দুনিয়া কাঁপানো সেই সেঞ্চুরি এবং জন্মতারিখের ভুল
উৎপল শুভ্র
৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
তুমি কেকটা হাতে নিয়ে বললে, `আজ তো আমার জন্মদিন না, আমার পাসপোর্টের জন্মতারিখটা ভুল। আমার আসল জন্মতারিখ ১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই।` শুনে তো সাদির মুখ চুন। পাসপোর্টের বয়স ধরে তুমি বিশ্ব রেকর্ড করেছ বলে ছাপা হয়ে গেছে তাঁর পত্রিকায়, কী কেলেঙ্কারি! আমি সাদিকে আশ্বস্ত করলাম।
প্রিয় আশরাফুল,
এখন মাঝে মাঝে ভাবি, সিডন্স কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন! নইলে ২০০৮ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝখানে হঠাৎ তোমাকে ক্যাপ্টেনসি থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা কেন বলবেন! কেন পরের বছর ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় আমাকে বারবার বলবেন, ম্যাচ শুরু হলেই তাঁর ভয় লাগতে থাকে। তুমি যদি বোলিং করতে আসো!
আমি অবাক হয়ে বললাম, 'তা সেটি আশরাফুলকে বললেই তো হয়!' সিডন্স অসহায় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, 'অনেকবারই বলেছি। ও শোনে না। তোমার সঙ্গে কথা বলে 'বোলার আশরাফুলকে নিয়ে সিডন্সের ভয়' শিরোনামে একটা লেখাও লিখেছিলাম এ নিয়ে।
প্রিয় অ্যাশ, বাকি চিঠিতে অ্যাশই বলি, তোমাকে তো এই নামেই ডাকতাম। মাশরাফির সঙ্গে তোমাকে দেখলেই বলতাম, 'বাংলাদেশের দুই আশা—অ্যাশ আর ম্যাশ। তুমিও আমাকে একটু ভিন্নভাবেই ডাকতে। বাংলাদেশ দলের বাকি সবাই যেখানে শুভ্রদা বা দাদা, তুমি ডাকতে শুভ্র ভাই । চিঠিটা একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পরের কথা আগে এসে যাচ্ছে, আগের কথা চলে যাচ্ছে পরে। আসলে স্মৃতি তো আর সিরিয়াল মেনে চলায় বিশ্বাস করে না। এই দেখো না, হঠাৎই সেটি আবার সেন্ট লুসিয়া থেকে কত হাজার মাইল দূরের কলম্বোতে ছুট লাগাল। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের প্রেসবক্সে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেছি। তখন তো আর ইন্টারনেটে বল বাই বল কমেন্টারি দেখার সুযোগ নেই। নেই পরে তা দেখে নেওয়ার সুযোগও। ল্যাপটপই তো ব্যবহার করতে শুরু করিনি তখনো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাই নোট নিতে হতো। আমি একটু বেশিই নিতাম। বোলারদের সব স্পেল, ব্যাটসম্যানের চার-ছয় কোন বোলারের বলে, কী শটে; এর বাইরেও আরও অনেক কিছুই লেখা থাকত আমার নোটবুকে। সাংবাদিকদের কাজ নিয়ে তোমার অসীম কৌতূহল থেকে তুমি তো অনেকবারই তা দেখেছ। তোমাকে এই চিঠিটা লিখতে লিখতেই পুরোনো সেই নোটবুকটা বের করলাম। হার্ড কাভারে বাঁধানো বড় একটা খাতাই। তোমার সেই সেঞ্চুরির খুঁটিনাটি লেখা সেই পৃষ্ঠাটা। সব কটি চারের বিস্তারিত, সেঞ্চুরির আগের তিনটি বলের বর্ণনা। তখন তুমি ৯৮ রানে, ভাসের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে বুক কাঁপিয়ে দেওয়া 'ওয়াইল্ড সুইং (নোটবুকে এটাই লেখা), পরের বলে স্কয়ার ড্রাইভে কোনো রান নেই, এর পরের বলে স্লিপের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি। আমার নোটবুকে সবুজ কালিতে ইংরেজিতে বড় করে লেখা : Ashraful's 100, 167b, 188m, 4x14.
এটা লিখেছিলাম তোমার সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর। তোমার উদযাপনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকক্ষণ হাততালি দিয়ে নিজের সিটে ফিরে। প্রায় পুরো প্রেসবক্সই তখন দাঁড়িয়ে। আর আমি তো দাঁড়িয়ে গেছি তুমি আশির ঘরে যাওয়ার পরই। নোটবুকেই দেখছি, পাতার নিচের দিকে ৮১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো লেখা। বলতে পারো, একধরনের কাউন্ট ডাউন। নাকি কাউন্ট আপ? এখানে যে সংখ্যাগুলো ক্রমেই বেড়েছে। তোমার অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল রেখে যেগুলো কাটা–৮১ থেকে ৮৩ পরপর তিনটি সংখ্যা একটি-একটি করে, মানে ৩টি সিঙ্গেল। এরপর ৮৪ থেকে ৮৭ এক টানে কাটা—যার মানে ‘চার', এরপর আবার একটি করে কাটা ৫টি সংখ্যা, মানে ৫টি সিঙ্গেল। ৯৩ ৯৪ এক টানে কাটা, এরপর এক টানে ৯৫ থেকে ৯৮...৯৯ আর ১০০ সংখ্যা দুটিতে কোনো আঁচড়ই পড়েনি।
পরিসংখ্যানের সব খুঁটিনাটি তোমার যেমন মুখস্থ থাকত (এখনো কি তেমনই থাকে?), তাতে তোমাকে এসব এমন সবিস্তারে বলার কোনো মানে হয় না। নির্ঘাত তোমার সব মনে আছে। তারপরও বলছি নোটবুকটা এক টানে ২০০১ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ায়। ওই যে তোমার রান ৮১ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কাটাকুটি, এর সবই ওই মোটা নোটবুকটা হাতে উত্তেজনায় দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
সেই পৃষ্ঠারই আরেক জায়গায় লেখা : 16 yrs 362 days debut, নিচের লাইনে 16 yrs 364 days. পরের বয়সটার ব্যাখ্যা লেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। ওটা ছিল সেঞ্চুরির দিন তোমার বয়স। তখন তো কি-বোর্ডের এক টিপে রেকর্ড বের করে ফেলা যেত না। শ্রীলঙ্কান সাংবাদিক সাদি তৌফিক তাঁর ছায়াসঙ্গী ঢাউস আকৃতির দ্য উইজডেন বুক অব টেস্ট ক্রিকেট বইটার পেছনের রেকর্ড সেকশনে গিয়ে নিশ্চিত করলেন, মুশতাক মোহাম্মদের ১৭ বছর ৮২ দিনের রেকর্ড ভেঙে তুমিই এখন টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান। পরদিন হোটেলে সাদি তৌফিক তোমার ইন্টারভিউ করতে এলেন একটা কেক সঙ্গে নিয়ে। বার্থডে কেক!
তুমি কেকটা হাতে নিয়ে বললে, 'আজ তো আমার জন্মদিন না, আমার পাসপোর্টের জন্মতারিখটা ভুল। আমার আসল জন্মতারিখ ১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই।' শুনে তো সাদির মুখ চুন। পাসপোর্টের বয়স ধরে তুমি বিশ্ব রেকর্ড করেছ বলে ছাপা হয়ে গেছে তাঁর পত্রিকায়, কী কেলেঙ্কারি! আমি সাদিকে আশ্বস্ত করলাম। 'ভুল'টা তো তুমি আমাকে আগের দিনই বলেছ। আমি তখনই হিসাব করে দেখেছি, তাতেও মুশতাকের চেয়ে ১৯ দিন কম বয়সে সেঞ্চুরি হয়েছে তোমার। শুনে সাদির মুখে হাসি ফুটল। তাজ সমুদ্র হোটেলের লবিতে মহাসমারোহে কাটা হলো সেই কেক। চারপাশে আনন্দের ফোয়ারা! কে বলবে, বাংলাদেশ তিন দিনে হেরে গেছে টেস্টটা! তাতে কীই-বা আসে যায়! এই টেস্টে জয়ী তো একজনই—মোহাম্মদ আশরাফুল। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হিসেবে যখন তোমার নামটা ঘোষণা করা হলো, তোমার আকর্ণবিস্তৃত হাসিটা এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই। কল্পচোখে এখন যেমন দেখতে পাচ্ছি, তোমার ভুরু দুটি কুঁচকে গেছে। এখানে যে একটা ভুল আছে। তুমি ছিলে লেখায় ভুল ধরায় ওস্তাদ। একটু ঘনিষ্ঠতা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আজ কী লিখেছি পড়তে প্রায় প্রতিদিনই আমার রুমে আসাটাকে অনেকটা নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলে। তখন তো আর ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ার সুযোগ নেই।
২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে হারারেতে তেমনই এক সন্ধ্যায় আমার রুমে এসে একটা লেখা পড়তে পড়তে বললে, 'এখানে ভুল লিখেছেন। মার্ক ভারমিউলেনের মাথায় জহির খানের বাউন্সার লাগেনি, ইরফান পাঠানের বাউন্সার লেগেছিল।' আমি তর্ক জুড়লাম, ‘বেশি পণ্ডিতি কোরো না। ভারমিউলেন নিজে আমাকে বলেছে।' তুমি শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে আবার বললে, 'মাথায় বল লেগে ওর সব আউলাইয়া গেছে। চেক করে দেখেন, ইরফান পাঠানের বাউন্সার লেগেছিল ।' 'দাঁড়াও, তোমার মাতব্বরি বের করছি' ভঙ্গিতে ওই ম্যাচের রিপোর্টে গিয়ে দেখি, তুমিই ঠিক! এমন আশ্চর্য হয়েছিলাম যে বলার নয়। বিপদেও পড়েছিলাম। বাংলাদেশের সময় জিম্বাবুয়ের চেয়ে চার ঘণ্টা এগিয়ে। এতক্ষণে পত্রিকা প্রেসে চলে গেছে কি না, কে জানে! ব্যস্তসমস্ত হয়ে অফিসে ফোন করার চেষ্টা করছি, কিন্তু লাইন পাচ্ছি না। আমার পাগলের মতো অবস্থা দেখে তোমার সে কি হাসি!
দুই বছর পর বগুড়ায় তো মনে হয় আমাকে প্ল্যান করেই ধরেছিলে। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই সময় বাংলাদেশের বড় জয়ের 'নিয়ম' অনুযায়ী, তুমিই দলের সর্বোচ্চ স্কোরার। মাঠে উন্মাতাল জয়োৎসবের মধ্যমণিও। আমাকে দেখে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বললে, 'প্রথম ম্যাচের পর যে আপনি লিখলেন, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩টি ওয়ানডেতে আমার ৪, ৯৩, ০ রান, দ্বিতীয় ম্যাচে তো আমি ৩১ করেছিলাম।'
আমি বললাম, 'কাল তো তোমার সঙ্গে দেখা হলো, তখন তো কিছু বললে না!' তুমি দুষ্টুমির একটা হাসি দিয়ে বললে, 'তখন কি আর এমন জোর দিয়ে বলতে পারতাম!'
তা কলম্বোতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ বলায় ভুলটা কোথায়, যে কল্পচোখে তোমার কুঁচকানো ভুরু দেখে ফেললাম। সেই টেস্টে আসলে 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ'-এর বদলে নির্বাচিত হয়েছিল 'মেন অব দ্য ম্যাচ'। তোমাকে না দিয়ে পারা যাচ্ছে না, আবার দুই ইনিংসেই ৫-৫ করে মোট ১০ উইকেট নেওয়া মুত্তিয়া মুরালিধরনকেই বা উপেক্ষা করা যায় কীভাবে! প্রাইজ মানির নিজের ভাগটা না নিয়ে মুরালি তোমাকে বলেছিল, 'পুরো টাকাটাই তুমি নিয়ে নাও।'
(লেখকের 'এগারো' বই থেকে)
আরও পড়ুন:
পর্ব-১: প্রথম দেখার স্মৃতি এবং...
পর্ব-৩: 'মধ্যদুপুরে আশরাফুল যেন মায়াবী বিভ্রম'
চলবে...