টেন্ডুলকার-ওয়ার্নকেই কেন ডেকেছিলেন ব্র্যাডম্যান?

উৎপল শুভ্র

২৮ আগস্ট ২০২১

টেন্ডুলকার-ওয়ার্নকেই কেন ডেকেছিলেন ব্র্যাডম্যান?

ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে সব খেলা মিলিয়ে চিন্তা করলেও ডন ব্র্যাডম্যান বিস্ময় হয়েই থাকেন। কোনো খেলাতেই বাকি সবাইকে ছাপিয়ে কোনো একজনের এমন উচ্চতায় উঠে যাওয়ার উদাহরণ যে নেই। ডন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে এই ধারাবাহিকে তাঁর কীর্তিগাথার কিছুটা বর্ণনার সঙ্গে থাকবে `ব্র্র্যাডম্যান কেন ব্র্যাডম্যান`, তা বিশ্লেষণের চেষ্টাও। যাঁর ব্যাটিংয়ে নিজের ছায়া দেখেছিলেন, সেই শচীন টেন্ডুলকারও উঁকি দিয়ে যাবেন কখনো কখনো।

মুম্বাইয়ের ১৯ এ পেরি ক্রস রোডের বাড়িটার ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝুলছে এক টুকরা অ্যাডিলেডের ২ হোল্ডেন স্ট্রিট। বাঁধানো একটা ছবি। শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে হাসি হাসি মুখে তিনি।

পেরি ক্রস রোডের ওই বাড়িটা শচীন টেন্ডুলকারের। হোল্ডেন স্ট্রিটেরটা কার, বলার দরকার আছে?

২২১ বি বেকার স্ট্রিট বললেই যেমন সবাই বুঝে ফেলেন শার্লক হোমসের কথা হচ্ছে, অতটা হয়তো নয়। তবে ক্রিকেট অনুসারীদের বেশির ভাগের কাছেই ঠিকানাটা পরিচিত। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ওই বাড়িতেই থাকতেন ।

এটাও বোধ হয় কারও অজানা নেই যে, কোনো এক ২৭ আগস্ট শচীন টেন্ডুলকার সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সঙ্গে শেন ওয়ার্নও। সাল ১৯৯৮, উপলক্ষ ডন ব্র্যাডম্যানের ৯০তম জন্মদিন। অনেক বছরই বহির্জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ব্র্যাডম্যান জন্মদিনে ওই দুজনের সঙ্গ কামনা করলেন, নিশ্চয়ই এর কোনো তাৎপর্য ছিল।

জীবনে যত বোলারকে খেলেছেন, বলা ভালো, যত বোলারকে উড়িয়ে দিয়েছেন, সবার ওপরে রেখেছেন কৈশোরে বাউরাল ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া এক লেগ স্পিনারকে। নাম বিল ও'রিলি। শেন ওয়ার্নকে দেখে কি অস্ট্রেলিয়ান সতীর্থের কথা মনে পড়ত ব্র্যাডম্যানের?

পড়লেও কোনো দিন তা বলেননি। শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার কথা বলেছেন। টেলিভিশনে টেন্ডুলকারকে দেখে চমকে গিয়ে স্ত্রী জেসিকে ডেকে এনেছিলেন। তিনি তো আর নিজেকে ব্যাটিং করতে দেখেননি। যা মনে হচ্ছে, সেটি ঠিক কি না নিশ্চিত হতে তাই স্ত্রীর শরণাপন্ন। জেসিও মিল খুঁজে পেলেন। অ্যালবাম উল্টে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিংয়ের কিছু ছবি বের করা হলো। দুজনই দ্রুত একমত হয়ে গেলেন, উচ্চতায় সামান্য খাটো ওই ছেলেটার সঙ্গে আসলেই অদ্ভুত মিল।

৯০তম জন্মদিনে অ্যাডিলেডে নিজের বাড়িতে শেন ওয়ার্ন ও শচীন টেন্ডুলকারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান

ব্র্যাডম্যানের পর ক্রিকেটে কত ব্যাটসম্যান এল গেল। কয়েক প্রজন্ম পরের নাতির বয়সী ভারতীয় তরুণের সঙ্গে কোথায় মিল, ব্র্যাডম্যান সেটি বিস্তারিত বলেননি। বললে দারুণ হতো। ক্রিকেটটা কেমন খেলতেন, সেটি তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লোকগাথার মতো প্রচারিত। অন্য গুণও ছিল। ক্রিকেট নিয়ে কিছু বললে সব সময়ই শোনার মতো হতো। লিখতেনও সেরকম। খেলা ছাড়ার দুই বছর পর প্রকাশিত আত্মজীবনী ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট ক্লাসিক বলে বিবেচিত। আর দ্য আর্ট অব ক্রিকেট নামে যে বইটি লিখেছেন, সেটি না পড়ে ক্রিকেট কোচিংয়ে আসাটা এখনো পাপের পর্যায়ে পড়ে। টেন্ডুলকারের সঙ্গে নিজের মিল-অমিল নিয়ে বিস্তারিত বললে বা লিখলে সেটিও নিঃসন্দেহে দারুণ কিছুই হতো।

ব্র্যাডম্যান ও টেন্ডুলকারের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, সেটির বিস্তারিতও অজানা। ছাড়া ছাড়া যা জানা যায়, টেন্ডুলকার টেস্ট ম্যাচের আগে ব্র্যাডম্যানের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। ব্র্যাডম্যান জানান, অ্যাডিলেডে খেলা থাকলে সকালে কর্মস্থলে দু-তিন ঘণ্টা কাটাতেন। খেলা শেষে আরেকবার যেতে হতো। অন্য কোনো শহরে খেলা হলে খেলার আগে-পরে অনেকটা হাঁটতেন। টেন্ডুলকার ছোটবেলা থেকেই কোচিং পেয়েছেন জেনে ব্র্যাডম্যান নাকি বেশ অবাকই হয়েছিলেন। ব্যতিক্রমী গ্রিপই একমাত্র কারণ নয়। কোচিং ম্যানুয়াল অনুযায়ী স্টান্স নেওয়ার পর ব্যাটসম্যানের বা কনুই মিড অফমুখী থাকার কথা। ব্র্যাডম্যানের মতো টেন্ডুলকারেরও তা থাকত না।

ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যান ছিলেন স্বশিক্ষিত। প্রথাগত কোচিং পাননি কখনোই

ব্র্যাডম্যানের না-ই থাকতে পারে। তিনি স্বশিক্ষিত। কখনো প্রথাগত কোচিং পাননি। বাউরালের বাড়ির পেছনে ৮০০ গ্যালনের একটা জলের ট্যাংকি ছিল । নিচটা ইট দিয়ে বাঁধানো। সেখানে গলফ বল ছুড়ে সঙ্গীসাথিহীন বালকের একটা স্টাম্প দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেরে যাওয়ার গল্প তো বহুল কথিত। ক্রিকেটার হবেন, এমন কোনো স্বপ্ন থেকে নয় । নিছকই খেলার জন্য খেলা। চোখ, মস্তিষ্ক আর হাতের যে সমন্বয় পরে বাকিদের চেয়ে তাঁকে আলাদা করে দেবে, সেই কাজটা অবশ্য ওতে ভালোই হয়েছিল। ‘টেস্ট ম্যাচ’ও হতো সেখানে! বালকের মনোভূমিতে রচিত সেই টেস্ট ম্যাচে খেলতেন জ্যাক গ্রেগরি, হার্বি কলিন্সের মতো বিখ্যাত ক্রিকেটাররা। খাওয়ার জন্য মায়ের ডাকাডাকি ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটাত ৷

১১ বছর বয়সে জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে যখন ব্যাট করতে নামেন, বোলার হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে। বেরিয়ে আসেন অপরাজিত ৫৫ করে। প্রথম সেঞ্চুরি ১২ বছর বয়সে। বাউরাল হাইস্কুলের হয়ে প্রথম ম্যাচে দলের ১৫৬ রানের মধ্যে তাঁর ১১৫। টেস্ট ম্যাচের সঙ্গে পরিচয় পরের বছর। সিডনিতে দুই দিনের সফরে অ্যাশেজ টেস্ট দেখতে বাবার সঙ্গী। কিশোর টেন্ডুলকার যেমন ভিভ রিচার্ডসকে দেখে মোহিত হয়ে যান, ব্র্যাডম্যানের মনে তেমনি দাগ এঁকে দেন চার্লস ম্যাকার্টনি। ১৭০ রানের ইনিংসে ম্যাকার্টনির রাজকীয় সব ড্রাইভ যেমন মনে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল, তেমনি এসসিজিও। বাবা বড় আমোদ বোধ করেছিলেন কিশোর ডনের কথা শুনে, ‘এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।'

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান: এক এবং অদ্বিতীয়

অথচ এর বছর দুয়েক পর ক্রিকেট খেলাই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন! স্কুলে টেনিস, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস সবই খেলতেন এবং কোনোটার চেয়ে কোনোটা খারাপ নয়। বয়স যখন পনেরো, সব বাদ দিয়ে শুধুই টেনিস খেলতে শুরু করলেন। মিল খুঁজলে তো কত কিছুতেই খোঁজা যায়। এখানেও যেমন শৈশবে টেন্ডুলকারের ‘জন ম্যাকেনরো’ হয়ে যাওয়ার গল্পটা মনে পড়ছে। ১৯৮১ উইম্বলডনের মহাকাব্যিক সেই ফাইনালে বড় তিন ভাইবোনই বিয়ন বোর্গের সমর্থক। শুধু আট বছরের টেন্ডুলকার জন ম্যাকেনরোর হয়ে গলা ফাটাচ্ছে। ম্যাকেনরো জিতলেন। টেন্ডুলকারের খুশি দেখে কে! তখন ম্যাকেনরোর মতোই লম্বা চুল। হেডব্যান্ড আর রিস্টব্যান্ডও কেনা হয়ে গেল । টেনিস র‍্যাকেট হাতে টেন্ডুলকার যেন ‘মিনি ম্যাকেনরো।’ সাহিত্য সহবাসে তার নামও হয়ে গেল ‘ম্যাক'! ভক্ত ছিলেন ম্যাকেনরোর, তবে মেজাজি আমেরিকানের চেয়ে ‘আইস কুল' সুইডের সঙ্গেই বরং বেশি মিল ছিল ক্রিকেট মাঠের টেন্ডুলকারের।

টেনিসের নেশা কাটিয়ে ব্র্যাডম্যান আবার ক্রিকেটে ফিরলেন। এমনভাবেই যে, নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকের আগেই নাম হয়ে যায় 'বাউরাল ওয়ান্ডার!’ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই অভিষেকেই সেঞ্চুরি। প্রথম বছরেই আরও দুটি সেঞ্চুরিতে পরের বছরই টেস্ট অভিষেক। ব্রিসবেনে দুই ইনিংসে ১৮ ও ১ রান করে পরের টেস্টে মাঠে জল তোয়ালে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে। অনাদিকালের বিস্ময় হয়ে লেখা হয়ে যায় কথাটা— ব্র্যাডম্যানও ড্রপড্ হয়েছিলেন! মেলবোর্নে ফিরলেন এবং দুই ইনিংসে ৭৯ ও ১১২। যে রেকর্ডটা করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন টেন্ডুলকার, দ্বিতীয় ইনিংসের সেঞ্চুরিতে সেই রেকর্ডটাও হয়েছিল। ২০ বছর ১২৯ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে ব্র্যাডম্যান তখন টেস্ট ক্রিকেটের কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ান।

এরপর যা হলো, সেটি এক কথায়—রান, রান, আরও রান! ক্রিকেট ইতিহাস এর আগে বা পরে এমন কিছু দেখেনি। ১৯৩০ সালের ইংল্যান্ড সফরে সেই যে ‘ব্র্যাডম্যান কিংবদন্তি'র জন্ম হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। এত বছর পরও যে ঔজ্জ্বল্যে কোনো ছায়া পড়েনি।

(লেখকের 'শচীন রূপকথা' বই থেকে)

চলবে...
 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×