বাঘের গর্জন এবং আশার ফুল
উৎপল শুভ্র
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
ব্যাটিং-প্রতিভার কথা উঠলে তোমার সম্পর্কে আমি সব সময় একটা কথাই বলে এসেছি—অ্যাজ গুড অ্যাজ এনিওয়ান। বাংলাদেশ জিতেছে বলে এ দেশের মানুষ এখনো কার্ডিফ মনে রেখেছে, মনে রেখেছে গায়ানা, জোহানেসবার্গ...। কিন্তু নটিংহামের ওই ৯৪-এর মতো, মিরপুরে ওই ২৭ মিনিটে হাফ সেঞ্চুরির মতো আরও কত ইনিংসই তো আছে, যাতে বাংলাদেশ জিততে পারেনি, কিন্তু তুমি ম্যাচ রাঙিয়ে দিয়েছ।
কার্ডিফে জয়ের পর প্রথম আলোর ‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব' শিরোনামটা যেমন বিখ্যাত হয়ে আছে, তেমনি তোমাকে নিয়ে ‘আশার ফুল আশরাফুল'-ও। দুটি শিরোনামের একটাও কিন্তু আমার দেওয়া নয় । কার্ডিফে অমন একটা জয়ের পর আমি লিখেই কূল পাই না, শিরোনাম নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! অফিসে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম, 'আপনারা যা ইচ্ছা একটা কিছু করে দেন ভাই।' সে সময় প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক সানাউল্লাহ ‘যা ইচ্ছা একটা কিছু’ করেননি, এমন এক শিরোনাম করেছিলেন, মানুষ যা এখনো মনে রেখেছে।
'আশার ফুল আশরাফুল' এখন জার্মানপ্রবাসী আমার সাবেক সহকর্মী আশীষ চক্রবর্তীর অমর সৃষ্টি। কলম্বোতে ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরি করে ফেরার পর তোমার মাদারটেকের বাসায় গিয়ে তাঁর নিজেরই করা স্টোরির শিরোনাম। যেটি এক সময় প্রবাদের মতো হয়ে যায়। আশরাফুলের ভালো খেলা যে হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের জয়ের পূর্বশর্ত। হারারে, কার্ডিফ, বগুড়া, গায়ানা, জোহানেসবার্গের স্টেডিয়ামগুলো যার সাক্ষী হয়ে আছে।
'আশরাফুল ভালো খেললেই বাংলাদেশ জেতে'–তোমার নিজেরও খুব পছন্দ ছিল কথাটা। পত্রপত্রিকায় তখন নিয়মিতই তা লেখা হতো। তুমিও সুযোগ পেলেই তা মনে করিয়ে দিতে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ শুরুর আগে তোমার যে একটা বড় ইন্টারভিউ করেছিলাম, মনে আছে? না-ও থাকতে পারে। ইন্টারভিউ কি তোমার একটা-দুটি করেছি নাকি! আমার এটা আলাদাভাবে মনে আছে, কারণ সেই প্রথম ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজি করাতে তোমাকে বেশ সাধ্যসাধনা করতে হয়েছিল। মাত্রই অধিনায়কত্ব হারানোটাই হয়তো কারণ। 'আশরাফুল কী জিনিস' এই সিরিজে সবাইকে তা দেখিয়ে দেওয়ার বাড়তি একটা জেদ আছে কি না, প্রশ্নের উত্তরটা তোমার চরিত্রের সঙ্গে একটু বেমানান রকম উদ্ধতই শুনিয়েছিল। যে ঔদ্ধত্যটা আরও বেশি প্রকাশ পেয়েছিল 'থার্ড পারসনে' কথা বলায়। হুবহু তুলে দিলে যা তোমার মনে পড়তেও পারে, 'মানুষ জানে, আশরাফুল আসলে কী। সবাই জানে, আশরাফুল ভালো খেললে বাংলাদেশ জিতবে। বাংলাদেশ এখনো বড় কোনো টেস্ট ম্যাচ জেতেনি, কারণ আশরাফুল একটাতেও ভালো খেলেনি। আমি হিসাব করে দেখেছি, বাংলাদেশ যতগুলো ক্লোজ টেস্ট ম্যাচ হেরেছে, তার কোনোটাতেই আমার ভালো রান নেই।'
পত্রপত্রিকা নিয়ে তোমার খুব কৌতূহল ছিল। শুধু তোমাকে নিয়েই নয়, কোথায় কাকে নিয়ে কী লেখা হলো, সব ছিল তোমার মুখস্থ। ড্রেসিংরুমে তোমার আর জাভেদ ওমরের প্রিয় 'খেলা' ছিল, পরদিনের পত্রিকায় সম্ভাব্য হেডলাইন অনুমান করা। অনেক সময় নিজেই সেটির জোগান দিয়ে দিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওই ইন্টারভিউয়ের শিরোনাম নিয়ে যেমন আমাকে একটুও ভাবতে হয়নি। বাংলাদেশ হারলেই চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনার তির নিয়ে হঠাই বলে ফেললে, "আমরা জিতলে সবাই জেতে, হারলে শুধু আমরাই হারি।” যা শুনে আমার আহমদ ছফার অমর সেই বাণীর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ছফার কথাটা ছিল উল্টো অর্থে। নানা বিচ্যুতির পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী মানুষের আর কোনো ভরসার জায়গা নেই বোঝাতে গিয়ে যিনি বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগ যখন জেতে, তখন একাই জেতে যখন হারে পুরো বাংলাদেশ হারে। তোমার ওই কথাটা আহমদ ছফায় প্রভাবিত বলে ভাবার কোনো কারণই দেখিনি। নামটা তোমার আদৌ পরিচিত কি না, সন্দেহ। ক্রিকেট, শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ ছিল তোমার জীবন। এর বাইরের বিস্তীর্ণ দুনিয়ার সঙ্গে তোমার কোনো পরিচয়ই ছিল না। তোমার পরিণতির কথা ভাবলে কখনো কখনো মনে হয়, এটিরও কি কোনো ভূমিকা ছিল এতে!
অন্য কিছুর খোঁজখবর রাখো বা না রাখো, ব্যাটিং-প্রতিভার কথা উঠলে তোমার সম্পর্কে আমি সব সময় একটা কথাই বলে এসেছি—অ্যাজ গুড অ্যাজ এনিওয়ান। বাংলাদেশ জিতেছে বলে এ দেশের মানুষ এখনো কার্ডিফ মনে রেখেছে, মনে রেখেছে গায়ানা, জোহানেসবার্গ...। কিন্তু নটিংহামের ওই ৯৪-এর মতো, মিরপুরে ওই ২৭ মিনিটে হাফ সেঞ্চুরির মতো আরও কত ইনিংসই তো আছে, যাতে বাংলাদেশ জিততে পারেনি, কিন্তু তুমি ম্যাচ রাঙিয়ে দিয়েছ। তিন বছর পর চট্টগ্রামে তোমার দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরিই যেমন। ঘটনা সেই প্রথম সেঞ্চুরির মতোই। বাংলাদেশ ইনিংস ও ৮৩ রানে হেরেছে, অথচ ম্যান অব দ্য ম্যাচ তুমি! কলম্বোর মতো এখানে তোমার সঙ্গে কোনো ‘মুরালি'-ও নেই।
রাহুল দ্রাবিড় ১৬০ রান করেছেন সে টেস্টে, কিন্তু তোমার অপরাজিত ১৫৮ বানের ছটায় সেটি রীতিমতো অদৃশ্য। যে সুনীল গাভাস্কার নিজে ১২৫টি টেস্ট খেলেছেন, দেখেছেন আরও কত, টিভিতে হাইলাইটস দেখানোর সময় তিনি বলে দিলেন, 'এটা আমার দেখা সেরা টেস্ট ইনিংসের একটি।' সে টেস্টে ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর কণ্ঠে যেন মাস আটেক আগে হারারেতে বলা হোয়াটমোরের কথার প্রতিধ্বনি, “কি ফ্রন্ট ফুট, কি ব্যাক ফুট, কি অন সাইড, কি অফ সাইড—সবকিছুতেই ও ছিল দুর্দান্ত। অসাধারণ এক প্রতিভা। বাংলাদেশকে ও অনেক কিছু দেবে।'
কিছু তো দিয়েছই, আরও কেন দিতে পারোনি, আমরা সবাই হন্যে হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। তুমি তো উত্তরটা জানো, তাই না অ্যাশ? সেই টেস্টের পর ভারতীয় এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। টেন্ডুলকারের খুব ঘনিষ্ঠ মুম্বাইয়ের ওই সাংবাদিক এখনো দেখা হলে ওই ইনিংসটির কথা তোলেন। তোমাকে দেখে তাঁর নাকি অরবিন্দ ডি সিলভার কথা মনে পড়ছিল। আমার বেশি মনে পড়ে, তোমার শেষ ৯৬ রান। তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর যেন দৈবশক্তি ভর করেছিল তোমার ব্যাটে। ৬২ রান নিয়ে নেমেছিলে, সেখান থেকে সেঞ্চুরিতে যেতে খেললে মাত্র ২৫ বল। ৭৬ থেকে ধরলে তো মাত্র ৭ বলে। ইরফান পাঠানকে পরপর তিন বলে চার, ৯২ রানে রিভার্স সুইপ খেলার দুঃসাহস। বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ১৫০-ও তো দারুণ স্টাইলে, জহির খানকে পরপর ৩টি চারে। সঙ্গী পেলে আর কী করতে, কে জানে! ডেভ হোয়াটমোর দুটি কথাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তোমার সেই ইনিংসের মহিমা, ‘এই ইনিংস ক্লাসের এক প্রদর্শনী । ওর ব্যাট থেকে ছিটকে বেরোচ্ছিল আত্মবিশ্বাসের ছটা।'
২০০৪ সালটায় টেস্ট ক্রিকেটে তোমার ব্যাট অনেকবারই হেসেছে। চট্টগ্রামে ওই 'এপিক'-এর আগে ঢাকায় সিরিজের প্রথম টেস্টেও অপরাজিত ৬০। এর আগে হারারেতে ওই ৯৮, সেন্ট লুসিয়ায় ৮১, ঢাকায় নিউজিল্যান্ড আর ভেট্টোরির বিপক্ষে বাজে এক উইকেটে ৬৭, ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যেখানে ২৩।
ব্যাটিংয়ে মন রাঙানোর কথা বললে ২০০৭ সালে অকল্যান্ডে তোমার ৫৭ বলে ৭০ রানও সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে কীভাবে ভুলে গেলে! ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কথাও মনে পড়ে যায়। 'মন রাঙানো' কথাটাই ছিল তাঁর মুগ্ধ প্রতিক্রিয়ায়, 'দর্শকের মন রাঙিয়ে দেওয়ার মতো এক ইনিংস। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েও আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। ম্যাককালামের সঙ্গে আল কথা বলেছিলাম। এর আগেই আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ড্যানিয়েল ভেটেরি বলে গেছেন, "ভালো বলেও চার-ছয় মারার এই ক্ষমতা বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বেশি ব্যাটসম্যানের নেই।'
(লেখকের 'এগারো' বই থেকে)
চলবে...