`মধ্যদুপুরে আশরাফুল যেন মায়াবী বিভ্রম`
উৎপল শুভ্র
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগের দিন মাকে ফোনে প্রায় কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছ, `মা, আমি তো পারছি না।` মা কি অত খেলা বোঝেন, তিনি সমস্যার কারণটা তাঁর মতো করে বের করে বলেছেন, `পারবি কী করে! ওরা সবাই কত বড় বড়, আর তুই কত ছোট!`
প্রিয় আশরাফুল,
রেকর্ড গড়া ওই সেঞ্চুরিই যথেষ্ট ছিল, জীবনের প্রথম টেস্টেই এই মুরালি-রহস্য ভেদ করাটা তোমাকে আরও আলাদা করে দিয়েছিল। সাগর নামের অখ্যাত এক কিশোরকে বিখ্যাতও বানিয়ে দিয়েছিলে তুমি। ওই সাগর নাকি ‘দুসরা’ করতে পারত। একাডেমিতে ওর উল্টা স্পিন খেলে খেলে তোমার নাকি মুরালিকে কোনো ব্যাপারই মনে হয়নি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তখন খুব ঘন ঘন খেলা হতো বাংলাদেশের। মুরালিকে ‘ডিকোড' করতে দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যানরা তোমার শরণাপন্ন হতো। তুমি তাতে যারপরনাই মজা পেতে। মুরালিকে খেলতে অন্যদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, আর তুমি একদিন আমাকে হাসতে হাসতে বললে, 'মুরালিকে খেলতে আমার খুব মজা লাগে। আমি ওর জারিজুরি সব বুঝে ফেলি বলে খুব রেগে যায়।'
সেই রাগ মাঠের গালাগালি থেকে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত গড়িয়েছে শুনে আরও বেশি মজা পেয়েছিলে। অ্যাশ, মনে পড়ছে তোমার? সেই যে ২০০৭ সালে অধিনায়ক হিসেবে তোমার প্রথম সফর। দ্বিতীয় টেস্টেই দুর্দান্ত একটা সেঞ্চুরি করলে। সেদিন যেভাবে খেলছিলে, তাতে মুশফিকের মতো আর কেউ তোমাকে সঙ্গ দিতে পারলে তোমার অপরাজিত ১২৯ রানের সেঞ্চুরিটা আরও অনেক বড় হতে পারত।
ক্যান্ডিতে সেই সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টেস্ট। ৭০০তম উইকেট পেয়ে ফুরফুরে মেজাজে সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন মুরালি। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উইজডেন অ্যালম্যানাকটাতে অটোগ্রাফ চাওয়ায় আরও খুশি। অটোগ্রাফ দিতে দিতে কী একটা রসিকতা করে সবাইকে হাসালেনও। হাসিখুশি পরিবেশে হঠাৎই ছন্দপতন হলো তোমাকে নিয়ে করা একটা প্রশ্নে। ‘আশরাফুল তো আপনাকে খুব ভালো খেলে’ জাতীয় প্রশ্নটা আমিই করেছিলাম, নাকি অন্য কেউ, ঠিক মনে নেই। নামটা শুনেই যেন বিস্ফোরিত হলেন মুরালি। প্রচণ্ড শ্লেষের সুরে বললেন, 'আশরাফুল ভালো ব্যাটসম্যান। আমাদের বিপক্ষে ৩টি সেঞ্চুরিও আছে ওর। কিন্তু আমাকে বলুন তো, টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হয়েও ওর অ্যাভারেজ কেন ২২? আমাদের দলের ভাসেরও তো একই রকম অ্যাভারেজ।'
তোমাকে তো বলেছিলাম ঘটনাটা। হাসতে হাসতে চোখে প্রায় পানি চলে এসেছিল তোমার। একটু পরই অবশ্য মুখটা কালো বানিয়ে বলেছিলে, 'টিভিতে যখন অ্যাভারেজটা দেখায়, আমারও খুব লজ্জা লাগে।'
এই অ্যাভারেজের কথা বলেছিলে কার্ডিফে সেই বিখ্যাত সেঞ্চুরির পরও, 'ম্যাচের আগের দিন টিভিতে দেখাচ্ছিল, আমার অ্যাভারেজ মাত্র ১৯। খুব খারাপ লেগেছিল, আমি কি এতই খারাপ ব্যাটসম্যান!' মাত্র '১৯' অ্যাভারেজের সেই তুমিই সে সময়ের অজেয় অস্ট্রেলিয়াকে প্রায় একাই হারিয়ে দিয়েছ। অমন একটা সেঞ্চুরির পর তোমার উচ্ছ্বাসটা স্বাভাবিকই ছিল। আমার কিন্তু একটু ভয় হচ্ছিল, এই আবেগের ঢেউ তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কি না! ভয়টাকে সত্যি বানিয়ে পরের বলেই আউট হয়ে গেলে। রফিক আর আফতাব মিলে ফিনিশিং টাচটা না দিতে পারলে যা তোমার চিরকালীন দুঃখ হয়ে থাকত।
কেমন ছিল তোমার সেই সেঞ্চুরি? হকচকিত অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক রিকি পন্টিংই সেটি বলে দিয়েছিলেন, 'এই উইকেটে ১০০ বলে ১০০—এটাই তো বলে দিচ্ছে সব। অবিশ্বাস্য এক ইনিংস!' ম্যাচ শেষে স্কাই স্পোর্টস ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে একটা জরিপ করেছিল। ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল তোমার বাক্সে। বাকি ৪ শতাংশ নিয়ে পরদিনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ছাপা হওয়া লাইনটা এখনো মনে আছে, ‘এই হলো গণতন্ত্রের সমস্যা'।
আন্তর্জাতিক ম্যাচেও তখন এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না—এত সব বিধিনিষেধ ছিল না। ম্যাচ শেষে সরাসরি মাঠে নেমে গেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যাকে সামনে পাচ্ছি, তারই প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছি। প্রেসবক্সে ফিরে দেখি টেপ রেকর্ডারে কিচ্ছু নেই। উত্তেজনায় রেকর্ডিং বাটনটাই যে টিপতে ভুলে গেছি। ডেডলাইন তখন এমনই তাড়া দিচ্ছে যে, রেকর্ডিং হলেও তা শোনার সময় হতো কি না সন্দেহ। স্মৃতির ওপর ভরসা করেই তাই ঝড় তুলতে হলো ল্যাপটপের কি-বোর্ডে।
মাঠে তোমাকে ঘিরে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ভিড় থেকে তোমাকে একটু আলাদা করে নিয়েছিলাম। পরের দিন আমার পত্রিকার এক্সক্লুসিভ হয়ে যাওয়া সেই কথাটা তখনই বলেছিলে, যেটি লেখার সময় আমার গলায় একটা দলা পাকিয়ে গিয়েছিল।
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে আগের ম্যাচে ওভালের ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে প্রথম বলেই আউট হয়েছ। এর আগে টেস্ট সিরিজে এমনই বাজে খেলেছ যে তোমাকে সব সময় আগলে রাখা ‘প্রিয় সুমন ভাই' দুদিন তোমার সঙ্গে কথাই বলেনি। সবকিছু মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগের দিন মাকে ফোনে প্রায় কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছ, 'মা, আমি তো পারছি না।'
মা কি অত খেলা বোঝেন, তিনি সমস্যার কারণটা তাঁর মতো করে বের করে বলেছেন, 'পারবি কী করে! ওরা সবাই কত বড় বড়, আর তুই কত ছোট!'
আসল ‘বড়’ ‘বড়’ বোলারদের সঙ্গে তোমার দেখা হলো পরের ম্যাচে। ইংল্যান্ডের চার ফাস্ট বোলারের মধ্যে সবচেয়ে 'ছোট' জন লুইস ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি । বাকি তিনজনের দুজন—স্টিভ হার্মিসন ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ৬ ফুট ৪। ক্রিস ট্রেমলেট ৬ ফুট ৭। অথচ এই ‘দানব’দের কেমন 'বামন'-ই না বানিয়ে ফেললে তুমি! কলিংউডের যে ওভারে ৮৫ থেকে চোখের পলকে ৯৪, সেটিতেই প্যাডল সুইপমতো মারতে গিয়ে বোল্ড। এর আগে ৫১ বলে ওই ৯৪। যাতে ১১টি চার আর ৩টি ছয়। ফ্লিনটফকে ছক্কা মেরে ২১ বলে তোমার ফিফটি। অন্য দুটি ছক্কা হার্মিসনের এক ওভারেই। ট্রেন্ট ব্রিজের প্রেসবক্সে বসে তোমার ইনিংসটা দেখতে দেখতে রিচি বেনোর কমেন্ট্রির ওই লাইনটা মনে পড়ছিল। কোন ব্যাটসম্যানকে যেন এমন বেধড়ক মারতে দেখে বেনো বলেছিলেন, 'জেন্টলম্যান, আপনারা কোনো হাইলাইটস্ দেখছেন না। এটা লাইভ টেলিকাস্টই হচ্ছে।'
ওই ম্যাচে ভিভ রিচার্ডসের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি আর ৫ উইকেটের কীর্তি করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পল কলিংউড। ম্যাচশেষে তাঁর সংবাদ সম্মেলনটার কথা তো তোমাকে বলেছিলাম। যেন কলিংউডের সংবাদ সম্মেলন নয়, তোমাকে নিয়ে কোনো আলোচনা-সভা। প্রায় সব প্রশ্নই যে তোমাকে নিয়ে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে কথাটা কলিংউড বারবার বলেছিলেন, অনুবাদে একটু স্বাধীনতা নিলে সেটি এমন হয়, 'অমন দৈত্যের মতো সব ফাস্ট বোলারকে পিচ্চিটা কী মারটাই না মারল।' অথচ যাঁকে নিয়ে এত কথা, সবাই এত আপ্লুত, একটু আগে শেষ হওয়া ম্যাচটায় তাঁর দল ১৬৮ রানে হেরেছে।
এই অদ্ভুত ক্ষমতাটা তোমার ছিল। ব্যাটের ছটায় ম্যাচের বাকি সবকিছুকে ম্লান বানিয়ে ফেলতে পারতে। ওই যে ২০০৭ সালে ভারতের সঙ্গে মিরপুরের টেস্টটা—ইনিংস ও ২৩৯ রানে শোচনীয়ভাবে হেরেছে বাংলাদেশ। আড়াই দিনের আয়ুও পায়নি যে টেস্ট, সেটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই কিনা পরাজিত এক দলের ব্যাটসম্যানে আচ্ছন্ন! যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়তে, আর তোমার যে আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, পরদিনের প্রথম আলোতে আমার লেখার শিরোনামটা এখনো তোমার মনে থাকলে একটুও অবাক হব না, ‘ঘোর অন্ধকারে আশরাফুলকে মনে হচ্ছে বিভ্রম'।
ম্যাচ রিপোর্টটা শুরুও করেছিলাম এ দিয়েই—'আমরা কি সত্যিই তাঁকে দেখেছি! নাকি পুরোটাই ছিল মধ্যদুপুরে দেখা এক বিভ্রম।' রঞ্জি সম্পর্কে লিখেছিলেন নেভিল কার্ডাস। শূন্য মিরপুর স্টেডিয়ামকে সামনে রেখে এই ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসেও মনে হচ্ছে, সত্যিই কি আমরা মোহাম্মদ আশরাফুলের ওই ইনিংসটি দেখেছি! নাকি পুরোটাই ছিল মধ্যদুপুরের বিভ্রম!
৪৬ মিনিট উইকেটে থেকে ৪১ বলে ৬৭। হায়! কখনো কখনো পরিসংখ্যানকে কী অর্থহীনই না মনে হয়! এর সাধ্য কী বোঝায়, আশরাফুল যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ শুধু আশরাফুলই ছিলেন। যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, এই ম্যাচের বাকি সবকিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়ে সত্যি হয়ে ছিল শুধুই একটা ঘোর । যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, বিশ্বকাপের মায়াবী চশমা খুলে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতায় ফিরে আসার ধাক্কাও আর গায়ে লাগছিল না। যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, এই টেস্টে প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশেরও বিশ্বকে দেখানোর কিছু আছে।
তা এমন কী করেছিলে তুমি যে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাকি সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল! হাফ সেঞ্চুরি করেছিলে মাত্র ২৬ বলে। বলের হিসাবে ক্যালিসের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটি ভাঙতে পারোনি মাত্র দুই বল বেশি লাগায়। কিন্তু তোমার প্রলয় নাচনে ভেঙে খান খান সময়ের হিসাবে ১১৩ বছরের পুরোনো এক রেকর্ড। মাত্র ২৭ মিনিটে ওই হাফ সেঞ্চুরি! চার আর ছয় থেকেই তো ৪৮। ৯ চার আর ২ ছয়ের সেই হাফ সেঞ্চুরি দেখতে দেখতেও মনে ফিরে এসেছিল নটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজ। ইনিংসের পুরোটাই যেন কেটেছেঁটে দেখানো হাইলাইটস!
পরে তোমার মুখেই শুনেছি, পুরস্কার বিতরণীতে রাহুল দ্রাবিড় তোমাকে কী বলেছিলেন। এই ইনিংসটাই তিন-চার ঘণ্টা ধরে খেললে দলের কত উপকার হতো! যা শুনে আমি ভাবছিলাম, জয়-পরাজয়ের যে ব্যবধান, তাতেই-বা কী এমন হাতি-ঘোড়া হতো! দ্রাবিড়ের তো সাধ্যই নেই অমন মনরাঙানো ব্যাটিং করার। তুমি যা করেছ, এটার কি কোনোই মূল্য নেই! জয় পরাজয়ের জন্যই খেলা, আনন্দের জন্যও কি নয়! সেটি তো তোমার চেয়ে বেশি কেউ দিতে পারেনি সেই টেস্টে। এই যে এত বছর পরও মনে গেঁথে আছে তোমার ওই ইনিংসটা, আর দ্রাবিড় যে সেঞ্চুরি করেছিলেন, সেটি মনে পড়ল টেস্টের স্কোরকার্ডটা দেখে।
(*লেখকের 'এগারো' বই থেকে)
চলবে...