প্রথম দেখার সেই স্মৃতি এবং...
উৎপল শুভ্র
৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
রূপকথাকেও হার মানানোর মতো এক ক্রিকেট জীবনে মোহাম্মদ আশরাফুল কত রকম অভিজ্ঞতার সঙ্গেই না পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এ দেশের মানুষকে। সাংবাদিকের ভূমিকায় তা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে উৎপল শুভ্রও তাতে কম আন্দোলিত হননি। আশরাফুলের উত্থান-পতন সব কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকার পর তা নিয়ে লিখতে গিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ানের কাছে খোলা চিঠির অনেক পুরোনো ফর্মটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত বলে মনে হলো।
প্রিয় আশরাফুল,
রাত ১২টা থেকে ল্যাপটপের সামনে স্তব্ধ বসে থেকে রাত আড়াইটায় কী ভেবে যে লিখে ফেললাম, 'প্রিয় আশরাফুল!' মাঝের আড়াই ঘণ্টায় একটা শব্দই বারবার লিখেছি আর ব্যাক স্পেস দিয়ে মুছে ফেলেছি। সেটি তোমার নাম—মোহাম্মদ আশরাফুল।
কী লিখব তোমাকে নিয়ে, কী দিয়ে শুরু করব। এই বইয়ে আরও যে দশ ক্রিকেটারকে নিয়ে লিখেছি, আর কাউকে নিয়ে এই সমস্যা হয়নি। সেটিই হয়তো স্বাভাবিক। আর কারও গল্পটাই তো তোমার মতো নয়। আমার সাংবাদিকতা জীবনে আর কেউ তো তোমার মতো এমন উথালপাতাল আবেগের ঢেউয়েও দোলায়নি। আমাকে দিয়ে কে যেন 'প্রিয় আশরাফুল' লিখিয়ে নিল, সেটি কি এ কারণেই তোমার গল্পটা অন্য দশজনের মতো করে লিখলে হবে না বলে!
তোমাকে কি তাহলে চিঠিই লিখব! যে চিঠি এই বইয়ের মাধ্যমেই তোমার কাছে পৌঁছাবে বলে 'খোলা চিঠি' বলাই ভালো।
তাতেও তো দেখি, সমস্যাটা থাকছেই! দুটি প্যারা লিখে আবারও ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে সেই স্তব্ধ বসে থাকা! কী দিয়ে শুরু করব চিঠিটা! ব্যাট হাতে তোমার উপহার দেওয়া অনির্বচনীয় সব আনন্দ দিয়ে? সেই তোমারই দেওয়া হৃদয় এফোঁড়-ওফোড় করা দুঃখগাথা দিয়ে? ট্যুরে গিয়ে মাঠের বাইরে তোমার আনন্দ-বেদনার অংশীদার হওয়ার কত শত দিন নিয়ে? নাকি শুরু করব তোমাকে প্রথম দেখার স্মৃতিটা দিয়েই!
কত বছর আগের কথা, তারপরও দৃশ্যটা কীভাবে এমন পরিষ্কার চোখে ভাসছে! যেন আজ বিকেলেই দেখেছি! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেই বিকেল। তখন যেটিকে পশ্চিম গ্যালারি বলা হতো, সেটির পাশে তুমি ব্যাটিং করছ।
সেখানে উইকেট-টুইকেট নেই, ব্যাটিং করছ ঘাসের ওপরে। তখনকার ক্রিকেট বোর্ডের বারান্দা থেকে দেখছি বলে ছোট্ট তোমাকে আরও ছোট্ট দেখাচ্ছে। তোমাকে দেখব বলেই ওখানে দাঁড়িয়েছি। কদিন আগে শিলিগুড়িতে কী একটা টুর্নামেন্টে বিসিসিবি আন্ডার থার্টিন না ফিফটিনের হয়ে অনেক রান করে এসেছ ৷ ‘আশরাফুল’ নামটা সেই প্রথম শোনা। বোর্ড অফিসে ঢুকে কেউ বোধ হয় বলেছিল, বারান্দায় গিয়ে আশরাফুল ছেলেটার ব্যাটিংটা একটু দেখে আসেন। দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম। প্যাড জোড়া তোমার প্রায় কোমর ছুঁয়েছে। ব্যাটটাও তো প্রায় তোমারই সমান! একটা কাভার ড্রাইভ মারলে, পরের বলটাতেই খেললে কপিবুক ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ শট। এত দিন পরও ছবিটা এত স্পষ্ট মনে করতে পারছি দেখে নিজেই একটু অবাক হচ্ছি। তোমার গুরু ওয়াহিদুল গনিই কি তাঁর অঙ্কুর একাডেমির শিষ্যদের স্টেডিয়ামে নিয়ে এসেছিলেন! হয়তো তাই, নিশ্চিত হতে পারছি না।
তোমার সঙ্গে প্রথম কবে কথা হয়েছিল, এটাও যেমন নয়। তোমাকে প্রথম দেখার কিছুদিন পরেই হবে। তখন এত ছোট তুমি, কীভাবে তোমাকে আপনি বলি! সাংবাদিকতা জীবনে নিজেরই ঠিক করে নেওয়া নীতির বাইরে গিয়ে তুমি তাই 'তুমি'। যে ‘নীতি'র ব্যতিক্রম বলতে তুমি ছাড়া বাংলাদেশের আর মাত্র তিন-চারজন ক্রিকেটার।
তোমাকে নিয়ে বেশি লিখি 'অভিযোগে' প্রথম আলোকে যখন অনেকে আড়ালে 'আশরাফুলের আলো' বলেন, তাঁদের প্রকাশ্য অনুযোগ ছিল—আশরাফুলকে আপনি বেশি পছন্দ করেন বলেই ওকে 'তুমি' বলেন। ওর চেয়ে জুনিয়র কত ছেলে আপনার চোখের সামনে বড় হলো, কই, তাদের তো তুমি বলেন না!
তোমাকে 'তুমি' করে বলাটা নিছকই ঘটনাচক্রে, ‘বেশি পছন্দ' করার সঙ্গে সেটি মিলে যাওয়াটা কাকতাল মাত্র। 'বেশি পছন্দ' করার অভিযোগ সত্যি। তবে তা অন্যায় পক্ষপাত ছিল না। সেটি যে কারণে, সেই বিশ্বাসটা আমার এখনো বদলায়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তোমার চেয়ে বেশি সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মায়নি আর কোনো ব্যাটসম্যান। নেটে তুমি যখন ব্যাটিং করতে, আমি নিয়ম করে পেছনে দাঁড়িয়ে তা দেখতাম। দিনের বাকিটা সময় তা যেন চোখে লেগে থাকত। ডেভ হোয়াটমোর প্রায়ই রসিকতা করতেন, 'তুমি দেখি অ্যাশের প্রেমে পড়েছ! অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প করছ, আড্ডা মারছ; কিন্তু অ্যাশ নেটে গেলেই দেখি পেছনে ছুটে আসছ।'
তা তোমার প্রেমে কে পড়েনি! তুমিই তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম প্রেম। অভিষেকেই রেকর্ড ভেঙেচুরে শতাব্দীপ্রাচীন টেস্ট ইতিহাস কাঁপিয়ে দেওয়া সেই সেঞ্চুরির দিনটি থেকেই তো মোহাম্মদ আশরাফুল আর শুধুই একজন ক্রিকেটার নয়, থরথর এক আবেগের নাম। দিনে দিনে কত রকম রং-ই না চড়েছে সেই আবেগের গায়ে। আনন্দ-বেদনা-আশা-হতাশা-হাসি কান্না-স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ...সেটির যেন আর শেষ নেই। বাস্তবের ভালোবাসার মানুষও বোধ হয় বিপরীতমুখী এত সব অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে না কাউকে। মানুষ তোমাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে, আবার প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় এমন কথাও বলেছে যেন তুমি তাদের চিরশত্রু। একবার তো তোমাকে নিয়ে এমন একটা লেখার কথাও মাথায় এসেছিল, যেটির শিরোনাম হবে: 'দ্য ক্রিকেটার পিপল লাভ টু হেট'। অনেকে হয়তো এটিকে তোমার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার সময়টার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে। আমি তো বলছি এর অনেক আগের কথা। যখন তোমার আরেকটা ব্যর্থতা চারপাশে এমন একটা শোরগোল তুলে দিত যে, যেন তুমি খারাপ খেলোনি, কোনো অপরাধ করেছ!
তোমাকে হয়তো বলেছিও, দু-একবার কেন যেন সেটির হাওয়া আমার গায়ে এসেও লাগত। মাঠ থেকে অফিসে ফিরতেই কানে ভেসে আসত অন্য বিভাগের সহকর্মীদের টিপ্পনী। হয়তো কোনো সিরিজের বাংলাদেশ দল ঘোষণা করা হয়েছে, আমাকে 'প্রধান নির্বাচক'-এর আসনে বসিয়ে দিয়ে কেউ বলে বসত, 'ঠিকই তো আশরাফুলকে দলে রেখে দিলেন।' ২০১১ বিশ্বকাপের আগে অফিসে বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞের প্রচার পরিকল্পনা নিয়ে মিটিং হচ্ছে, অপ্রাসঙ্গিকভাবেই নামী বিজ্ঞাপনী সংস্থার ততোধিক নামী প্রধান নির্বাহীর সরাসরি আক্রমণ, 'আপনার জন্যই আশরাফুলটা আবার টিকে গেল। আবারও দলকে ডোবাবে।'জেমি সিডন্সের ঘটনাটা তো তুমি জানোই। ওই যে ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের কোচ তোমাকে নিয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলে বসলেন, 'অ্যাশের কাছ থেকে তুমি কত টাকা করে পাও?' রাগে কাঁপতে থাকা আমাকে দেখে সন্ধি প্রস্তাব দেওয়ার আগে সিডন্সের করা ভবিষ্যদ্বাণীকে কী আশ্চর্যভাবেই না সত্যি প্রমাণ করেছিলে তুমি। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেদিনই ৪৯ বলে ৬৫ রানের একটা দারুণ ইনিংস খেলেছ, দেখার মতো ছক্কা মেরেছ, একটা! টিম হোটেলের সামনের রাস্তায় হঠাৎ দেখা পেয়ে যাওয়া সিডন্সকে 'অবশেষে কি আশরাফুলকে চিনতে পারলে' জাতীয় কোনো কথার জবাবেই আচমকা এই আক্রমণ। যাতে এমন এক অপবাদ, আমার সাংবাদিকতা জীবনে যা কেউ আগে কখনো দেওয়ার সাহস পায়নি, পরেও না। আমার চেহারা দেখেই সিডন্স বুঝে ফেলেছিলেন, শটটা ভুল খেলা হয়ে গেছে। এর আগেই ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করে বলা ওই কথাটা, ‘আশরাফুলের মতো ইনকনসিসট্যান্ট ব্যাটসম্যান আর আছে নাকি! পরের ম্যাচেই হয়তো শূন রানে আউট হয়ে যাবে।'
মনে এসেছে, বলে ফেলেছেন। সিডন্সও হয়তো ভাবেননি, তিনি এমন নস্ট্রাডামুসের বংশধর বলে প্রমাণিত হবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে তুমি সত্যি সত্যিই শূন্য রানে আউট!
মনে যা আসে, সিডন্সের তা-ই বলে ফেলার অভ্যাস তো তোমার অজানা নয়, তবে মনটা খুব পরিষ্কার ছিল। আমাকেই যেমন আলটপকা ওই কথাটা বলে ফেলার পর বারবার 'সরি' বলে একসঙ্গে ডিনার করার জন্য এক রকম টেনেই গাড়িতে ওঠালেন। গভীর রাতে জমজমাট সেন্ট লুসিয়ার বিখ্যাত ফুড স্ট্রিটে যাওয়ার পর সেখানে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা ছিল বাড়তি পাওনা। ডেভিড ওয়ার্নার, শেন ওয়াটসন, শন টেইট, স্টিভ স্মিথের কথা মনে আছে। আরও কে কে যেন ছিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় ওই কথাটা যে ‘মিন’ করে বলেননি জানিয়ে আবারও ‘সরি’ বলেছিলেন। সিডন্সের দুঃখ প্রকাশটাকে আন্তরিক বলে মনে হয়েছিল বলেই আমি ওই ঘটনার কথা পত্রিকায় লিখিনি। সফরসঙ্গী অন্য পত্রিকার সাংবাদিক তা সবিস্তারে লিখে দেওয়ায় সিডন্সের সে কি রাগ! ঘোষণা দিয়েই বাকি সফরে আর ওই সাংবাদিকের ছায়াও মাড়াননি। আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে হয় সরে গেছেন, নয়তো আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন। পরদিন দেখা হওয়ার পর তোমার সঙ্গে মজা করলাম, ‘তোমার কাছে তো আমার অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছে।' সিডন্সের সঙ্গে ওই বাদানুবাদের বিস্তারিত শুনে তুমি হেসে বলেছিলে, ‘হালায় একটা পাগল!'
(লেখকের 'এগারো' বই থেকে)
আরও পড়ুন:
পর্ব ২: দুনিয়া কাঁপানো সেই সেঞ্চুরি এবং জন্মতারিখের ভুল
চলবে...