বাসায় সুনীল ভাটিয়া নামের এক বুকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তোমাকে। মোহাম্মদ রফিকও ছিলেন সেখানে। কাজ ছিল 'সামান্য'। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে লাঞ্চের পর নির্দিষ্ট তিন ওভারে ৬ রান করতে হবে। দুই ইনিংসেই লাঞ্চের আগে আউট হয়ে গেছ বলে তা করতে পারোনি। কিন্তু সাত লাখ টাকা তো নিয়ে নিয়েছ অলিখিত ওই চুক্তির পরই। সেটি ফেরত দেওয়া নিয়ে নাটকের কথাও বলেছিলে সবিস্তারে। গান্ধী নামে আরেক বুকি দিয়েছিল পরের অ্যাসাইনমেন্টটা। এসএলপিএলে তোমার 'বাড়তি’ উপার্জনটাও এই গান্ধীর সৌজন্যেই। সেই 'অ্যাসাইনমেন্ট' ২০১২ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ ও ৬ ওভার মিলিয়ে ১০ রানের কম করতে হবে। করতে পারলেই ২৫ লাখ টাকা। তাতে সফল হয়ে ওই ২৫ লাখ টাকা থেকেই সুনীল ভাটিয়ার সাত লাখ টাকার দেনা শোধ করেছ। মাধ্যম মোহাম্মদ রফিক।
এসব যখন বলছ, দু-তিনবার আমি বিস্ময়ভরে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘তুমি কি বুঝতে পারছ, তুমি এসব কী বলছ, কাকে বলছ?' তোমাকে একটুও চিন্তিত দেখিনি। আমি লিখব না, শুধুই এই বিশ্বাস থেকে? নাকি শেষের ওই কথাটাই ছিল মূল কারণ, এসব প্রকাশ হওয়ার পর 'অন্য সাংবাদিকদের একটু ম্যানেজ করবেন প্লিজ।' নিজে বলতে লজ্জা পাচ্ছিলে বলে যেটি বলিয়েছিলে সেখানে উপস্থিত তোমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দিয়ে। তোমার বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার পর আমার কান-মাথা সব ঝা ঝা করতে শুরু করেছিল। তোমার মুখেই শুনে এসেছি, তারপরও বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না, তুমি এই কাজ করেছ!
*লেখকের 'এগারো' বই থেকে
চলবে...